২০১৪ সালের ১৭ জুলাই নেদারল্যান্ডসের রাজধানী আমস্টারডাম থেকে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যাওয়ার পথে ইউক্রেনের আকাশে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর বোয়িং ৭৭৭ বিমানটি একটি মিসাইলের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। নিহত হয় এর ২৮৩ জন যাত্রী এবং ১৫ জন ক্রুর সকলে। দীর্ঘ চার বছরের তদন্ত শেষে গত বৃহস্পতিবার ডাচ নেতৃত্বাধীন তদন্ত কমিটি ঐ মিসাইল আক্রমণের পেছনে সরাসরি রাশিয়াকে দায়ী করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছে নেদারল্যান্ডস এবং অস্ট্রেলিয়ার সরকারও। ঐ হামলা এবং তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা ভিন্ন একটি লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, রাশিয়ার পক্ষে এ হামলা করার যৌক্তিকতা কতটুকু? আর যে তদন্ত কমিটি এ তদন্ত করেছে, তারাই বা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য? এসব বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের বিশ্লেষণ।
তদন্ত কীভাবে এগিয়েছে?
ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর নিহত যাত্রীদের মধ্যে ১৯৩ জন ছিলেন ডাচ নাগরিক, ৪৩ জন মালয়েশিয়ান এবং ২৭ জন অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক। আর বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রাশিয়া সীমান্ত থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে, বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায়। কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো বিমান দুর্ঘটনা যে দেশে সংঘটিত হয়, তাদের উপরই এর তদন্তের দায় বর্তায়। তবে তারা ইচ্ছে করলে অন্য কোনো রাষ্ট্রের উপর এর তদন্তের দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে। প্লেনটি ইউক্রেনে বিধ্বস্ত হওয়ায় তদন্তের দায়িত্ব ইউক্রেনের উপর বর্তালেও নেদারল্যান্ডসের ১৯৩ জন যাত্রী নিহত হওয়ায় ইউক্রেন তদন্তের দায়িত্ব নেদারল্যান্ডসের উপর অর্পণ করে।
Factfile on the Malaysia Airlines MH17 disaster, which was shot down by a Russian-made BUK missile, according to the Dutch Safety Board pic.twitter.com/B9xVlXJKXZ
— AFP news agency (@AFP) May 27, 2018
দুইটি ভিন্ন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। একটি ছিল দুর্ঘটনার কারিগরি কারণ অনুসন্ধান করার উদ্দেশ্যে, যার দায়িত্বে ছিল ডাচ সেফটি বোর্ড (DSB)। অন্যটি ছিল অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে, যার দায়িত্বে ছিল ডাচদের নেতৃত্বাধীন জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম (JIT)। এই টিমে ডাচরা ছাড়াও অন্তর্ভুক্ত ছিল অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, মালয়েশিয়া এবং ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ডাচ সেফটি বোর্ড তাদের তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করে। তদন্তের ফলাফল অনুযায়ী, প্লেনটি কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে বিধ্বস্ত হয়নি, বরং এটি বাক (BUK) মিসাইলের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল।
পরবর্তীতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম তাদের তদন্তের আংশিক ফলাফল প্রকাশ করে। তারা জানায়, তারা নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, বাক মিসাইল সিস্টেমটি রাশিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে ইউক্রেন সীমান্তের অভ্যন্তরে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত ভূমি থেকে মিসাইলটি নিক্ষেপ করার পর সিস্টেমটি আবার রাশিয়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তদন্ত কমিটি প্লেনটির গতিবেগ, অবস্থান এবং বিধ্বস্ত হওয়ার ধরনের উপর ভিত্তি করে মিসাইলের গতিপথের বিভিন্ন সিমুলেশন তৈরি করে এবং এটি উৎক্ষেপনের স্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। মিসাইলটি প্লেনটিকে ঠিক কীভাবে আঘাত করেছিল, তারা সেটার একটি অ্যানিমেশনও প্রকাশ করে।
সাম্প্রতিক তদন্ত রিপোর্টে কী আছে?
গত বৃহস্পতিবার জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম তাদের পূর্বের ফলাফল আবারও নিশ্চিত করে। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দ্য হেগের একটি সংবাদ সম্মেলনে তারা কিছু ছবি, ভিডিও, স্যাটেলাইট ইমেজ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যের বরাত দিয়ে দাবি করে, মিসাইল সিস্টেমটি রাশিয়ার কোথা থেকে কোন পথ দিয়ে কীভাবে ইউক্রেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেটিও তারা নিশ্চিত করতে পেরেছে। তাদের দাবি অনুযায়ী, মিসাইল সিস্টেমটি আনা হয়েছিল রাশিয়ার কার্স্কে অবস্থিত ৫৩ তম অ্যান্টি এয়ারক্রাফট ব্রিগেড থেকে। এবং আনা নেওয়ার সাথে জড়িত সকলেই ছিল রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনীর নিয়মিত সদস্য।
জয়েন্ট ইনভেস্টিগেশন টিম অবশ্য এই হামলার সাথে সরাসরি কোন কোন কর্মকর্তারা জড়িত, তাদের নাম প্রকাশ করেনি। ২০১৬ সালে তারা প্রায় ১০০ জন সম্ভাব্য সন্দেহভাজনের তালিকা তৈরি করেছিল বলে জানিয়েছিল। বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে সেই সংখ্যা কমে কয়েক ডজনে এসে নেমেছে বলে জানানো হয়। কমিটির প্রধান তদন্তকারী কর্মকর্তা ফ্রেড ওয়েস্টারবেক দাবি করেছেন, তাদের কাছে আরো কিছু প্রমাণ আছে, যা তারা এখনই প্রকাশ করছেন না। সেগুলো তারা আদালতে উপস্থাপন করার জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছেন।
রাশিয়া অবশ্য তদন্ত কমিটির ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে। তদন্ত কমিটিতে রাশিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকার অজুহাত দেখিয়ে তারা দাবি করেছে, এর ফলাফল মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না। তারা একে রাশিয়ান গুপ্তচর সের্গেই স্ক্রিপালের উপর বিষ প্রয়োগের ঘটনার সাথে তুলনা করেছে, যেখানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। এই ঘটনায় রাশিয়ার সম্পৃক্ততা অস্বীকার অবশ্য এটাই প্রথম না। ঘটনার পর থেকেই রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলোতে ইউক্রেনকে অভিযুক্ত করা, প্লেনের ভেতরে সাজানো লাশ স্থাপন করাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করা হয়েছিল, যেগুলোর কোনোটিরই পরে কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
রাশিয়া কি জড়িত থাকতে পারে?
The Dutch team investigating #MH17 concluded today that the Buk system came from Russia’s 53rd Antiaircraft Missile Brigade. Here’s their reconstruction of the shoot-down from last year. https://t.co/4Wz5xKWDi6 pic.twitter.com/uXe96eSeGJ
— RFE/RL (@RFERL) May 24, 2018
এখন কথা হচ্ছে, এই হামলার পেছনে কি আসলেই রাশিয়ার সম্পৃক্ততা থাকতে পারে? নাকি রাশিয়া যেরকম দাবি করছে, এটি রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির জন্য ইউক্রেইন এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের ষড়যন্ত্র? একথা অনস্বীকার্য, অনেক সময়ই বিভিন্ন রাষ্ট্র কোনো প্রমাণ ছাড়াই অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করার বা সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার অভিযোগ করে। আমাদের পূর্ববর্তী একটি বিশ্লেষণে রাশিয়ান স্পাই সের্গেই স্ক্রিপালের উপর বিষ প্রয়োগের ঘটনায়ও আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, কীভাবে ব্রিটেন এবং তার মিত্ররা বিন্দুমাত্র প্রমাণ ছাড়াই রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে রাশিয়ার কূটনীতিকদেরকে বহিষ্কার করে একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা সৃষ্টি করেছিল।
কিন্তু এবারের ঘটনাটি সেরকম না-ও হতে পারে। কেননা, সের্গেই স্ক্রিপালের ঘটনায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। অথচ তখন ব্রিটেনের গোয়েন্দা বিভাগও নিশ্চিতভাবে রাশিয়াকে দায়ী করে কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি বা কোনো বিবৃতি দেয়নি। অন্যদিকে ফ্লাইট এমএইচ১৭ এর ক্ষেত্রে একাধিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি দীর্ঘদিনের তদন্ত শেষে পরিস্কারভাবে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। এতগুলো রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা সবাই মিলে একটি মিথ্যা দাবি করবে- এটি অসম্ভব না হলেও এর সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে কম।
রাশিয়া কেন হামলা করে থাকতে পারে?
Bellingcat exposed a GRU operative involved with the downing of #MH17, but we’re not done yet. Read what we’ve found so far here: https://t.co/kSaBYdQ8EX pic.twitter.com/KamV3OUMw3
— Eliot Higgins (@EliotHiggins) May 28, 2018
যে প্রশ্নটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, মালয়েশিয়ার যাত্রীবাহী বিমান বিধ্বস্ত করে ২৯৯ জন বেসামরিক জনগণকে হত্যা করে রাশিয়ার কী লাভ? রাশিয়া যদি এই হামলা করেও থাকে, খুব সম্ভবত তারা তা ইচ্ছাকৃতভাবে করেনি। তারা সম্ভবত এটিকে ইউক্রেনের সামরিক বিমান মনে করেই মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল। উল্লেখ্য, এই ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পূর্বে একই এলাকায় রাশিয়াপন্থী বিদ্রোহীরা ইউক্রেনের একাধিক সামরিক বিমান বিধ্বস্ত করেছিল। এমনকি, এমএইচ১৭ বিধ্বস্ত হওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে কিছু কিছু রাশিয়ান সংবাদ মাধ্যম সেটিকে ইউক্রেনের সামরিক বিমান বলেও দাবি করেছিল। সেকারণে এমনও হতে পারে যে, এটি ছিল রাশিয়ার একটি অনিচ্ছাকৃত ভুল, যে ভুল স্বীকার করা এখন আর তাদের পক্ষে সম্ভব না।
Featured Image Source: Pierre Crom/Getty Images