বাংলাদেশী সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক প্রশ্নের উত্তরে স্বভাবতই সন্দেহাতীতভাবেই চলে আসবে হুমায়ূন আহমেদের নাম। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি, হুমায়ূন আহমেদের জীবদ্দশায় কিছু পরিমাণে ও তার মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে ব্যাপক আকারে ব্যক্তি হুমায়ূনকে নিয়ে অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হলেও, সাহিত্যিক হুমায়ূন বা হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কোনো কাজ বলতে গেলে হয়নি। তাই মোহাম্মদ আজম এই উদ্যোগের জন্য সাধুবাদ প্রাপ্য।
মোহাম্মদ আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। তিনি বেশ স্পষ্টবাদী, এবং তার বিষয় সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখেন। এছাড়া তার বিভিন্ন বক্তব্য ও লেকচার যারা অনুসরণ করেন, তারা মানবেন যে তিনি একজন সুবক্তাও বটে। মোহাম্মদ আজম হুমায়ূন আহমেদের প্রতি কোনো পূর্বনির্ধারিত অনুমান বা পক্ষপাতিত্ব অবলম্বন করেননি- এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
‘হুমায়ূন আহমেদ: পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য’ বইটি প্রথমা প্রকাশনী থেকে ২০২০ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহৃত হয়েছে মাসুক হেলালের আঁকা হুমায়ূন আহমেদের পোর্ট্রেট। বাংলাদেশের যে গুটিকতক প্রকাশনী বছরের পর বছর ধরে বইয়ের প্রকাশনায় একটি ন্যূনতম মান বজায় রেখেছে, প্রথমা তাদের মধ্যে অন্যতম। এই বইও ব্যতিক্রম নয়। বইয়ের বাঁধাই, ছাপা, কাগজের মান থেকে প্রুফ-রিডিং সব ক্ষেত্রেই যত্নের ছাপ স্পষ্ট।
সাহিত্য সমালোচনা, বিশেষত একদম একাডেমিক নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্য সমালোচনা পড়া সবসময়ই জটিল। তবে মোহাম্মদ আজমের সাবলীল গদ্যরীতির কারণে এই বই পড়তে একদমই বেগ পেতে হয় না। বইয়ের কয়েকটি অধ্যায়ে হুমায়ূন আহমেদের লেখার বিভিন্ন দিক গভীরভাবে বিশ্লেষিত হয়েছে।
কেন হুমায়ূন আহমেদ?
প্রথম অধ্যায়ই বইয়ের সংক্ষিপ্ততম অধ্যায়। এই অধ্যায়ে লেখক কেন হুমায়ূন আহমেদ পাঠ ও তা নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী আলোচনা হওয়া প্রয়োজন— সেটা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই অধ্যায়ে লেখক হুমায়ূন আহমেদকে যে ‘সিরিয়াস’ সাহিত্য আলোচনায় অগ্রহণযোগ্য ভাবা হয়, তার উপরও আলোকপাত করেছেন। পাঠকমহলে তুমুল জনপ্রিয়তা, ভাষার সহজিয়া রীতি, ও লেখালেখির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই দেদারসে লিখে যাওয়া বুদ্ধিজীবী মহলে হুমায়ূন আহমেদের অগ্রহণযোগ্যতার কারণ। অপরদিকে মোহাম্মদ আজমকে হুমায়ূন আহমেদের লেখার এই দিকগুলোই বেশি আকৃষ্ট করেছে।
হুমায়ূন-পাঠের সমস্যা
কথাসাহিত্যের দিকপালদের মধ্যে বেশিরভাগেরই কাজের সংখ্যা কম। অপরদিকে হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখির তালিকা বিশাল। অনেকের কাছেই তিনি ছিলেন ‘বাজারে লেখক’ এবং মোহাম্মদ আজমের কাছেও এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদ যে বাজার মাথায় রেখেই লিখতেন, এবং পাঠকদের, প্রকাশকদের চাহিদা তাকে প্রভাবিত করতো এটাও তিনি বলেছেন। এবং, এই জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদকে পাশ কাটিয়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে খুঁজে বের করা ও পাঠ করাই হুমায়ূন পাঠের প্রধান সমস্যা হিসেবে তিনি অভিহিত করেছেন। একাডেমিক সাহিত্য আলোচনার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদ তো বটেই, কোনো জনপ্রিয় লেখকই তাদের পাঠকপ্রিয়তার দায় এড়াতে পারেন না। এই অধ্যায়ে ‘আমার আছে জল’ উপন্যাসটি নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। সে আলোচনায় উপন্যাসটির সেটিং, চরিত্র বিশ্লেষণ, স্থান ও সময়ের চমকপ্রদ ব্যবহার ও সর্বোপরি মূল ‘অ্যাক্ট’ সংঘটিত করার জন্য হুমায়ূন আহমেদ যে অনুষঙ্গগুলো ব্যবহার করেছেন সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
‘আমার আছে জল’ নিয়ে লেখা এই আলোচনাটি পড়লে পাঠকের কাছে উপন্যাসটির অনেক দিক নতুন আঙ্গিকে ধরা দেবে— এটা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আপাতদৃষ্টে সরল, ছোট একটি উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে সবকিছু সামলিয়ে দ্রুত ও অনিবার্যভাবে চূড়ান্ত ঘটনার দিকে এগিয়েছেন, বলতে গেলে পাঠকের অজান্তেই, তা আসলেই চমকপ্রদ, এবং হুমায়ূন আহমেদ পাঠের প্রধান সমস্যাও এটাই বলে অভিহিত করেছেন মোহাম্মদ আজম। তার ভাষায়, “হুমায়ূন আহমেদের গুরুত্বপূর্ণ ও সিরিয়াস রচনাও নির্দ্বিধায় পঠিত হতে পারে স্রেফ কাহিনী হিসেবেই। নিপুণ কাহিনিকার হিসেবে তিনি কাহিনির অনুসরণে কোনো বাধা তো তৈরি করেনই না, বরং কাহিনি অনুসরণ করে এগিয়ে যেতে প্রলুদ্ধ করেন।”
জনপ্রিয় হুমায়ূন
সন্দেহাতীতভাবেই হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। এবং শুধু পাঠকগোষ্ঠী নয়, বাংলা নাটক নির্মাণের মাধ্যমে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। তার এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার পেছনে অনেকে তার লেখকসত্ত্বার চেয়ে নাট্যকার সত্ত্বাকেই বেশি দায়ী মনে করেছেন। তবে এই বইয়ে মোহাম্মদ আজম শুধু লেখক হুমায়ূনেই সীমাবদ্ধ থেকেছেন। বইয়ের এই অধ্যায়ে লেখক হুমায়ূন আহমেদের এরূপ জনপ্রিয়তার কারণ উদঘাটন করেছেন নানাদিক বিশ্লেষণ করে, তবে সব ছাপিয়ে তিনি বলেছেন, হুমায়ূনের রচনাশৈলী, ভাষার সারল্য, সূক্ষ্ম হিউমার মূলত তার লেখার ধরনে যে একটি প্রবল ‘হুমায়ূনীয় ধারা’ উপস্থিত— সেটিই তার পাঠককে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।
এই অধ্যায়ে হুমায়ূন আহমেদের ‘নি’ উপন্যাস বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যদিও ছোট এই উপন্যাসকে আমরা সায়েন্স ফিকশন হিসেবেই জানি, তবে হুমায়ূন আহমেন নিজে চেয়েছিলেন এটি যেন ফ্যান্টাসি হিসেবেই বিচার করা হয়। এছাড়াও এই অধ্যায়ে হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট দুই চরিত্র ‘হিমু’ ও ‘মিসির আলী’কে নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
কথাশিল্পী হুমায়ূন
এই অধ্যায়ে মোহাম্মদ আজম, হুমায়ূন আহমেদের তিনটি উপন্যাস ‘গৌরীপুর জংশন’, ‘প্রিয়তমেষু’ ও ‘এই বসন্তে’ বিশ্লেষণ করে কথাসাহিত্যিক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের সার্থকতা ও তার লেখার বিভিন্ন দিকের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। গৌরীপুর জংশন নিয়ে বিশ্লেষণ করে লেখক আমাদের দেখিয়েছেন হুমায়ূন কীভাবে যেকোনো চরিত্রের সাথে মিশে গিয়ে, কোনো পক্ষপাতিত্ব না দেখিয়ে আশ্চর্য রকম নিরাসক্ত থেকে গল্প বলে গিয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের সর্বাধিক জনপ্রিয় রচনার তালিকা করলে ‘প্রিয়তমেষু’ হয়তো সেই তালিকায় জায়গা পাবে না। কিন্তু বিল্ড-আপ, চরিত্রায়ন ও সর্বোপরি এর প্লটের জন্যই এই উপন্যাসিকা হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এই উপন্যাসটি কীভাবে মূল ঘটনা সাবলীলভাবে আড়াল করে, শুধু বার বার সাব-টেক্সটে সেই সম্পর্কে আভাষ দিয়ে, একদম শেষে পর্দা তুলে পাঠককে বিস্মিত করতে হয়— তার লাগসই উদাহরণ। হুমায়ূন আহমেদ মূল প্লটকে ঘটার সুযোগ করে দিতে প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনা খুবই বিশ্বাসযোগ্যভাবে গড়ে তুলেছেন। এত ছোট পরিসরেই হুমায়ূন ধর্ষণ, সম্পর্কের টানাপোড়েন, ন্যায়ের লড়াই সবকিছু তুলে ধরেছেন এবং প্রতিটিকে ভালোভাবে গুরুত্ব দিয়েই। এছাড়াও উঠে এসেছে ধর্ষণের যদি বিচার হয়েও তাহলেও সেটা আসলেই যে ভুক্তভোগী তার প্রতি ন্যায্য হয় কিনা এমন জটিল আলাপও। এসেছে জঘন্য অপরাধ করার পরেও মানুষ কীভাবে সকল সংকোচবোধ এড়িয়ে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বেশ ভালোভাবেই টিকে থাকে সেই কথাও।
আবার এর উল্টো দিক সম্পর্কেও বলা হয়েছে। কীভাবে পারিবারিক, সামাজিক এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও নিখাদ ভালোমানুষ বলে পরিচিত একজন এই কাজ করতে পারে। এমনকি করার পরেও তার সেই ইমেজ বজায় থাকে। হুমায়ূন আহমেদ এত জটিল সব আলাপ সেরে ফেলেছেন মাত্র ৮৫ পৃষ্ঠাতেই! হুমায়ূন আহমেদের লেখকসত্ত্বা ও কথাশিল্পী হিসেবে তার নিপুণতার পরিচয় পেতে চাইলে এই বইটি একটি অবশ্যপাঠ্য। এই বই সম্পর্কে মোহাম্মদ আজম বলেছেন, “নিশাতের আচরণে অবশ্য কিছু সংকোচ আবিষ্কার করা যেতে পারে। তবে তা শেষ অনুচ্ছেদ পড়ার আগে নয়। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যা নাই। এবং সমস্যা না থাকাটাই এ উপন্যাসের সমস্যাকে একটা অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেছে।” সম্ভবত এই দুই লাইন দ্বারা প্রিয়তমেষু উপন্যাসের মূলভাবের প্রায় পুরোটাই প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে।
‘এই বসন্তে’ উপন্যাস বিশ্লেষণ করে মোহাম্মদ আজম দেখিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ কীভাবে আশির দশকের একটি মফস্বল থানা শহর ও তার বাসিন্দাদের ফুটিয়ে তুলেছেন। মানবচরিত্র বিশ্লেষণ ও তার বহুমুখী উপস্থাপনের সেরা কাজটি সম্ভব হুমায়ূন এই উপন্যাসেই করেছেন।
হুমায়ূনের ভাষা
মোহাম্মদ আজম এই অধ্যায় শুরু করেছেন এভাবে, “হুমায়ূন আহমেদের সারল্য যে একই সঙ্গে গভীরও, বলা ভালো, সরল বলেই গভীর, সে কথাটা খুব একটা বলা হয়নি।” হুমায়ূন আহমেদের ভাষার সারল্যই তাকে খুব সহজে সাধারণ পাঠকগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা এনে দিয়েছিল। আবার ওই সারল্যের জন্যই তার বেশিরভাগ লেখা তরল ও গভীরতাহীন বলে আখ্যা পেয়েছে। হুমায়ূন ভাষা নিয়ে খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেননি। প্রথম থেকেই তার যে সহজাত লেখার ধরন, সেটা তিনি ধরে রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তার এই সরল ধারা অনেকে অনুকরণ করতে চাইলেও প্রত্যেকেই শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন; এ থেকেই বোঝা যায় তার ব্যবহৃত ভাষা সরল হলেও সেটা প্রচণ্ড ‘হুমায়ূনীয়’। এই অধ্যায়ে লেখক দেখিয়েছেন, হুমায়ূন কীভাবে অত্যন্ত সহজ ভাষায় লিখেও লেখার গভীরতা অর্জনে সক্ষম হয়েছেন। এই অধ্যায়ে ‘পাপ’ ছোটগল্পটি ব্যবহার করে হুমায়ূনের ভাষার বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
হুমায়ূন ও মুক্তিযুদ্ধ
এই অধ্যায়ে ‘১৯৭১’ উপন্যাস ও ‘শীত’ ছোটগল্প বিশ্লেষণ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হুমায়ূনের কাজ ও ‘অ্যাপ্রোচ’ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে হুমায়ূন প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ওই যুদ্ধ পরিস্থিতির সাথে মানুষ কীভাবে সহাবস্থান করেছে তার তুল্যচিত্র। হুমায়ূন এমন সব প্লট বেছে নিয়েছেন যেগুলো সংঘটিত হবার জন্য যুদ্ধ পরিস্থিতি অনিবার্য ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন মানুষের মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক অবস্থান, পারিবারিক অবস্থান; অর্থাৎ যুদ্ধকে আবর্তন করে কীভাবে তখন মানুষ জীবনযাপন করেছিল সেটিই হুমায়ুনের লেখার মূল উপজীব্য।
হুমায়ূনের মাওলানারা
হিমু, মিসির আলীর মতো চরিত্রগুলো ছাড়াও হুমায়ূন আরো কিছু নির্দিষ্ট চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন যেগুলো তার লেখায় বার বার ঘুরে ফিরে আসত। যেমন, স্নেহময় বাবা, মাওলানা, প্রেমপূর্ণ নারী প্রমুখ। হুমায়ূনের বাবাদের হৃদয় সর্বদাই স্নেহে পরিপূর্ণ, কখনো তা প্রকাশ পায়, বেশিরভাগ সময়েই পায় না। তবে, আলাদা করে বলতে হয় হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট মাওলানা চরিত্রগুলোর কথা। মাওলানা শ্রেণিগোষ্ঠী সার্বিকভাবে আমাদের সমাজে খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা কখনোই পায়নি। যদিও ধর্মীয় কারণে তারা সমীহের দাবিদার, তবুও সামগ্রিকভাবে সমাজে তাদের অবস্থান সেই চিরন্তনকাল থেকেও দোদুল্যমান। কিন্তু আমাদের আশেপাশের মাওলানাদের চেয়ে হুমায়ূন আহমেদের মাওলানারা অনেকাংশেই আলাদা, তারা বড় বেশি ‘এম্প্যাথেটিক’। এই অধ্যায়ে বিভিন্ন রচনায় হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট মাওলানা চরিত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
ভাটিবাংলার হুমায়ূন
মূলত শহুরে মধ্যবিত্তকেন্দ্রিক লেখক হলেও হুমায়ূন আহমেদের গ্রামনির্ভর, বিশেষত ভাটি অঞ্চলনির্ভর রচনা নেহাত কম নয়। গ্রামের পরিবেশ, রাজনীতি, ক্ষমতার বলয় সেখানকার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে হুমায়ূনের ‘অ্যাপ্রোচ’ লেখক এই অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করেছেন।
বইয়ের শেষাংশে তিনটি সংযুক্তি আছে, যেখানে মোহাম্মদ আজম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও হুমায়ূন আহমেদের ‘নীল মানুষ’ উপন্যাস দুটির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন; তার চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন ও হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্যে নারীমূর্তি ও সংসার চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ লেখাই প্লটনির্ভর নয়, চরিত্রনির্ভর। অবশ্যম্ভাবীভাবে তার বড় একটি অংশ হলো নারী। তবে হুমায়ূন আহমেদের নারীরা বড় বেশি ‘নারী’, অর্থাৎ তাদের নারীভাব এতই প্রবল যে— বেশিরভাগ সময় তা তাদের মানুষ্যত্বকেই খর্ব করে দেয়। এটা হুমায়ূন আহমেদের একটি বড় ব্যর্থতা যে তিনি নারী চরিত্রের শুধু কমনীয় ও প্রেমপূর্ণ দিক নিয়েই কাজ করেছেন। হুমায়ূনের নারী মাত্রই অন্তর্মুখী। যদিও হুমায়ূনের সৃষ্ট কাঠামো ওভাবে আক্ষরিক অর্থে পুরুষতন্ত্র নয়, তবুও নারীর অবস্থান ওই কাঠামোর ভেতরেই তিনি রেখেছেন। এর বাইরেও আরো যে নারীসত্ত্বা থাকতে পারে, সেগুলো নিয়ে কাজ করেননি। এবং একইসাথে তিনি তার নারীচরিত্রগুলোকে সকল পংকিলতা থেকে মুক্ত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। এমনকি তার দেহপসারিণীরাও আক্ষরিক অর্থে দেহজীবী নয়, তাদের কাঠামোও ওই মধ্যবিত্ত ঘরানারই। হুমায়ূন আহমেদের রচনায় নারী পুরোপুরি পারিবারিক, এর বাইরে তার আর কোনো অস্তিত্বই নেই। যেটি মূলত আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন। এদিক দিয়ে বলা যেতে পারে মধ্যবিত্তরা অর্থাৎ, প্রধানত পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো নারীর যে অবস্থান চায়, হুমায়ূন সেই অবস্থান তুলে ধরতে শতভাগ সফল।
সাহিত্য সমালোচনা পুরো পৃথিবীতে, এবং ওপার বাংলাতেও ব্যাপক সমাদৃত হলেও, আমাদের দেশে এর অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে। তবে সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্যই আরো অনেক একাডেমিক, নিরীক্ষাধর্মী কাজ হওয়া প্রয়োজন। প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের তো বটেই, বর্তমানের সাহিত্যিকদের কাজকর্ম নিয়েও আলোচনাধর্মী কাজ করা অত্যাবশ্যক। মোহাম্মদ আজমকে ধন্যবাদ এমন কাজ করার জন্য, তার পাশাপাশি অন্যদের কাজ থেকেও এরূপ নিরীক্ষাধর্মী আরো লেখার প্রত্যাশা থাকল।