টেক কোম্পানি আর ক্যালিফোর্নিয়া যেন একে অপরের পরিপূরক। গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বের টেক কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র অধিপতি হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্য থেকে প্রচুর কোম্পানির জন্ম হয়েছে এবং তা বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বিস্তার করেছে। টেক বিশ্ব সম্পর্কে খবর রাখেন অথচ সিলিকন ভ্যালির নাম শোনেনি- এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সিলিকন ভ্যালি তথা সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়া ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেরই অংশ। অ্যাপল, গুগল, ফেসবুকসহ বিশ্বের অনেক বড় বড় স্টার্ট আপ ও টেক কোম্পানির জন্ম এই ক্যালিফোর্নিয়াতে। তাছাড়া বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানির সদর দপ্তরও ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত।
কিন্তু বড় বড় কোম্পানির স্বর্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া যেন তার মুকুট হারাতে চলেছে। গত কয়েক বছরে অনেক মার্কিন কোম্পানি তাদের সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সরিয়ে নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেন কোম্পানিগুলোর মধ্যে অঙ্গরাজ্যটি ছাড়ার হিরিক পড়েছে। আর এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে অধিকাংশেরই গন্তব্য টেক্সাস অঙ্গরাজ্য। টেক্সাসের কয়েকটি শহর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন টেকনোলজি হাবে পরিণত হচ্ছে। টেক্সাসের অস্টিন শহরের একটি জায়গায় অনেকগুলো টেক কোম্পানির কার্যালয় স্থানান্তরিত হওয়ায় সেই জায়গাকে ‘সিলিকন হিলস’ ডাকনাম দেওয়া হয়েছে। তবে সব কোম্পানি যে শুধুমাত্র টেক্সাসেই যাচ্ছে এমন নয়, কিছু কোম্পানি টেক্সাস ছাড়া আরো কয়েকটি রাজ্যেও স্থানান্তরিত হচ্ছে।
হিউলেট প্যাকার্ড এন্টারপ্রাইজ, যাকে আমরা এইচপি বলে জানি, সেটি বিশ্বের বৃহত্তম কম্পিউটার প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর একটি। টেক্সাসের হিউস্টনে এইচপির বৃহত্তম কর্মসংস্থান কেন্দ্র অবস্থিত। এইচপির জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিলিকন ভ্যালিতেই, এবং সেখানেই কোম্পানিটির বড় বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিন্তু, গত বছর কোম্পানিটি তাদের সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান হোসে থেকে টেক্সাসে সরানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করে।
ওরাকল হলো আরেকটি বড় কোম্পানি যেটি সম্প্রতি ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়েছে। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। ওরাকল ইতোমধ্যে তাদের সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়ার রেডউড সিটি থেকে টেক্সাসের অস্টিনে স্থানান্তর করেছে। এছাড়া কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান ল্যারি এলিসনও ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে হাওয়াইতে স্থানান্তরিত হয়েছেন। ওরাকলের প্রধান কার্যালয়ের স্থানান্তরের বিষয়ে কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র সিএনবিসিকে বলেন,
“আমরা বিশ্বাস করি যে এই স্থানান্তর কোম্পানির প্রবৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাবে এবং আমাদের কর্মীদের তারা কোথায় ও কীভাবে কাজ করতে চায় সে সম্পর্কে আরো নমনীয়তা প্রদান করবে।”
২০২০ সালে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম গাড়িনির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার প্রধান নির্বাহী এবং বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী এলন মাস্ক তার কোম্পানির সদর দপ্তর ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সরিয়ে টেক্সাস অথবা নেভাডায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। যেই কথা সেই কাজ। ২০২১ সালের ১ ডিসেম্বর টেসলা আনুষ্ঠানিকভাবে তার সদর দপ্তর টেক্সাসের অস্টিনে স্থানান্তরিত করে। টেক্সাসে কোম্পানিটির একটি গিগাফ্যাক্টরি তৈরির কাজও চলমান। এছাড়া আরো অনেক ছোট-বড় কোম্পানি ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে টেক্সাস পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু এভাবে বড় বড় কোম্পানিগুলো কেন তাদের দীর্ঘদিনের পীঠস্থান ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে দিচ্ছে?
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা এর অন্যতম প্রধান একটি কারণ। এই বিষয়টি বুঝতে হলে আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো বুঝতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার দেশ তা এর নাম থেকেই বোঝা যায়। দেশটির প্রত্যেকটি অঙ্গরাজ্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে, ফলে অনেক সময় এক রাজ্যের আইনের সঙ্গে অন্য রাজ্যের আইনের বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক রাজ্যের কর্পোরেট আইনের সঙ্গে অন্য রাজ্যের আইনের অনেক ব্যবধান রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলো যেসব রাজ্যে বেশি সুবিধা পাবে সেখানেই যাবে। এক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার আইনের তুলনায় টেক্সাসের আইন অনেকক্ষেত্রে কোম্পানিবান্ধব। ফলে বড় বড় কোম্পানিগুলো অধিক সুবিধার আশায় ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক্সাসে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া কোভিড-১৯ চলাকালে টেক্সাসের চেয়ে বেশি কঠোর ছিল। এ সময় ক্যালিফোর্নিয়া অনেক কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে, যা কোম্পানিগুলোকে ক্ষুব্ধ করে। করোনার প্রকোপ চলাকালীন ক্যালিফোর্নিয়ার ‘স্টে অ্যাট হোম’ আদেশের ফলে অনেক কোম্পানি অসন্তুষ্ট হয়। তারা রাজ্যটির কঠোর সিদ্ধান্তকে ব্যবসার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
করোনার ফলে কোম্পানিগুলো নতুনভাবে চিন্তা করতে শুরু করেছে। মূলত এসব বিধিনিষেধের জের ধরেই এলন মাস্ক ক্যালিফোর্নিয়া ছাড়ার হুমকি দিয়েছিলেন। বিপরীতে, টেক্সাসসহ আরো কয়েকটি রাজ্যে এই বিধিনিষেধ অনেক বেশি শিথিল ছিল। সেখানে মাস্ক পরার বাধ্যবাধকতাও ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানিগুলো সেখানেই যাবে যেখানে অধিক পরিমাণে স্বাধীনতা পাবে। টেক্সাসের ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ অনেক কোম্পানিকে সেখানে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। শেষপর্যন্ত এর জেরেই এলন মাস্ক টেসলার প্রধান কার্যালয় টেক্সাসে স্থানান্তর করেন।
ক্যালিফোর্নিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় কোম্পানি এবং লোকেদের রাজ্যটি ছেড়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি। ক্যালিফোর্নিয়ায় রিয়েল এস্টেট অস্বাভাবিকভাবে ব্যয়বহুল, ফলে এটি কর্মীদের জন্য দৈনন্দিন জীবন পরিচালনা এবং বাড়ি কেনার সামর্থ্যকে কঠিন করে তোলে। সেখানে বসবাস করতে গেলে দেখা যায় কর্মীদের বেতনের বড় একটা অংশ চলে যায় বাড়ি ভাড়ায়। বাড়ির দাম অনেক বেশি হওয়ায় বাড়ি কিনতেও হিমশিম খেতে হয়। উপরন্তু, সেখানে দামের তুলনায় বাড়ির আকারও বেশ ছোট। ক্রমেই চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকায় অদূর ভবিষ্যতে সিলিকন ভ্যালিতে পরিবারের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অস্টিন থেকে সান ফ্রান্সিসকোর জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেশি। এক গবেষণায় দেখা গেছে- সান ফ্রান্সিসকোতে অস্টিনের তুলনায় আবাসন খরচ ২৪২ শতাংশ বেশি, পরিবহন খরচ ৫২ শতাংশ বেশি, খাদ্য খরচ ৩৭ শতাংশ বেশি, বিনোদন খরচ ৩২ শতাংশ বেশি, এবং স্বাস্থ্যসেবা খরচ ২০ শতাংশ বেশি। ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর জন্য অনেকেই টেক্সাসের অস্টিনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে কোম্পানিগুলোকেও তার কর্মীদের তুলনামূলক বেশি বেতন দিতে হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে গেলে কোম্পানিগুলো এসব অসুবিধা এড়াতে পারবে। টেক্সাসসহ আরো কয়েকটি রাজ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় ও আবাসন খরচ তুলনামূলক কম হওয়ায় সেখানে কর্মীদের বেতন কম দিলেও তারা উন্নত জীবনযাপন করতে পারবে। কর্মীরা যখন কম খরচে একটি উন্নত পারিবারিক জীবন পরিচালনা করতে পারবে, তখন তারা কোম্পানির প্রতি আরো বেশি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবে।
টেক্সাসের করের হার ক্যালিফোর্নিয়া থেকে অনেক কম। সেখানে জনগণকে করের বোঝা অনেক কম বহন করতে হয়। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের তথ্য অনুযায়ী, টেক্সাস তাদের কর্মীদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে আয়কর সংগ্রহ করে না, অন্যদিকে ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আয়কর সংগ্রাহক রাজ্যগুলোর একটি। আয়করের পরিবর্তে টেক্সাস কর্পোরেট ট্যাক্স ও সেলস ট্যাক্স গ্রহণ করে। টেক্সাসের অধিকাংশ ট্যাক্স কিছু নির্দিষ্ট শিল্পের উপর ধার্য করা হয়। টেক্সাসে মাত্র ৬.২৫ শতাংশ বিক্রয় কর ধার্য করা হয়, যা অন্যান্য রাজ্য থেকে অনেক কম। এছাড়া কিছু খাবার ও ওষুধ বিক্রয় কর থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত।
ট্যাক্স ফাউন্ডেশনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি রাজ্যের মধ্যে টেক্সাস চতুর্থ নিম্ন কর সংগ্রাহক রাজ্য। টেক্সাস ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরও কর ধার্য করে না। টেক্সাস রাজ্য তাদের জনগণকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির কর থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। টেক্সাস শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সম্পত্তির উপর থেকে কর নেয়, তবে তা-ও অনেক কম। টেক্সাস সৌর বা বায়ুচালিত শক্তির যন্ত্রপাতির জন্য সম্পত্তি কর ছাড় দেয়, পাশাপাশি বিভিন্ন দাতব্য সংস্থার জন্যও বেশ কিছু ছাড় দেয়। বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্সে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্য থেকে অনেক বেশি সুবিধা দেয় টেক্সাস। এককথায়, টেক্সাসের কর ব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য রাজ্য থেকে তুলনামূলক সুবিধাজনক। ফলে বিভিন্ন কোম্পানি ও কর্মী টেক্সাসের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।
এছাড়া টেক্সাসে অনেক বেশি দক্ষ জনবল রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার যাতায়াত খরচ ও খাদ্যের খরচ অত্যন্ত বেশি। সেই তুলনায় টেক্সাসে এসবের খরচ তুলনামূলক অনেক কম। নিম্ন কর হার ও কম খরচে উন্নত জীবন নির্বাহের জন্য অনেক দক্ষ কর্মী টেক্সাসে যাচ্ছে। ফলে টেক্সাসে সুলভ শ্রমের বিনিময়ে দক্ষ কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে।
মূলত, এই কয়েকটি কারণেই ক্যালিফোর্নিয়া থেকে টেক কোম্পানিগুলো টেক্সাস ও অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যে স্থানান্তরিত হচ্ছে। সিলিকন ভ্যালি তথা ক্যালিফোর্নিয়া যে আর টেক কোম্পানির একচ্ছত্র অধিপতি থাকছে না তা বলাই বাহুল্য। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে টেক কোম্পানিগুলো ছড়িয়ে পড়ছে। এটি ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য দুঃসংবাদ হলেও অন্যান্য রাজ্যের জন্য বেশ ভাল একটি খবর।