তীব্র শীত, দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি আর ছড়িয়ে পড়া রোগের প্রেক্ষিতে ১৯ জানুয়ারি শেষবারের মতো ন্যাশনাল গার্ড প্যারিসের পশ্চিম দিক দিয়ে অবরোধ ভেদ করতে অভিযান চালায়। আগের মতোই এবারো তাদের হামলা ব্যর্থ হয়। ওদিকে সবদিক থেকে প্যারিসের দিকে আসতে চেষ্টা করা বাহিনীগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে ট্রশো প্যারিসের সামরিক গভর্নরের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন জেনারেল ভিনয়। পরিস্থিতির সুযোগে ন্যাশনাল গার্ডের উগ্রপন্থী অংশগুলো সক্রিয় হয়ে উঠছিল। তাদের ভাবনা ফরাসি বিপ্লবের মতো করে ক্ষমতা দখল এবং বিপ্লবী কাউন্সিল বা কমিউন গঠন। ১৮৭১ এর ২২ জানুয়ারি তারা সরকারি ভবনে গুলি ছুঁড়ে সহিংসতা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়।
২৩ তারিখ ফ্যাভ্রের কাছে খবর এলো- শহরে আর মাত্র দুদিনের রুটি অবশিষ্ট আছে। তিনি বিসমার্কের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলেন। ২৭ জানুয়ারি রাতে অবশেষে বিসমার্কের শর্তেই প্রাথমিকভাবে ১২ দিনের জন্য অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়।
১৮ জানুয়ারি প্যারিসে এবং ৩১ জানুয়ারি থেকে পুরো ফ্রান্সে এই বিরতি কার্যকর হলো। মেয়াদ ছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি অবধি, এর মধ্যে ফ্রান্সে নির্বাচন করতে হবে। ১৯ তারিখের মাঝে মীমাংসা না হলে যেকোনো পক্ষই আবার লড়াই শুরু করতে পারবে।
অস্ত্রবিরতির শর্তমতে প্যারিসের সমস্ত দুর্গ ফ্রান্স প্রুশিয়ার হাওলা করে দিল। তারা ২০০ মিলিয়ন ফ্রাঁ যুদ্ধপন দিতেও রাজি হয়। তাদের এক ডিভিশন বাদে বাকি সব সেনা অস্ত্র নামিয়ে রাখে। তবে ন্যাশনাল গার্ড সশস্ত্র থেকে যায়। বিসমার্ক অঙ্গীকার করলেন প্রুশিয়ানরা প্যারিস অধিকার করবে না। যুদ্ধের শেষ গোলা ফরাসি কামান থেকে ছোঁড়ার ব্যাপারেও ফ্যাভ্রের দাবি তিনি মেনে নেন।
৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বিসমার্ক জানতেন, বৈধ সরকারের সাথে দর কষাকষি ব্যতিরেকে ফ্রান্সের সাথে কোনো চুক্তিই আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য হবে না, তাই তিনি নির্বাচনের প্রস্তাব চুক্তিতে জুড়ে দিয়েছিলেন। ট্রশোর সরকার ইউরোপের চোখে বৈধ সরকার নয়। টেকসই সমাধানের আগে দরকার নির্বাচিত সরকার।
ফরাসি নির্বাচনের পর বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ থিয়ের্স সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন। ভার্সাইয়ে শুরু হলো বিসমার্ক আর থিয়ের্সের আলাপ আলোচনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিকভাবে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলো, যেখানে ফ্রান্স স্ট্র্যাসবুর্গ, অ্যালসাসে, মেটসজসহ উত্তর লরেইনের দাবি ছেড়ে দেয়, সম্মত হয় যুদ্ধপন হিসেবে সব মিলিয়ে ৫ বিলিয়ন ফ্রাঁ (প্রায় ১০০০ মিলিয়ন ডলার) দিতে। এক বছরের মধ্যে এক বিলিয়ন পরিশোধ করা হবে, বাকিটা তিন বছরের কিস্তিতে। যতদিন জরিমানা শোধ না হচ্ছে ততদিন পূর্ব ফ্রান্সে ৫০,০০০ জার্মান সেনা থেকে যাবে। তবে দুই বিলিয়ন ফ্রাঁ দিয়ে দেবার পর তাদের পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নেয়া শুরু হবে। এই চুক্তি চূড়ান্তভাবে সই হতে হতে আরো তিন মাস লেগে গিয়েছিল। তবে এর মধ্যেই প্রুশিয়ানরা প্যারিসে যাতায়াত উন্মুক্ত করে দেয়। বাইরে থেকে পাঠানো প্রচুর খাদ্যসামগ্রীও শহরে প্রবেশ করল।
সিদ্ধান্ত হলো ফরাসি সংসদ চুক্তি অনুমোদনের আগপর্যন্ত প্যারিসে ৩০,০০০ জার্মান সেনা মোতায়েন থাকবে। ৩রা মার্চের ভেতরে যদি অনুমোদন না আসে তাহলে তিন দিনের নোটিশে লড়াই শুরু করা যাবে। তবে তার আর প্রয়োজন হলো না। পয়লা মার্চেই ৫৪৬-১০৭ ভোটের বিপরীতে চুক্তি পাস হয়ে গেল। বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ভিক্টর হুগো তখন ফরাসি সাংসদ, তিনি চুক্তির বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। এদিকে বিজয়ের উপলক্ষ হিসেবে ৩০,০০০ জার্মান সেনা উইলিয়ামের সামনে দিয়ে প্যারেড করে যায়। ৩রা মার্চ এরপর দখলদার বাহিনী প্যারিস ত্যাগ করে।
ন্যাশনাল গার্ডের গোলযোগ
উগ্রপন্থী ন্যাশনাল গার্ডের উপদলগুলো চরমভাবে শান্তিচুক্তির বিপক্ষে ছিল। ২৫ ফেব্রুয়ারি তারা ২০০ কামান নিয়ে চলে যায় প্যারিসের মন্তমার্ট পাহাড়ের উপর, গড়ে তোলে শক্ত ঘাঁটি। সেখানে তারা এক বিপ্লবী কাউন্সিল বানাল। বিপ্লবের চিহ্ন হিসেবে তারা প্রদর্শন করে লাল পতাকা। তাদের দমাতে ১৮ মার্চ ১৫,০০০ ফরাসি সেনা, যারা তখনও সশস্ত্র ছিল, তাদের পাঠানো হয়। কিন্তু এরা নির্দেশ পালনে অস্বীকার করে। বিশৃঙ্খলার মধ্যেই উত্তেজিত একদল সশস্ত্র জনতা সৈন্যদের কম্যান্ডার জেনারেল ক্লড-মার্টিন এবং জেনারেল ক্লেমেন্ট থমাসকে গুলি করে হত্যা করল। ফরাসি সরকার ও তাদের বিশ্বস্ত সেনারা এরপর দ্রুতই প্যারিস ত্যাগ করে।
মাঠ ফাঁকা দেখে বিপ্লবীরা দ্রুতই প্যারিসের দখল নেয়। তারা প্রজাতন্ত্রের নামে আইন জারি শুরু করে। ২৬ মার্চ বিপ্লবীরা নিজেরাই শহরে নির্বাচন করল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের প্রার্থীরাই জয়ী হয়। এরা ফরাসি বিপ্লবের আদলে প্যারিস কমিউন নামে বিপ্লবী সরকার গঠন করে। তবে কেউই তাদের স্বীকৃত দেয়নি। বিপ্লবীদের প্রত্যাখ্যান করে গ্যারিব্যাল্ডি ইতালি ফেরত যান, ভিক্টর হুগো পালালেন ব্রাসেলস।
স্বীকৃত ফরাসি সরকারপ্রধান থিয়ের্স দ্রুতই কমিউনকে দমন করবার প্রয়োজন অনুভব করলেন। ফরাসি সংসদ তখন অবস্থান করছিল ভার্সাইতে। সেখান থেকে আদেশ জারি হলে ২রা এপ্রিল পূর্বদিক থেকে ফরাসি সেনাদের একটি দল এগিয়ে আসে প্যারিসের দিকে। পরদিন একদল বিপ্লবী ভার্সাইতে হামলা করে গেল। এদের না ছিল প্রশিক্ষণ, না ছিল লড়াই করবার ক্ষমতা। ফলে কামানের কয়েকটি গোলার পরেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ফ্রান্সে অবস্থানরত জার্মান সেনারা সক্রিয়ভাবে কিছু করছিল না। তবে বিপ্লবীদের পক্ষে কোনো সাহায্যও তারা প্যারিসের বাইরে থেকে আসতে দিচ্ছিল না।
প্যারিস কমিউন বিসমার্কেরও দু’চোখের বিষ। থিয়ের্সের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি চুক্তির শর্ত শিথিল করলেন। ফলে আরো ফরাসি সেনাকে সশস্ত্র করা হলো। প্রায় ৮০,০০০ সৈন্য জমায়েত করা হয় কমিউনকে পিষে ফেলতে। বিসমার্ক জার্মানি থেকে যুদ্ধবন্দী ফরাসি সৈনিকদের দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করেন। ফলে সরকারের পক্ষে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ সেনা জোগাড় করা সহজ হয়ে যায়। এপ্রিলের ৬ তারিখে মুক্তিপ্রাপ্ত জেনারেল ম্যাকমোহন ফ্রান্সে পৌঁছলে জেনারেল ভিনয়কে সরিয়ে তাকে প্যারিসের সামরিক গভর্নর নিযুক্ত করে সরকার।
বিশৃঙ্খল বিপ্লবীরা নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে জড়িয়ে পড়ে। সরকারি সেনারা প্যারিসের দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে তারা অনেক ভবনে আগুন দেয়। প্রথিতযশা অনেক ফরাসি নাগরিককে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়, যার মধ্যে শহরের আর্চবিশপও ছিলেন। শহরের অনেক জায়গায় ব্যারিকেড খাড়া করা হলেও সবখানে পাহারা বসানোর শক্তি কমিউনের ছিল না। তাদের হাতে মাত্র ৩০,০০০ লোক থাকায় বহু স্থানেই প্রতিরক্ষা ছিল কার্যত শূন্য। ২১ মে ম্যাকমোহন প্যারিসে প্রবেশ করেন, ২৮ মে চূড়ান্তভাবে সরকারের অনুগত সেনাদের হাতে বিপ্লবীদের পতন ঘটে।
জার্মান রাইখ
ফ্রান্সের সাথে লড়াইয়ের আড়ালে চলছিল বিসমার্কের আরেক লড়াই। এই লড়াই কূটনৈতিক, একীভূত জার্মানির লড়াই। উত্তর জার্মানি প্রুশিয়ার অধীনে এক, কিন্তু দক্ষিণ জার্মানির চার প্রধান রাষ্ট্র, ব্যাডেন, হেসে, ভুর্তেমবার্গ আর বিশেষ করে বাভারিয়াকেও তো এই দলে আনতে হবে। বিসমার্ক চাচ্ছিলেন উত্তর জার্মান কনফেডারেশনের অনুমোদিত সংবিধান মেনেই সবাই জার্মান রাষ্ট্রে যোগ দেবে। ব্যাডেন এই সংবিধান মেনে শর্তবিহীনভাবেই যোগ দিতে সম্মত ছিল। হেসের অবস্থান ছিল ভৌগোলিকভাবে ব্যাডেন আর প্রুশিয়ার মাঝে। ফলে তারাও কিছুটা বাধ্য হয়েই বিসমার্কের কথা মেনে নেয়। ভুর্তেমবার্গ সংবিধানে কিছু পরিবর্তনের শর্ত জুড়ে দেয়।
তবে বাভারিয়া একদমই অস্বীকার করে প্রুশিয়ান নেতৃত্বাধীন জার্মানিতে যোগ দিতে। দোস্ত স্যাক্সোনিকে নিয়ে তারা দাবি করল বিসমার্কের সংবিধান আমূল পরিবর্তন এবং নতুন জার্মান কনফডারেশন গঠনের। তারা চাচ্ছিল প্রুশিয়ান কর্তৃত্ব খর্ব করে একটি জার্মান জোট যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র নিজস্ব সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে। বিসমার্ক দৃঢ়ভাবে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি ছোটখাট ছাড় দিতে রাজি থাকলেও প্রুশিয়ার ক্ষমতা হ্রাস পাবে এমন কোনো শর্ত মানতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিসমার্কের জার্মান দর্শনে ফেডারেল সরকার সেনা, পররাষ্ট্রসহ অর্থব্যবস্থা পরিচালনা করবে। জার্মানিতে চালু হবে অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থা ও আইন। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে ফেডারেল পরিষদ এবং সংসদ/রাইখস্ট্যাগের হাতে। নির্বাহী ক্ষমতার কেন্দ্র হবেন প্রুশিয়ার রাজা, যিনি একইসাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।
সেডানের বিজয়ের পর বাভারিয়া নতুন প্রস্তাব আনে। এবার তারা জার্মান রাষ্ট্রের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভায় নিজস্ব প্রতিনিধি পাঠানো এবং সেখান থেকে প্রতিনিধি গ্রহণের অধিকার দাবি করে। ফেডারেল রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী হবে না এমন চুক্তিতেও এককভাবে স্বাক্ষরের ক্ষমতাও তাদের কাম্য ছিল। তারা নিজেদের আলাদা সেনাবাহিনী এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখবার ব্যাপারেও কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়। মোটকথা, তারা চাচ্ছিল উত্তর জার্মান কনফেডারেশনের পরিপূর্ণ পুনর্বিন্যাস, যেখানে বাভারিয়া বিশেষ স্থান পাবে। বিসমার্ক এই সময় তাদের সাথে আলাদাভাবে বাভারিয়ার রাজা লুডভিগের জন্য অর্থ বরাদ্দের বিষয়েও কথা বলছিলেন, যার উদ্দেশ্য উইলিয়ামের জার্মানির রাজা হবার ক্ষেত্রে যাতে তিনি কোনো বাধা সৃষ্টি না করেন।
বিসমার্ক হেসে, ব্যাডেন আর ভুর্তেমবার্গের সাথেও পাশাপাশি আলোচনা চালাচ্ছিলেন যাতে তাদের দিক থেকে বাভারিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা যায়। এই চেষ্টা ব্যর্থ হলে তিনি হুমকি দিলেন সরাসরি জার্মান জনগণের কাছে একীভূত রাষ্ট্রের প্রশ্ন ভোটে তোলার। জার্মান সরকারগুলোর থেকে বাধার চিন্তায় চতুর বিসমার্ক আগেই এই বিকল্প ভেবে রেখেছিলেন। তিনি তথ্য সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জার্মান জনগণের একীভূত হওয়ার আশার পালে হাওয়া দিচ্ছিলেন। তারা কোন পক্ষ সমর্থন করবে তা অনুমেয়ই ছিল।
জার্মান লিবারেল আর জনগণের অধিকাংশই ছিল একীভূত জার্মান রাষ্ট্রের পক্ষে। ফলে জনমতের কথা চিন্তা করে ১৮৭০ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখ ব্যাডেন আর হেসে উত্তর জার্মান কনফেডারেশনে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি সই করল। ২৩ তারিখ কিছু ছাড়ের বিনিময়ে বাভারিয়া আর ২৫ তারিখ ভুর্তেমবার্গও কনফেডারেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করে। এর ফলে উত্তর জার্মান কনফেডারেশন পরিণত হয় ফেডারেল জার্মান রাষ্ট্রে। এরই নাম হয় জার্মান রাইখ। রাইখের সত্যিকার অর্থ সাম্রাজ্য থেকে কিছুটা ভিন্ন হলেও আমরা একে জার্মান সাম্রাজ্য বলেই ধরে নিতে পারি। সুতরাং ১৮৭১ সালের জানুয়ারি থেকে ফ্রান্স আর প্রুশিয়ার সাথে লড়াই করছিল না, তাদের প্রতিপক্ষ ছিল তৎকালীন ইউরোপের নবীনতম রাষ্ট্র, জার্মানি।
জানুয়ারি ১৮, ১৮৭১। গ্রেট হল অফ মিররস, ভার্সাই প্রাসাদ।
আজ থেকে ঠিক ১৭০ বছর আগে প্রুশিয়ার রাজা হিসেবে অভিষেক হয়েছিল প্রথম ফ্রেডেরিকের। অনেক রক্ত আর প্রতিকূলতার পর তারই হনজোলার্ন বংশধর উইলিয়ামের মাথায় উঠল একীভূত জার্মানির মুকুট। সিংহাসনে বসলেন জার্মান কাইজার, প্রথম উইলিয়াম।