শৈশবে কম-বেশি আমরা সবাই হংকংয়ের সিনেমা দেখেছি। আবার অনেকের ক্ষেত্রে হংকংয়ের সিনেমাকে ‘চাইনিজ সিনেমা’ ভেবে ভুল করাও অস্বাভাবিক ছিল না। জ্যাকি চ্যানের শৈল্পিক, অনন্য মারামারির ধরন; ব্রুস লির ঝাঁঝালো মারামারি; স্টিফেন চাওয়ের বিখ্যাত শাওলিন সকার (২০০১), কুং ফু হাস্ল (২০০৪) কমবেশি আমরা অনেকেই দেখেছি। এই সিনেমাগুলো হচ্ছে হংকং-ফিল্ম। চীনা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হংকং থেকে আলাদা। হংকংয়ের সিনেমা ক্যান্টনিজ ভাষায় নির্মিত। চীনের সিনেমা তৈরি ম্যান্দারিন ভাষায়। মাঝে হংকং ১০০ বছর ব্রিটিশদের শাসনে ছিল। এই সবকিছু মিলিয়ে হংকংয়ের সিনেমার ইতিহাস কিছুটা জটিল হয়ে গেছে। হংকংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা কী, সেটা নিয়ে কথা বলার আগে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে।
১৯৫০ দশক ছিল হংকং সিনেমার সোনালী সময়। ক্যান্টনিজ ভাষার সিনেমার প্রচলনও ছিল বেশ। কিন্তু সেটার স্থায়িত্ব খুব বেশি হয়নি, অল্প সময়ের মধ্যেই হংকংয়ের সিনেমায় ম্যান্দারিন ভাষার প্রভাব শুরু হয়। তখন চীনের কেন্দ্রীয় ইন্ডাস্ট্রি ছিল হংকং। ম্যান্দারিন ভাষার কাছে হার মেনে যায় ক্যান্টনিজ সিনেমা। হংকংয়ে তৈরি হতে থাকে একের পর এক ম্যান্দারিন সিনেমা।
এভাবে চলতে চলতে আসে ১৯৭২ সাল, যাকে ধরা হয় হংকংয়ের ইতিহাসের সবচেয়ে কালো বছর। সেই বছর ইতিহাসে প্রথম হংকংয়ে কোন ক্যান্টনিজ সিনেমা নির্মিত হয়নি। হংকংয়ের সিনেমায় পুরোপুরি রাজত্ব স্থাপন করে ম্যান্দারিন সিনেমা। হংকংয়ের ভাষা ক্যান্টনিজ বলে হংকংয়ের স্বকীয়তার জন্য এই ভাষার সিনেমার বিকল্প নেই। তখন সব বড় বাজেটের সিনেমা নির্মাণ করা হতো ম্যান্দারিন ভাষায়, আর কম বাজেটের সিনেমা হতো ক্যান্টনিজ ভাষার। এরকম দৃশ্যপটে ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় The House of 72 Tenants সিনেমাটি। ১৯৬৩ সালের একই নামের সিনেমার রিমেক, যা পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় চর ইয়ুয়েন (Chor Yuen)-কে।
সবাইকে অবাক করে বক্স অফিসে বিশাল আয় করে এই সিনেমা। বিখ্যাত কাল্ট মার্শাল আর্টস ফিল্ম Enter the Dragon (1973)-কেও টপকে যায় এই সিনেমা। Enter the Dragon-কে ধরা হয় পুরো বিশ্বের সবচেয়ে ইনফ্লুয়েনশিয়াল মার্শাল আর্ট সিনেমার একটি। এরকম এক সিনেমাকে বক্স অফিসে হারিয়ে দেওয়া সেসময় ক্যান্টনিজ ভাষার সিনেমার জন্য এক অসম্ভব কীর্তিই ছিল। তবে সেই অসম্ভব সাধন করে The House of 72 Tenants নামের এক কমেডি ফিল্ম।
এক কলোনিতে ৭২ জন ভাড়াটিয়া একসাথে বসবাস করে। এই একসাথে থাকা নিয়ে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই সিনেমা বানানো। কুং ফু হাস্ল (২০০৪) সিনেমার কলোনির কথা মনে আছে? সেটা এই সিনেমারই রেফারেন্স।
১৯৭৩ সালের এই সফলতার পর বক্স অফিসে রাজত্ব করতে আসেন মাইকেল হাই। দুজন লেখকের সাথে মিলে লিখে ফেলেন Games Gamblers Play (1974) সিনেমার গল্প, যা তিনি নিজেই পরিচালনা করেন, এবং প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। সাথে ছিলেন তার দুই ভাই স্যাম হাই এবং রিকি হাই। সিনেমার মিউজিক কম্পোজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন সেই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্যান্টোপপ তারকা স্যাম হাই। এই সিনেমা বক্স অফিসে ঝড় তোলে এবং মাইকেল হাইকে বানিয়ে দেয় হংকংয়ের নতুন হিরো। ব্রুস লির অকালমৃত্যুর পর হংকং পায় ব্রুস লি থেকে ভিন্নধরনের এক তারকাকে।
এর সফলতার পরের বছরই মাইকেল হাই তৈরি করেন The Last Message (1975); এটার প্যাটার্নও এক। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইকেল হাই এবং স্যাম হাই। ছোট একটি চরিত্রে কাজ করেছেন রিকি হাই। এই সিনেমারও পরিচালনা, লেখার দায়িত্ব পালন করেন মাইকেল হাই। অন্যদিকে মিউজিকের কাজ সারেন স্যাম হাই। এরপরের বছর আসে হাই ব্রাদার্সদের সবচেয়ে বড় এবং হংকংয়ের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমা The Private Eyes (1976)।
এক প্রাইভেট ডিটেক্টিভ এজেন্সির কর্মকাণ্ড আর সেসময়ের হংকংয়ের সাধারণ মানুষের কঠিন জীবনযাপনকে কেন্দ্র করে তৈরি কমেডি সিনেমা The Private Eyes (1976) হংকংয়ে প্রচুর সাড়া ফেলে। ভেঙে দেয় পূর্বের সকল রেকর্ড। জাপানে মুক্তির পর সেখানেও এই সিনেমা বক্স অফিস চার্টের শীর্ষে চলে যায়। বিভিন্ন সূত্রমতে, মুদ্রাস্ফীতিতে এটা এখনো হংকংয়ের তৈরি সবচেয়ে বড় ব্যবসাসফল সিনেমা।
এই সিনেমা পরিচালনা এবং লেখার দায়িত্বে যথারীতি ছিলেন মাইকেল হাই, মিউজিকের কাজে স্যাম হাই। আর প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন মাইকেল হাই, স্যাম হাই এবং রিকি হাই। এর আগের দুটি সিনেমায় রিকি হাইকে ছোট ভূমিকায় দেখা গেলেও এই সিনেমায় তিনি বড় ভূমিকায় অভিনয় করেন। সিনেমায় এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেন সেই সময়ের অপরিচিত নাম জ্যাকি চ্যান, এবং অ্যাকশন কোরিওগ্রাফের কাজ করেন আরেক অপরিচিত নাম সাম্মো হাং, যাদের দুজনেই এখন কিংবদন্তি এবং অ্যাকশন জগতের সবচেয়ে বড় নামগুলোর মধ্যে অন্যতম।
১৪ বছর পর হাই ব্রাদার্স নিজেরাই এই সিনেমার রিমেক তৈরি করে। এবার অবশ্য পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয়া হয় ফিলিপ চ্যানের হাতে। প্রধান ভূমিকায় যথারীতি অভিনয় করেন মাইকেল হাই, স্যাম হাই, এবং রিকি হাই। Front Page (1990) নামের এই সিনেমা হাই ব্রাদার্সদের একসঙ্গে তৈরি সর্বশেষ কাজ।
The House of 72 Tenants দিয়ে যে জাগরণ শুরু হয়, সেটা পোক্ত হয় The Private Eyes দিয়ে। হংকংয়ের সিনেমায় আসে জোয়ার। শীঘ্রই ব্রেক পেয়ে যান জ্যাকি চ্যান, সাম্মো হাং। তাদের সাথে আসে উয়েন বিয়াওসহ অসংখ্য মার্শাল আর্ট-অভিনেতা, যারা পরবর্তীতে হংকংয়ের অ্যাকশন সিনেমাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান, যে পর্যায়ে আর পরবর্তী অথবা পূর্ববর্তীতে কেউ যেতে পারেনি। হংকং সিনেমায় শুরু হয় এক নতুন ঢেউ। হংকংয়ের সিনেমা ধীরে ধীরে হয়ে যায় পুরো বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তর ইন্ডাস্ট্রি (হলিউড আর ভারতের পর)।
তারপর আশির দশকে আবির্ভাব হয় সুই হার্ক, রিঙ্গো লাম, জনি টো, অং কার-ওয়াই, অ্যান হুই প্রমুখ আধুনিক পরিচালকের, যাদের হাত ধরে হংকংয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় নতুন ঢেউ, এবং হংকং সিনেমা চলে যায় অনন্য এক উচ্চতায়। যদিও নব্বইয়ের দশকে আবারো ফাটল ধরে বক্স অফিসে। সেসময়ে আবার সত্তরের দশকের মাইকেল হাইয়ের মতো একচেটিয়া রাজত্ব করেন স্টিফেন চাও। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে ধস নামে পুরো হংকং ইন্ডাস্ট্রিতে। হংকংয়ের সিনেমার উথানের সাথে মিলিয়ে পতনের গল্প একসাথে লেখাটা খানিকটা কষ্টের, যেহেতু হংকংয়ের সিনেমার ইতিহাস অনেক জটিল এবং সমৃদ্ধশালী। পাশাপাশি রাজনীতিরও ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তাই পতনের এই গল্প একদিন আলাদা করে লিখতে হবে।