ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। গত শুক্রবার অন্তত ১৭,০০০ (ভিন্ন দাবি অনুযায়ী ৩০,০০০) ফিলিস্তিনি শরণার্থী গাজা এবং ইসরায়েলের মধ্যবর্তী নিরাপত্তা বেষ্টনীর সামনে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তাদের সমাবেশ শুরুর আগেই ইসরায়েলি সেনাদের ট্যাঙ্কের গোলায় নিহত হয় গাজার এক সাধারণ কৃষক। আর সমাবেশ শুরুর পর দিনভর ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে এবং সেনাদের নিক্ষিপ্ত টিয়ার শেল ও রাবারে মোড়ানো স্টিল বুলেটে আহত হয় অন্তত ১,৪০০, নিহত হয় অন্তত ১৬ ফিলিস্তিনি।
কী ঘটছে গাজাতে?
#LandDay protests in Gaza:
• 17 Palestinians killed by Israeli army
• More than 1,400 others wounded
• Palestinian Authority declares today a day of national mourning https://t.co/h5GRWokoTs pic.twitter.com/9TXgye0qnf— Al Jazeera English (@AJEnglish) March 31, 2018
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা হচ্ছে মাত্র ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটারের একটি অবরুদ্ধ ভূমি, যেখানে প্রায় ২০ লাখ ফিলিস্তিনির বসবাস। এদের প্রায় ৭০ ভাগই ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় নিজেদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে অথবা পালিয়ে গাজায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন থেকেই তারা গাজার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। তাদের অনেকেরই ঘরবাড়ি সীমান্ত থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে, ইসরায়েলের দখলে। অনেকের কাছেই এখনও তাদের জমির এবং বাড়ির দালিলিক প্রমাণ আছে। কিন্তু জাতিসংঘের রেজল্যুশন থাকা সত্ত্বেও গত সাত দশক ধরে ইসরায়েল তাদেরকে নিজেদের ভিটেমাটিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
শুক্রবার হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শরণার্থী নিজেদের ভূমিতে ফেরত যাওয়ার দাবিতে অবরুদ্ধ গাজা এবং ইসরায়েলের সীমান্তে অবস্থিত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ নিরাপত্তা বেষ্টনীর সামনে ভিন্ন ভিন্ন পাঁচটি স্থানে সমাবেশ শুরু করে। ছেলেরা ফুটবল খেলার আয়োজন করে, মেয়েরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে গান গেয়ে সময় কাটাতে শুরু করে। আগামী ছয় সপ্তাহব্যাপী এ সমাবেশ এবং প্রতিবাদ অব্যাহত থাকার কথা আছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে মাসিরা আল-আউদা আল-কুবরা তথা ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন’।
প্রতিবাদ-সমাবেশের পরিকল্পনা ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ইসরায়েল আগে থেকেই শতাধিক স্নাইপার নিয়োগ করে। সমাবেশ শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগেই তাদের ট্যাংকের গোলায় নিজ ভূমিতে নিহত হয় ২৭ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি কৃষক। জুমার নামাজের পর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ এবং অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। অধিকাংশ প্রতিবাদকারী নিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে প্রায় ৭০০ মিটার দূরে স্থাপিত ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান করলেও অল্প বয়সী তরুণরা সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী তাদের উপর গুলি শুরু করে এই অজুহাতে যে, তাদের কয়েকজনের হাতে পাথর এবং পেট্রোল বোমা ছিল, যার ফলে নিরাপত্তা বেষ্টনীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল! অবশ্য বিভিন্ন ছবি এবং ভিডিওতে গুলিতে আহত এবং নিহত অধিকাংশ সদস্যকেই নিরস্ত্র দেখা গেছে।সমাবেশকারীদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার জন্য ইসরায়েল ট্যাংক এবং স্নাইপার নিয়োগ ছাড়াও ড্রোন থেকে টিয়ার শেলও নিক্ষেপ করে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, শুধুমাত্র শুক্রবারেই ১৬ জন নিহত এবং ১,৪১৬ জন আহত হয়েছে।
কারা আয়োজন করেছে এ কর্মসূচি?
VIDEO: Palestinian president Mahmud Abbas calls for “international protection” for Palestinian people after at least 16 protesters were killed by the Israeli army during a protest at the Gaza-Israel border pic.twitter.com/wYUQjgHZeU
— AFP news agency (@AFP) March 31, 2018
গত কয়েক মাস ধরেই গ্রেট মার্চ অফ রিটার্নের ধারণাটি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছিল। আন্দোলনটির মূল সংগঠন আহমেদ আবু আরতেমা নামের এক ফিলিস্তিনি। গাজার শরণার্থী শিবিরের প্রতিকূল পরিবেশে বেড়ে ওঠা আরতেমা যখন সীমান্তবর্তী এলাকায় ভ্রমণের সময় বেষ্টনীর অপর পাড়ে তাদের দখলকৃত ভূমির সৌন্দর্য অবলোকন করেন, তখনই তিনি প্রথম এ আন্দোলনের পরিকল্পনা করেন। তিনি শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্ববাসীর সামনে তাদের নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার প্রকাশ করার জন্যই গ্রেট মার্চ অফ রিটার্নের উদ্যোগ নেন।
গাজাকে বলা হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত কারাগার। এখানে বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলের অবরোধ বলবৎ আছে। এর অধিবাসীদের বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগও ইসরায়েলের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানকার শরণার্থীরা জাতিসংঘের সাহায্যের উপর নির্ভরশীল, যে সাহায্যের একটি বড় অংশ সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হ্রাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ সীমান্তের ওপারেই এই মানুষগুলোর শত শত বছরের মালিকানাধীন বিস্তীর্ণ এলাকা। সেখানে ফেরত যেতে পারলে তাদেরকে জাতিসংঘের সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকারও প্রয়োজন হবে না। এসব কারণেই গাজার অধিবাসীদের মধ্যে আরতেমার উদ্যোগ বেশ সাড়া ফেলে। ফিলিস্তিনের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক এবং সেবামূলক সংগঠন তাদের এ উদ্যোগকে সমর্থন জানায়।
এ মুহূর্তে কেন এ কর্মসূচি?
৩০ মার্চ তারিখটি ফিলিস্তিনিদের কাছে আগে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ভূমি দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয় ছয়জন আরব-ইসরায়েলি নাগরিক। এরপর থেকে প্রতি বছরই দিনটি ‘ল্যান্ড ডে’ তথা ভূমি দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতিবাদ কর্মসূচি ছয় সপ্তাহ জুড়ে চলার কথা, যেন তা শেষ হয় মে মাসের ১৫ তারিখে। এই তারিখটি ফিলিস্তিনের ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ। ১৯৪৮ সালের এই দিনে কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি থেকে ইসরায়েলিদের দ্বারা বিচ্যুত হয়। দিনটি ফিলিস্তিনিদের কাছে ‘নাকবা’ তথা বিপর্যয় দিবস হিসেবে পরিচিত। এ বছর দিবসটির ৭০তম বার্ষিকী পালিত হবে।
এই কর্মসূচি কতটুকু যৌক্তিক?
১৯৪৮ সালের ১১ ডিসেম্বর, আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের শেষ দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ রেজল্যুশন ১৯৪ পাশ করে। এতে বলা হয়, যেসব শরণার্থী তাদের নিজেদের বাড়িতে ফিরতে চায় এবং প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে চায়, তাদেরকে যত শীঘ্র সম্ভব ফেরার অনুমতি দিতে হবে। যাদের সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যারা তাদের আবাসভূমিতে ফিরতে ইচ্ছুক না, তাদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রস্তাবও রাখা হয় ঐ রেজোল্যুশনের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে।
অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের বর্তমান ইসরায়েল রাষ্ট্রের সীমানায় অবস্থিত তাদের জমি এবং বাড়িঘরে ফিরতে চাওয়া সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত। কিন্তু জাতিসংঘের পরিষ্কার দিক নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও গত সাত দশক ধরে ইসরায়েল তা মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে।
কে কী বলছে?
Gaza video shows protester shot while running away from border https://t.co/kDOkMg5Xo0
— Haaretz.com (@haaretzcom) March 31, 2018
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, তারা সীমান্তবর্তী এলাকাকে ‘মিলিটারি জোন’ বা সামরিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। তারা সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে এবং জানিয়েছে, সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলেই তারা গুলি চালাবে। বাস্তবে অবশ্য সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা ছাড়াই তাদের গুলিতে ১৭ জন নিহত এবং ১,৪০০ আহত হয়েছে।
কর্মসূচির প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে এবং তা ইসরায়েলের ভিত্তি নড়িয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়া। তার মতে, এর মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের তাদের আবাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার রাস্তার প্রথম ইট স্থাপিত হয়েছে।
জাতিসংঘের ডেপুটি পলিটিকাল অ্যাফেয়ার চিফ ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে, কেবলমাত্র সর্বশেষ পন্থা হিসেবেই প্রাণনাশী অস্ত্র প্রয়োগ করা যেতে পারে, এবং সেক্ষেত্রেও আহত-নিহতদের ব্যাপারে পরবর্তীতে তদন্ত করতে হবে। কুয়েতের অনুরোধে ইতিমধ্যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। তবে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বৈঠক শুরুর আগে গতকালের ঘটনার স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে?
গতকাল শুক্রবারের ঘটনার পর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ শনিবারকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদিন গাজা ছাড়াও পশ্চিম তীর, জেরুজালেম সহ সমগ্র ফিলিস্তিনে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সীমিত আকারে হলেও গতকাল পশ্চিম তীরসহ ফিলিস্তিনের অন্যান্য এলাকাতেও প্রতিবাদ-সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর আর্রাবাতেও কয়েক হাজার মানুষ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ইসরায়েলি সংসদ নিসেটের একাধিক আরব এমপি, স্থানীয় পৌরসভাগুলোর প্রধান এবং ধর্মীয় নেতারাও ছিলেন।
শুক্রবারের এ ঘটনায় আহত-নিহতের সংখ্যা ২০১৪ সালের পর থেকে সর্বাধিক। জাতিসংঘ যদি হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আগামী ছয় সপ্তাহে এ সংঘর্ষ চরম আকার ধারণ করতে পারে। গত চার বছর ধরে গাজা অবরুদ্ধ থাকলেও তুলনামূলকভাবে যে শান্তিময় অবস্থা ছিল, এর মধ্য দিয়ে তার অবসান ঘটতে পারে। জাতিসংঘের ডেপুটি পলিটিকাল অ্যাফেয়ার চিফও আগামী দিনগুলোতে সংকট ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন।
নতুন করে শুরু হওয়া এ সংকটের মধ্য দিয়ে আগামী দেড় মাস জুড়ে হয়তো ঝরে পড়বে কয়েকশ তাজা প্রাণ। হয়তো পঙ্গুত্ব বরণ করবে আরো কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি যুবক। এরপরেও যদি অন্তত কিছুটা হলেও ইসরায়েলের উপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে, তবে সেটাই হবে তাদের অর্জন। এছাড়া গাজার অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনীদের হয়তো আর তেমন কিছুই করার নেই।
Featured Image Source: JACK GUEZ/ AFP