ইরাকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটেছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদি শনিবার আইএসের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের এই ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে আইএসের দখলে যাওয়ার দীর্ঘ তিন বছর পর অবশেষে এই ঘোষণাটি এলো।
বাগদাদে এক সংবাদ সম্মেলনে ইরাকের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমাদের বাহিনী ইরাক-সিরিয়া সীমান্তের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং আমি দায়েশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সমাপ্তির ঘোষণা দিচ্ছি।” তিনি আরো বলেন, “সম্মানিত ইরাকিগণ, আপনাদের ভূমিকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। মুক্তির স্বপ্ন এখন বাস্তবতা।”
শনিবার সকালেই ইরাকি সেনাবাহিনীর সিনিয়র মিলিটারি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আব্দুল আমির রাশিদ ইয়ারাল্লাহ ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরাক আইএস মুক্ত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, “ইরাকের সম্পূর্ণ ভূমি দায়েশ সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে এবং আমাদের বাহিনী এখন ইরাক-সিরিয়ার আন্তর্জাতিক সীমানা পরিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।”
তার এ ঘোষণার পর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে আইএসের বিরুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করেন। মার্কিন সামরিক জোট, যারা এই যুদ্ধে ইরাকি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করছিল, তারাও এক টুইটে ইরাকের জনগণকে অভিনন্দন জানায়।
চলুন সংক্ষেপে জেনে নেই আইএস (আইসিস, আইসিল, দায়েশ নামেও পরিচিত) কীভাবে ইরাকে পরাজিত হলো।
- সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের বিশৃঙ্খলার সুযোগে সাবেক ‘আল-কায়েদা ইন ইরাক’ এবং পরবর্তীতে ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক’ এর চরমপন্থী একটি অংশ ২০১৪ সালে ‘ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া’ নাম দিয়ে তথাকথিত খিলাফত ঘোষণা করে এবং ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল দখল করে নেয়। একপর্যায়ে তারা মসুল, রামাদি, ফাল্লুজা প্রভৃতি শহর সহ ইরাকের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।
- মাত্র ছয় মাস আগেও ইরাক এবং সিরিয়ার বিস্তৃত অঞ্চল আইএসের নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর থেকেই ইরাক ও সিরিয়া, উভয় দেশের সরকারি বাহিনী, ইরান সমর্থিত শিয়া আধা সামরিক বাহিনী, যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পৃথক পৃথক বিমান আক্রমণে সব দিক থেকে ধীরে ধীরে আইএস পরাজিত হতে থাকে।
- গত সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত এবং কুর্দি নেতৃত্বাধীন আরব-কুর্দি জোটের হাতে আইএসের তথাকথিত রাজধানী সিরিয়ার রাক্কা শহরের পতন ঘটে।
- তার আগে গত জুলাই মাসে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত ইরাকি সেনাবাহিনী এবং ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়াদের হাতে ইরাকে আইএসের প্রধান ঘাঁটি মসুলের পতন ঘটেছিল।
- নভেম্বরের শুরুতে সিরিয়াতে আইএসের অন্যতম শক্তিশালী ঘাঁটি দির আজ-জুরের পতন ঘটে রাশিয়া এবং ইরান সমর্থিত সিরিয়ান আরব আর্মির হাতে।
- মাত্র দু’দিন আগেই রাশিয়ান সেনাবাহিনী, যারা সিরিয়াতে বাশার সরকারের পক্ষে যুদ্ধ করছে, তারা সিরিয়াকে সম্পূর্ণ আইএস মুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছিল।
- বড় বড় শহরগুলো মুক্ত করার পর গত নভেম্বর মাসে ইরাকি বাহিনী আইএসের হাত থেকে সীমান্ত সংলগ্ন সর্বশেষ শহর আল কাইম এবং রাওয়া মুক্ত করে। এরপর গত কয়েকদিন ধরে সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলোতে আইএসের ছোট ছোট দলগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার পর অবশেষে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হলো।
- ধারণা করা হচ্ছে, আইএসের অধিকাংশ জীবিত সদস্য ইরাক-সিরিয়ার সীমান্ত দিয়ে মরুময় এলাকাগুলোতে অথবা তুরস্কের সীমান্ত দিয়ে ছদ্মবেশে অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছে। আশঙ্কা আছে, ইরাক এবং সিরিয়াতে মূল বাহিনীর পরাজয়ের পর জঙ্গি সংগঠনটি এখন গেরিলা যুদ্ধ এবং চোরাগোপ্তা আক্রমণের কৌশলে ফিরে যেতে পারে।
- প্রধানমন্ত্রী আবাদি বলেছেন, ইরাক দায়েশের বিরুদ্ধে জয় ‘পরবর্তী ধাপে’ উপনীত হয়েছে এবং তাদেরকে পরবর্তী আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
- জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আইএসের কারণে ইরাকে এখনও প্রায় ৩২ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় আছে।
- গত মাসে এক ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী আবাদি জানিয়েছিলেন, আইএস বিরোধী যুদ্ধে ইরাকের এ পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়েছে।
ফিচার ইমেজ: BBC