জার্মান রাইখের অন্তর্ভুক্ত ২৬টি প্রদেশ। পূর্বে এর চারটি ছিল রাজ্য, ছয়টি গ্র্যান্ড ডাচি, পাঁচটি ডাচি, সাতটি প্রিন্সিপ্যালিটি, তিনটি ফ্রি সিটি বা মুক্ত শহর আর ফ্রান্সের থেকে ছিনিয়ে নেয়া অ্যালসাসে এবং লরেইন।
ফরাসি সংসদের চুক্তি অনুমোদনের পর উইলিয়াম ফিরে যান বার্লিন। সেখানে ২১ মার্চ রাইখস্ট্যাগে এই চুক্তি পাশ হল, ছোট্ট একটি দল শুধু চুক্তিতে অ্যালসাসে আর লরেইন জার্মানিতে অন্তর্ভুক্তির বিপক্ষে ভোট দেয়। এই দলের নাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি। ২ সেপ্টেম্বর, সেডানে ফরাসিদের আত্মসমর্পণের দিনকে জার্মানির জাতীয় দিবস ঘোষণা দেয়া হয়।
১০ মে ফ্রাঙ্কফুর্টে ফ্রান্স এবং জার্মানির চুক্তি চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হয়। ১৭ মে ফরাসি সংসদ চূড়ান্ত চুক্তিতে তাদের সম্মতি দিলে ২১ মে দুই পক্ষের ভেতর স্বাক্ষরিত চুক্তির কপি চালাচালি হলো। সব মিলিয়ে এই যুদ্ধে জার্মানি হারায় ২৮,২০৮ জন সেনা, আহতের সংখ্যা ছিল ৮৮,৪৮৮। সঠিক তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় ফরাসিদের মৃত ও আহত সৈন্য ছিল তিন লাখের মতো। যুদ্ধপন পরিশোধ করাকালীন ফ্রান্সে কিছু জার্মান সেনা থেকে গেলেও ১৮৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এই সময়ের ভেতরেই ফ্রান্স পুরো অর্থ জার্মান কোষাগারে জমা দেয়।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৭০ বছরের ভেতরেই প্রুশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হলো জার্মান রাইখ। হলি রোমান এম্পায়ারকে ধরা হতো প্রথম রাইখ, সেই হিসেবে একীভূত এই জার্মানি ছিল সেকেন্ড রাইখ। এই ধারাবাহিকতায় নাৎসিরা তাদের সময়কে বলত থার্ড রাইখ। তবে এ কথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে অটো ভন বিসমার্ক প্রুশিয়ার হাল না ধরলে এত দ্রুততার সাথে জার্মান একত্রীকরণ সম্ভব হতো না। তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে তিনি যেভাবে পরপর তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে প্রুশিয়ার অধীনে জার্মানিকে একত্র করেন তা আজও বিশেষজ্ঞদের অবাক করে। একীভূত জার্মান রাষ্ট্রেও তিনি ছিলেন প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী চ্যান্সেলর। তার পরিণতির সাথে প্রুশিয়ার পরিণতিও অনেকটা একসূত্রে গাঁথা।
পররাষ্ট্রনীতি
জার্মান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরে বিসমার্কের কাজ ছিল সন্দিহান ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে বোঝানো যে জার্মানি ইউরোপের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে চায়। তার জানা ছিল সমৃদ্ধ এবং টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে দরকার একটি স্থিতিশীল মহাদেশ, ফলে মধ্য ইউরোপের প্রধান শক্তি হিসেবে জার্মানিকেই এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যুদ্ধবিগ্রহ করে ভূখণ্ড দখলের প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
বিসমার্ক জার্মান শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী, তবে তার কাছে এর প্রতিফলন হবে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। ঠিক এ কারণেই তিনি নীতি নির্ধারণে সামরিক বাহিনীর লাগাম টেনে রাখতেন। উঁচুপদের সেনা অফিসারদের বড় অংশই সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জার্মান তাকত দেখাতে আগ্রহী। সীমান্ত সম্প্রসারণ তাদের ধ্যানজ্ঞান। তাদের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে বিসমার্ক ইউরোপিয়ান পরাশক্তিগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে থাকেন। তার উদ্দেশ্যই ছিল শান্তি বজায় রেখে জার্মান রাষ্ট্রের উন্নতি। অনেক কষ্টের পর যখন অন্যান্য দেশকে তিনি জার্মানির শান্তিপূর্ণ নীতি বিশ্বাস করাতে যখন সমর্থ হন, এরপরই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বিসমার্ক-পরবর্তী জার্মানি ঝুঁকে পড়ে আগ্রাসী নীতির দিকে।
ফরাসিদের আত্মসমর্পণের পর বিসমার্ক তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে করে রাখতে চাইছিলেন, যাতে তারা জার্মানির প্রতি হুমকি না হতে পারে। অস্ট্রিয়া ততদিনে পরিণত হয়েছে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যে। তারাও নতুন করে জার্মানির সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ইচ্ছুক। ফলে ফ্রান্স মিত্র সন্ধান করতে পারে রাশিয়ার দিকে। তাদের সুযোগ না দিতে ১৮৭৩ সালের অক্টোবরে জার্মান, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আর রাশিয়ান সম্রাটের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হলো ‘থ্রি এম্পেররস লীগ’। তবে বিসমার্ক জানতেন, দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অস্ট্রো-হাঙ্গেরি আর রাশিয়ান সাম্রাজ্যকে নিয়ে গড়া লীগের আয়ু খুব সাময়িক। ফলে ১৮৭৯ সালে তিনি আলাদা করে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ানদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন (ডুয়াল অ্যালায়েন্স)। এই চুক্তি টিকেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবধি।
বলকান অঞ্চলে বুলগেরিয়া নিয়ে উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ১৮৮৫ সালে ভেঙে যায় থ্রি এম্পেররস লীগ। বিসমার্কের কুশলতায় রাশিয়া তারপরেও জার্মানির সাথে রিইনস্যুরেন্স চুক্তি করে ১৮৮৭ সালে। কিন্তু ক্রমেই রাশিয়া আর অস্ট্রো-হাঙ্গেরির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে চলা শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। ফলে বিসমার্কের উত্তরসূরী ক্যাপিরিভি ১৮৯০ সালে চুক্তি নবায়ন থেকে বিরত থাকেন। এই সুযোগে ফ্রান্স রাশিয়াকে জোটে টেনে নেয়। ১৭ আগস্ট ১৮৯২ সালে প্রথমে গঠিত হয় ফ্রেঞ্চ-রাশিয়ান সামরিক জোট, যা দুই বছর পর অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতায় প্রসারিত হয়।
ফ্রান্স-রাশিয়ার জোট গঠনের সম্ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানি ১৮৯০ সালেই ঝুঁকে পড়েছিল রাশিয়ানদের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী অটোমানদের দিকে। জার্মানির উপস্থিতিতে ইংল্যান্ড বসফরাস থেকে নিজের নজর সরিয়ে নেয় তার উপনিবেশগুলোর দিকে। তারা রাশিয়ার দিকেও বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পক্ষগুলো এর মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যায়।
অভ্যন্তরীণ অবস্থা
পররাষ্ট্র বিষয়ে বিসমার্ক যতটা সফল, অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে ততটা নন। প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থা তিনি কখনোই পুরোপুরি গ্রহণ করতে পারেননি। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন এমন একটি সিস্টেম, যেখানে রাজতন্ত্র এবং অভিজাততন্ত্রের প্রাধান্য থাকবে। রাজনীতির মাঠে তিনি প্রয়োজন অনুযায়ী মিত্র পরিবর্তন করতেন, ভিন্নমত গ্রহণে বিসমার্ক ছিলেন অত্যন্ত অনিচ্ছুক। তার কাছে তিনি যা মনে করতেন সেটাই ঠিক ছিল।
রাজনীতির মাঠে প্রথমে বিসমার্ক ন্যাশনাল লিবারেলদের সাথে জোট বাঁধলেও দ্রুতই লিবারেল নীতির ব্যর্থতা পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মধ্যে অর্থনীতি প্রতিকূল অবস্থায় পড়লে জার্মানি হয়ে ওঠে আমদানিনির্ভর। ফলে দেশীয় পণ্য উৎপাদনকারীরা সরকারি সুরক্ষা দাবি করতে থাকে। ১৮৭৫ সালের দিকে বিসমার্ক এদেরকে দলে টানার কথা ভাবছিলেন। কর ব্যবস্থা নিয়ে সংস্কারের চিন্তাও তার মাথায় ঘুরছিল। একই সময় তার মোকাবেলা করতে হচ্ছিল সেন্টার পার্টিকে। এরা ছিল ক্যাথলিক সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধি। বিসমার্ক সন্দেহ করতেন সেন্টার পার্টি বহিঃশক্তির মদদে কাইজারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
সেন্টার পার্টি ১৮৭০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রশাসনের সাথে প্রায়ই দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছিল। তাদের জনসমর্থন বাড়ছিল হু হু করে এবং ১৮৭৪ সালের নির্বাচনে তারা পপুলার ভোটের শতকরা ২৮ ভাগ পেয়ে যায়। সেন্টার পার্টি ক্যাথলিক চার্চের স্বাধীনতা এবং অধিক সাংবিধানিক অধিকারের দাবিতে সংসদের সব বিরোধী পক্ষকে এক করে ফেলে। সেন্টার পার্টির অবয়বে চার্চের সাথে রাষ্ট্রের এই দ্বন্দ্ব জার্মানিতে পরিচিত ছিল কুল্টারক্যাম্পফ (Kulturkampf/ Cultural Struggle) নামে। চার্চ আর রাষ্ট্রের আলাদা করা নিয়েই মূলত এখানে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, যেখানে রক্ষণশীলরা মনে মনে সেন্টার পার্টিকে সমর্থন করে। অন্যদিকে বিসমার্ক আর লিবারেলরা একে আধুনিকতার বিরুদ্ধে প্রাচীনপন্থীদের আক্রমণ গণ্য করলেন।
ক্যাথলিক চার্চের সাথে বিতণ্ডার ফলে ভ্যাটিকানের সাথে এই সময় জার্মানির কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। তবে পোপ নবম পায়াস মারা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হলো। তার স্থলাভিষিক্ত ত্রয়োদশ লিও ছিলেন তুলনামূলকভাবে উদারপন্থী। তার সাথে ১৮৭০ সালের সেপ্টেম্বরে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে প্রুশিয়ান আইন পরিবর্তনের করে ক্যাথলিকদের সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হলো। ১৮৮২ সালে ভ্যাটিকানের সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয়। সংকট আপাতত কেটে গেল।
কিন্তু এর মাঝেই মাথাচাড়া দিচ্ছিল নতুন সমস্যা, সমাজতন্ত্র। বিসমার্ক সমাজতন্ত্রীদের দেখতেই পারতেন না। রাষ্ট্রীয় আইন কানুন তাই তিনি সেভাবেই সাজিয়েছিলেন। ওদিকে শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রী চিন্তাচেতনা দ্রুত জনপ্রিয় হচ্ছিল। ১৮৭৫ সালে ২২ মে দুটি প্রধান সমাজতন্ত্রী দল একত্র হয়ে গঠন করল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি (এসডিপি)। রাইখস্ট্যাগেও এরা আসন অধিকার করে। এদের দমাতে বিসমার্ক ফন্দি আঁটছিলেন।
১৮৭৮ সালের মে’র ১১ তারিখ কাইজার উইলিয়ামকে হত্যার চেষ্টা করা হলে সমাজবাদীদের দিকে আঙুল তুলে বিসমার্ক এসডিপি’কে নিষিদ্ধ করতে আইন পাসের ডাক দেন। রক্ষণশীলরা তার পক্ষে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তারা পিছিয়ে যায়। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় চেষ্টায় উইলিয়াম আহত হলে বিসমার্ক রাইখস্ট্যাগ ভেঙে নতুন করে নির্বাচন দেন। তার আশা ছিল এসডিপি খারাপভাবে হারবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল বার্লিনসহ বড় বড় শহরগুলোর প্রশাসনিক পদে তারা শক্তিশালী হয়েছে। রাইখস্ট্যাগেও তারা খারাপ ফল করেনি। এই নির্বাচনে রক্ষণশীলদেরও লাভ হলো, তবে ভরাডুবি হল লিবারেলদের। অক্টোবরের ১৯ তারিখ নতুন রাইখস্ট্যাগে বিসমার্কের প্রস্তাবিত আইনের একটি নমনীয় সংস্করণ পাস হয়, যেখানে সরকারকে সমাজতন্ত্রী প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করার ক্ষমতা দেয়া হলো। এই আইন উল্টো এসডিপি-কে আরো ঐক্যবদ্ধ করে।
বিসমার্কের পতন
১৮৮৮ সালে ৯ মার্চ নব্বই বছর বয়সে বার্লিনে মারা যান প্রথম উইলিয়াম। তার জায়গা নেন ছেলে তৃতীয় ফ্রেডেরিক। ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া আর ফ্রান্সের বিপক্ষে তিন যুদ্ধে নিজের জাত চেনান তিনি। তবে সেসব ছিল দেশের প্রতি দায়িত্বের খাতিরে। ব্যক্তিগতভাবে ফ্রেডেরিক যুদ্ধবিগ্রহ পছন্দ করতেন না। সবার কাছে সুশাসক এবং ভাল মানুষ বলে তার সুনাম ছিল। তিনি যদি জার্মানির সম্রাট হিসেবে দীর্ঘদিন থাকতেন তাহলে হয়তো ইউরোপের ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন, এবং সিংহাসনে বসার তিন মাসের মাথায় তার মৃত্যু হলে ছেলে ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক দ্বিতীয় উইলিয়াম অভিষিক্ত হন।
বিসমার্ক কস্মিনকালেও আশা করেননি দ্বিতীয় উইলিয়ামের সিংহাসন গ্রহণ পর্যন্ত তিনি জীবিত থাকবেন। তার কাছে এই রাজা একেবারেই অচেনা। উচ্চাভিলাষী দ্বিতীয় উইলিয়াম সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মত, তিনি হঠকারী এবং অনেক সময়েই আবেগের তাড়নায় চালিত হতেন। দ্বিতীয় উইলিয়াম পরবর্তীতে প্রচুর বেফাঁস কথাবার্তার জন্যও কুখ্যাতি অর্জন করেন। তার সদগুন যে ছিল না তা নয়, কিন্তু শক্তিশালী জার্মান সাম্রাজ্যের স্বপ্নে তিনি বিসমার্কের স্থিতিশীল ইউরোপের নীতি থেকে সরে সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। বিসমার্কের সাথে জার্মানির ভবিষ্যৎ রাস্তা নিয়ে তার মতবিরোধ ছিল প্রকাশ্য।
শ্রমিকদের বিষয় নিয়েও কাইজারের সাথে বিসমার্কের বিবাদ শুরু হয়। তৎকালীন ইউরোপে শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ ছিল জঘন্য। কাজের পরিবেশ ভাল করা এবং বেতন-ভাতার দাবিতে উইলিয়াম শ্রমিকদের পক্ষ নেন। বিসমার্কের বিপরীতে গিয়ে তিনি শ্রমিক আইন পরিবর্তনের কথা তোলেন। আকারে-ইঙ্গিতে প্রায়ই তিনি বিসমার্ককে বুঝিয়ে দিতে থাকেন তার অবসর নেবার সময় হয়েছে।
সত্তরোর্ধ্ব বিসমার্ক নিজেকে অপরিহার্য প্রমাণ করতে নতুন চাল দেন। ১৮৯০ সালের ১৫ জানুয়ারি বিসমার্কের করা সমাজবাদবিরোধী আইন নবায়নে রাইখস্ট্যাগ অস্বীকৃতি জানায়। এরপর তার যোগসাজশে সেই বছরের নির্বাচনে উইলিয়াম সমর্থিত সরকারি কোয়ালিশন, যা কার্টেল নামে পরিচিত ছিল তার পতন ঘটে। কার্টেলের সদস্য ছিল লিবারেল এবং উদারপন্থী রক্ষণশীল গোষ্ঠী। বিপরীতে এসডিপি, সেন্টার পার্টি আর গোঁড়া রক্ষণশীলরা বড় জয় পেয়ে গেল। সেন্টার পার্টির জয়ে লিবারেলরা শঙ্কিত হয়ে পড়ে এই ভেবে যে এবার চার্চ রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। ওদিকে এসডিপি’র উত্থানে রক্ষণশীলরা অলিতে-গলিতে শ্রমিক বিপ্লবের ছায়া দেখতে শুরু করল।
উইলিয়ামের কানে খবর পৌঁছল যে বিসমার্ক সেন্টার পার্টির প্রধান উইন্ডথর্স্টের সাথে গোপনে সাক্ষাৎ করেছেন। ক্রোধান্বিত উইলিয়াম ধরে নিলেন তাকে কোণঠাসা করতেই চ্যান্সেলরের এই খেলা। ১৮৯০ সালের ১৫ মার্চ তিনি বিসমার্ককে সকাল নয়টার সময় বিছানা থেকে টেনে নিয়ে এলেন। সরাসরি সেন্টার পার্টির সাথে তার হাত মেলানোর অভিযোগ তুলে তিনি চ্যান্সেলরকে আদেশ দেন ১৮৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর করা এক আইন বাতিল করতে। সেই আইনে বলা ছিল রাজার কাছে কোনো মন্ত্রী কিছু উপস্থাপন করতে চাইলে চ্যান্সেলরকে সেটা দেখিয়ে নিয়ে আসতে হবে। উইলিয়াম পররাষ্ট্রনীতি, বিশেষ করে রাশিয়া নিয়ে বিসমার্ক রাখঢাক করছেন বলেও দাবি করেন। বিসমার্ক জোর গলায় নিজের নির্দোষিতা ঘোষণা করলেও উইলিয়ামের মন ছিল স্থির করা। বিসমার্ক ১৮৫২ সালের আইন প্রত্যাহারে অসম্মতি জানানো মাত্রই তাকে তিনি পদত্যাগের নির্দেশ দেন। বিসমার্কের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। ১৮৯০ সালের ১৮ মার্চ তিনি কাইজারের কাছে পদত্যাগ পত্র দাখিল করেন, এবং ২০ মার্চ তা গৃহীত হয়।
বিসমার্কের পদত্যাগে প্রাথমিকভাবে জনগণের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে তার প্রতি জনতার সহানুভূতি তৈরি হয়, দেশবিদেশের প্রচুর মান্যগণ্য লোক তার সাথে দেখা করতে আসতেন। বিসমার্ক এই সুযোগে দ্বিতীয় উইলিয়ামের নামে বিষোদগার করতেন। তিনি রাইখস্ট্যাগেও একবার নির্বাচিত হন, কিন্তু এসডিপি প্রার্থীর সাথে ভোটের ব্যবধান এত কম ছিল যে লজ্জায় আর ক্ষোভে তিনি তার আসন কখনোই গ্রহণ করেননি। অবসরের সময় তিনি ছয় খণ্ডে নিজের জীবনী লেখায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে তা প্রকাশ আরম্ভ হয় বিসমার্কের মৃত্যুর পর। বিসমার্কের লেখায় বহু ঘটনাই তিনি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বর্ণনা করেছেন নিজের কৃতিত্ব জাহির করবার জন্যে।
উইলিয়াম পরে বিসমার্কের সাথে মিটমাট করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৯৪ সালের জানুয়ারিতে অসুস্থ বিসমার্ককে তিনি দেখতে যান। বিসমার্ক তাকে সামরিক কর্মকর্তাদের সাথে বেশি ঘেঁষাঘেঁষির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিলেও উইলিয়াম কান দেননি। পরবর্তীতে বিসমার্ক নিজে সম্রাটের সাথে এসে দেখা করেন। ২৭ নভেম্বর স্ত্রী জোয়ানার মৃত্যুর পর মানসিক ও শারীরিক দুই দিক থেকেই বিসমার্ক ভেঙে পড়েন। তার দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের এবং জোয়ানাকে তিনি আসলেই অনেক ভালবাসতেন। ফলে তার মৃত্যু তাকে আঘাত করেছিল কঠিনভাবে। উইলিয়াম শয্যাশায়ী বিসমার্ককে দেখতে এলেন ডিসেম্বর মাসে। জেনার লড়াইতে নেপোলিয়নের কাছে প্রুশিয়ার ধ্বংসের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তার প্রতি জীবনের শেষ হুঁশিয়ারি উচ্চারন করলেন বিসমার্ক,
জেনা এসেছিল ফ্রেডেরিক দ্য গ্রেটের মৃত্যুর বিশ বছরের মাথায়। আপনি যদি সতর্ক না হন তাহলে আমার মৃত্যুর বিশ বছরের মধ্যে আরেকটি দুর্যোগ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
১৮৯৮ সালের ৩০ জুলাই মারা যান অটো ভন বিসমার্ক। দ্বিতীয় উইলিয়ামের প্রতি ক্ষোভ থেকে বিসমার্কের সমাধিফলকে লেখা ছিল, “জার্মান কাইজার প্রথম উইলিয়ামের একজন বিশ্বস্ত সেবক”।
দ্বিতীয় উইলিয়ামের প্রতি বিসমার্কের করা ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। ১৯১৪ সালে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দকে হত্যার সূত্র ধরে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সম্প্রসারণবাদী জার্মান জেনারেলদের উস্কানি আর নিজের হঠকারিতায় উইলিয়াম জার্মানিকে টেনে নিয়ে যান কেন্দ্রীয় শক্তির পক্ষে এই রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে। পরাজিত কেন্দ্রীয় শক্তি ২৮ জুন ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে লড়াইয়ের অবসান টানতে বাধ্য হয়। পতন হলো হনজোলার্ন রাজবংশের, শেষ হয়ে যায় জার্মান রাজতন্ত্র। নতুন করে জন্ম নেয় পোল্যান্ড, যাদের কাছে চলে যায় প্রুশিয়ার একাংশ। স্লেশউইগ-হোলস্টেইন প্রশ্নে ১৯২০ সালে অনুষ্ঠিত হয় গণভোট। ড্যানিশ অধ্যুষিত এলাকাগুলো রায় দেয় ডেনমার্কের অংশ হবার পক্ষে, জার্মান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো রয়ে যায় জার্মানিতেই। ফ্রান্স ফিরিয়ে নেয় তাদের বহু কাঙ্ক্ষিত অ্যালসাসে এবং লরেইন।
দ্বিতীয় উইলিয়াম পালিয়ে আশ্রয় নেন নেদারল্যান্ডসে। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে জয়ী শক্তিগুলো তাকে বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানায়। তবে এই আহ্বান ছিল পুরোটাই দায়সারা। ব্রিটিশরা গোপনে ডাচদের জানিয়ে দেয়- কোনো রাজাকে আটক করে আদালতে তোলা খারাপ দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে, কাজেই উইলিয়াম যেখানে আছেন থাকুন।
উইলিয়াম নেদারল্যান্ডসেই আবাস পেতে বসলেন। সেখান থেকে দেখলেন জার্মানিতে ওয়েইমার রিপাবলিকের উত্থান, এবং পরবর্তীতে নাৎসি দল তথা হিটলারের ক্ষমতাগ্রহণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে ১৯৪১ সালের ৪ জুন তিনি মারা যান। পূর্বের মতো এবারও বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় হয়।
প্রুশিয়া ছিল জার্মানির সবচেয়ে শক্তিশালী প্রদেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী মিত্রশক্তি চাইল প্রুশিয়াকে এবার একেবারে নির্মূল করে দিতে। বার্লিনসহ সামান্য কিছু শহর জার্মানিতে রেখে এর অনেক এলাকা সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে যায়। যুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পোল্যান্ড আবারও প্রুশিয়ার কিছু অঞ্চল লাভ করে, সেই পোল্যান্ড, যাদের এককালে অস্ট্রো-রাশিয়ান-প্রুশিয়ান জোট খুবলে খেয়েছিল। জার্মানি তথা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এবার চিরতরে মুছে গেল প্রুশিয়ার নাম।