যখন চীনের সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীরা ৩৮ বছর বয়সী তাহির ইমিনের শরীর থেকে রক্ত নিচ্ছিলেন তখনই তার সন্দেহ হয়। তাকে বলা হয়েছিল, সরকারিভাবে সকল নাগরিকের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা হচ্ছে। কিন্তু হৃদপিণ্ড কিংবা কিডনিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরিবর্তে তার মুখের ছবি ও হাতের আঙুলের ছাপ নেয়া হয়। রেকর্ড করা হয় কণ্ঠস্বর। স্বাস্থ্যপরীক্ষায় যে কণ্ঠ রেকর্ড বা আঙুলের ছাপ নেওয়া হয় না, সেটা তাহির খুব ভালোভাবেই জানতেন।
এরপরও তিনি পরীক্ষার রিপোর্টগুলো দেখতে চান। কিন্তু তাকে রিপোর্ট দেখাতে দেওয়া হয় না। বলা হয়, তার রিপোর্ট দেখার কোনো অধিকার নেই। যদি বেশি কিছু জানার থাকে তাহলে তাকে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে হবে।
তাহির ইমিন পুলিশের সাথে আর যোগাযোগ করেননি। কেননা ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন কেন এসকল নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার এই গল্পটা চীনের আর দশজন উইঘুর মুসলিমের মতোই। ১০ লাখের অধিক মুসলমানকে বন্দিশিবিরে আটকে রেখে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের পর এবার অন্যান্য মুসলিমদের শরীর থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করছে চীনের সরকার। কিন্তু তারা এটাকে বলছে স্বাস্থ্যপরীক্ষা। তবে অবাক করা বিষয় হলো চীনের ডিএনএ সংগ্রহের কার্যক্রমে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। যারা উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন করার বিপক্ষে কথা বলে থাকে।
কারা এই উইঘুর মুসলিম?
চীনের সর্ব পশ্চিমের এবং সর্ববৃহৎ প্রদেশ জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের বসবাস। তাদের আদি নিবাস ছিল পূর্ব তুর্কিস্থানে। তুর্কিস্থান বলতে যে সকল দেশে তুরস্কের বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীর বসবাস। চীনের বিভিন্ন প্রদেশে উইঘুররা বসবাস করে থাকেন। তবে সংখ্যার দিক দিয়ে জিনজিয়াংয়েই সর্বোচ্চ। সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুকের তথ্য মতে, জিনজিয়াংয়ে মোট ১ কোটি ২০ লাখ উইঘুর বসবাস করেন।
এছাড়া চীনে অন্য যে সকল মুসলিম সম্প্রদায় বসবাস করেন তাদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় দেড় থেকে দুই শতাংশ। চীনের প্রায় একশ চল্লিশ কোটি জনসংখ্যার মধ্য মুসলিমদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য বলা চলে। কিন্তু এরপরও মুসলিমদের সাথে সাপে-নেউলে সম্পর্ক চীন সরকারের।
চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে উইঘুর মুসলিমদের বিরোধের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। একসময় পূর্ব তুর্কিস্থান স্বাধীন ছিল। কিন্তু ১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্থানে মাঙ্কু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে চীনা শাসন চালু হয় এবং এই অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়। তবে সেটা স্থায়ী করতে চীনাদের বেশ বেগ পেতে হয়। চীনের সৈন্যদের বিপক্ষে উইঘুর মুসলিমরা অস্ত্র তুলে নেয় এবং ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে দুইবার তারা স্বাধীনতাও অর্জন করে।
কিন্তু চীন একেবারেই হাল ছেড়ে দেওয়া পাত্র ছিল না। ১৯৪৯ সালে চীনের কমিউনিস্টদের কাছে উইঘুররা আবারো পরাজিত হয় এবং সেখানে স্থায়ীভাবে চীনা শাসন কায়েম হয়। তবে উইঘুর সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়াংকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করে কমিউনিস্টরা। কিন্তু এরপরও চীন সরকার তাদের উপর প্রতিনিয়ত দমন ও নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। সাম্প্রতিক সময়ে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকারের খড়গহস্ত হওয়ার বড় কারণ ২০০৯ সালে জিনজিয়াংয়ের দাঙ্গা। সেবছর চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হানদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উইঘুররা। তবে তারা বিনা কারণে হানদের উপর হামলা চালায়নি। বরং হানদের অত্যাচারের কারণেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তারা।
২০০৯ সালের সেই দাঙ্গায় প্রায় ২০০ এর কাছাকাছি মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যার অধিকাংশই ছিলেন হান জনগোষ্ঠীর। পরবর্তীতে চীনের সরকারি বাহিনী উইঘুরদের ঘরে ঘরে গিয়ে তল্লাশি ও নির্যাতন চালানো শুরু। এরপর ২০১৪ সালে এরকম আরো কিছু ঘটনায় প্রায় একশ মানুষের প্রাণ যায়। তখন থেকেই চীন উইঘুরদের প্রতি নির্যাতনের মাত্রা কঠোর থেকে কঠোরতর করে। যা সম্প্রতি সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুরকে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে আটক করে নির্যাতন করছে চীনের নিরাপত্তা বাহিনী। যা চীনের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও উঠে এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে।
ডিএনএন সংগ্রহ করার কারণ
চীনের অভ্যন্তরে সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো দুঃসাহস কারো নেই বললেই চলে। চীনের সংখ্যাগরিষ্ঠ হান জনগোষ্ঠীও কখনো কমিউনিস্ট সরকারের বিপক্ষে কথা বলার মতো সাহস দেখায় না। বিপরীতে উইঘুর মুসলিমরা এখনো স্বাধীনচেতা এবং প্রতিবাদী। চীনের একদলীয় কমিউনিস্ট শাসক জনগণের যেকোনো আন্দোলনকেই ভয় পায়। এ কারণেই চীনের কেন্দ্রীয় সরকার উইঘুর মুসলিমদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এর জন্য তারা ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর নগ্ন হস্তক্ষেপ করে যাচ্ছে। সেই সাথে উইঘুরদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য জোরপূর্বক আটক রেখে মান্দারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে।
২০১৬ সালে জিনজিয়াং প্রদেশে ‘Physicals For All’ নামে একটি স্বাস্থ্য ক্যাম্পেইন চালু করে চীন সরকার। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জিনহুয়ার তথ্য মতে, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে প্রায় ৩৪ মিলিয়ন নাগরিক এই ক্যাম্পেইনে অংশগ্রহণ করেছে। কিন্তু এখানে বড় প্রশ্ন হলো জিনজিয়াংয়ের মোট নাগরিক মাত্র ২৪.৫ মিলিয়ন, তাহলে বাকি ১০ মিলিয়ন মানুষ কোথা থেকে আসলো?
বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে উইঘুরদের বারবার স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে তাদের ডিএনএ নমুনা, চোখের আইরিশের ছবি এবং অন্যান্য তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। যাতে করে একজন মুসলমানও বাদ না পড়ে। এর ফলেই সংখ্যাটা বেড়েছে। যে সকল উইঘুর জিনজিয়াংয়ের বাইরে থাকেন তাদেরকে পুলিশের পক্ষ থেকে চিঠি অথবা মুঠোফোনে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যপরীক্ষার কথা বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ বিভাগ যেভাবে নাগরিকদের ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরি করেছে। ঠিক একইভাবে উইঘুরদের ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরি করছে চীন। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ডিএনএ সংগ্রহের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তারা বন্দিশালাকে যেমন ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ বলছে, তেমনি ডিএনএ সংগ্রহের বিষয়টিকে ‘স্বাস্থ্যপরীক্ষা’ নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
চীনে উইঘুরদের এমন নির্যাতন ও ডিএনএ সংগ্রহের উদ্দেশ্য হলো তাদের উপর নজরদারি চালানো এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত করে তোলা। ডিএনএর নমুনার মাধ্যমে একজন উইঘুর মুসলিমকে খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। ফলে উইঘুরদের পক্ষে আন্দোলন করা সম্ভব না। কেননা আন্দোলনে নামলে খুব সহজে সরকার তাকে চিহ্নিত করতে পারবে।
বর্তমানে চীনের সরকার উইঘুরদের উপর নির্যাতনের মাধ্যমে জোরপূর্বক নিজেদের সমর্থক বানানোর চেষ্টা করছে। আর এজন্য তাদের দলের স্লোগান থেকে শুরু করে সকল নিয়মকানুন কঠোরভাবে মানার জন্য আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতি দুই মাসে প্রতিটি উইঘুর পরিবারকে পাঁচদিন করে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের দাওয়াত করতে বাধ্য করা হচ্ছে। চীন সরকার একে বলছে ‘মেকিং ফ্যামিলি’। নির্যাতন শুধুমাত্র পূর্ণবয়স্কদের উপর হচ্ছে না। মানসিকভাবে শিশুদেরও নির্যাতন করা হচ্ছে। তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে কমিউনিস্ট পার্টির শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে শিশুদের মাতৃভাষার পরিবর্তে মান্দারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে।
ডিএনএ সংগ্রহে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা
চীনের উইঘুর মুসলিমদের ডিএনএ সংগ্রহে কারিগরি ও বিশেষজ্ঞ দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়ন চললেও এই বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো মতভেদ দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডিএনএ সংগ্রহের সকল যন্ত্রপাতি কেনার পাশাপাশি সেখানকার বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীও নিয়োগ দিয়েছে চীন সরকার। মূলত আমেরিকার দুইটি প্রতিষ্ঠান চীনকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এদের একটি হলো ম্যাসাচুসেটসের ‘থার্মো ফিশার’, আর অন্যটি হলো সান ডিয়েগোর ‘ইলুমিনা’।
চীন তাদের ডিএনএ গবেষণার কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে। সিসিআইডি কনসাল্টিং নামের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য মতে, চীনে ডিএনএ সামগ্রীর বাজার প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যেটা দ্বিগুণ হতে পারে। আর চীনের বিশাল এই বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করেছে থার্মো ফিশার ও ইলুমিনা।
ল্যাবের যন্ত্রপাতি, ডিএনএ পরীক্ষার কিট থেকে শুরু করে ডিএনএ ম্যাপিং প্রযুক্তি, সবই যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই কোম্পানি থেকে আমদানি করছে চীন। আর এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ আয় করছে থার্মো ফিশার ও ইলুমিনা। ২০১৭ সালে মোট ২০.৯ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করে থার্মোফিশার, যার ১০ ভাগই এসেছে চীন থেকে। তাদের প্রায় ৫,০০০ কর্মী বর্তমানে চীনে নিয়োজিত রয়েছে। যারা প্রত্যক্ষভাবে চীনকে সহায়তা করে যাচ্ছে। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে কিন্তু সেটা খুবই স্বল্প পরিসরে।
যুক্তরাষ্ট্রের যে সকল বিজ্ঞানী চীনের হয়ে কাজ করছেন তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে রয়েছেন ডা. কেনেথ কিড। ৭৭ বছর বয়সী এই বয়সী বিজ্ঞানী অধ্যাপনা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জেনেটিক প্রকৌশলে ডা. কিডের সুনাম বিশ্বজোড়া। ২০১০ সালে তাকে বিপুল সম্মানীরসহিত নিয়োগ দেয় চীন। তাকে চীনের ডিএনএ সংগ্রহের কাজে যুক্ত করেন ডা. লি কাইজিয়া। ডা. লি চীনের ইনস্টিটিউট ফর ফরেনসিক সায়েন্সের প্রধান ফরেনসিক কর্মকর্তা। তার আমন্ত্রণেই ডা. কিড চীনে যান। প্রথমে তিনি চীনের ডিএনএ সংগ্রহ প্রকল্পকে স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি চীন সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন।
তবে ডা. কিডই একমাত্র বিদেশী বিশেষজ্ঞ নন। তিনি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী চীনের উইঘুর মুসলিমদের ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরিতে সহায়তা করছেন। এদের মধ্যে টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ব্রুস বুডোলও আছেন। তবে ডা. কিড ও প্রফেসর ব্রুস এখন চীনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু চীন সরকারকে থামানোর মতো সক্ষমতা তাদের নেই। কেননা তারা যদি কাজ না করেন, অন্য কেউ অর্থের বিনিময়ে নিশ্চয়ই করবে। সেটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে চীন তাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞ দিয়ে উদ্দেশ্য সাধন করবে।