“আসলেই কি ‘বি ইওরসেল্ফ’ কথাটা সত্য? আমরা কি কেউই প্রকৃতভাবে এমন, যেমনটা আমরা মানুষের কর্নিয়ার আয়নায় সাজি? না। মানুষ প্রথমত একটা বৈবর্তনিক পশু। তার মাঝে আছে সীমাহীন অন্ধকার। কিন্তু মানুষ তার আমিত্বকে পশুত্ব নাম দিয়ে দূরে ঠেলে দেয়। ভান ধরে সভ্যতার। যে সমাজ তাকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে উল্লাস করে, সে সমাজের প্রতিটা মানুষকে খুন করে ফেলার ইচ্ছা তার হয়। কিন্তু সমাজের ভয়ে করে না। সমস্ত অন্ধকার সে বস্তাবন্দী করে অন্ধ কুয়ায় ফেলে দেয়। সেটা হারিয়ে যায় না, ওখানেই জমা থাকে। ক্রোধশ্বাস ফেলে অপেক্ষা করে। এবং সুযোগ বুঝে সেই অতল থেকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে আসতে চায়। আসলে প্রতিটা মানুষ আজ মর্জিমতো তথা প্রবৃত্তিমতো চালচলন শুরু করলে কালকেই আবার বর্বরযুগ ফিরে আসবে।”
দীর্ঘ এই মনোলগ আলোচনা করতে যাওয়া বইটিরই। ঈষৎ সংক্ষেপ করা হয়েছে অবশ্য। এই মনোলগই বইয়ের বিষয়বস্তুর ভাব প্রকাশ করে। বইয়ের নামটা খেয়াল করুন, ‘মেটামরফিক নিশীথে’। মেটামরফিক, যা দ্বারা রূপান্তর বোঝানো হয়। তেলাপোকা খোলস বদলায়, শুঁয়োপোকা প্রজাপতি হয়; এসবই রূপান্তর। মানুষও তো খোলস বদলায়, রূপ বদলায়। ভালো করে লক্ষ্য করলে, বইয়ের নামের অর্থটা এ হতে পরিষ্কার হয়।
‘রূপান্তরিত রাতে’। এই রাতের অন্ধকারেই তো আসল মানুষকে চেনা যায়। মানুষ তার যৌনক্রিয়ার জন্য যেমন রাতের সময়কে আদর্শ সময় বলে বেছে নেয়, তেমনি অপরাধের জন্যও বেছে নেয় এই রাতকে। চেহারা লুকানোর জন্যই গাঢ় অমানিশাকে বেছে নেওয়া। মুখোশের আড়ালে ঘৃণিত অমানুষের চেহারাটা যে কেউই রাতে দেখবে না। চোর, ডাকাত, ধর্ষক, হন্তারক; যেকোনো কিছুই হয়ে উঠতে পারে সে। রূপান্তরের এই রাতগুলোতে কিছু মানুষের খোলস বদলানোর গল্প নিয়েই এই ‘মেটামরফিক নিশীথে’।
গল্প শুরু হয়, ম্যানশন ফায়ারের ২৫ বছর আগের একটি ঘটনা দিয়ে। নামটা শুনে ‘ম্যানশন মার্ডার’-এর কথা মনে পড়ে? মার্ডার তো এই ম্যানশনেও হয়েছে। সাইকোপ্যাথও আছে। রেফারেন্সটা বুদ্ধিদীপ্তভাবেই ব্যবহার করা হয়েছে। তা কী ঘটেছিল সেই ২৫ বছর আগে? হত্যা। একটা বাচ্চা ছেলেকে নৃশংস হত্যা। অবিশ্বাস্য হলেও, সেই হত্যাটা করে তার মা! এরপরই ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড গতিতে গল্প চলে আসে বর্তমানে। ম্যানশন ফায়ারের তিন ঘণ্টা পর। গল্প স্থান নেয়, অন্ধকাশপুরে। লোকালয় থেকে বেশ দূরে একটা উপবন অঞ্চল। এরই ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছে একটা বিরাটকার দোতলা বাগান বাড়ি। তবে দাঁড়িয়ে থাকার গৌরব মিশে গেছে এখন মাটিতে। স্রেফ কয়লা। দেখে কিছুই বোঝার গতি নেই।
পুড়ে কয়লা শুধু এই বাংলো হয়নি, হয়েছে ৫/৬ জন যুবকও। তবে এই ধ্বংসস্তুপে একটা জিনিসই কয়লা না হয়ে অক্ষত আছে। সেটা হলো, শতবর্ষজীবী অশ্বথ গাছের তলায় মরার মতো পড়ে থাকা সেই নগ্ন নারীদেহ। গল্প এর পরই আবার সময় বদলে চলে যায় ছয় বছর আগে। ভার্সিটি পড়ুয়া বিনি আর শাদাবের গল্পে। একটা রঙিন প্রেমের গাঢ় অনুভূতি যেখানে মিশে আছে। গল্প শুধু এই সময়রেখাগুলোতে নয়, আরো কয়েকটি রেখায় চলে। তবে মূল সময়রেখা বলতে গেলে দু’টি। একটি ছয় বছর আগের বিনির গল্প, আরেকটি এই ম্যানশন ফায়ারের কিছু ঘণ্টা আগের ও পরের ঘটনা। পরের ঘটনাগুলো এগোয় দিন অনুযায়ী।
ছয় বছর আগের বিনির গল্পটা মূলত, মূল গল্পের অনুপ্রেরণা ও লক্ষ্যবস্তু হিসেবে কাজ করছে। সময়ের আগপিছু দেখে পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন। আসলে গল্পের বাঁকানো স্বভাবটাকে প্রকাশ করতেই সেটি করা হয়েছে। সরলভাবে বললে, গল্পটা শুরু হয় মূলত ওই নগ্ন নারীদেহ খুঁজে পাওয়া নিয়ে। তদন্ত করে তার দেহে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়। এবং এখান থেকেই তরুণ ডিটেক্টিভ রুদ্রনীলের কেসটা শুরু হয়। মেয়েটি জ্ঞান ফেরার পর স্বাভাবিক হলে তার জবানিতে শোনা যায় ঘটনাটা।
অন্ধকাশপুরে সে গিয়েছিল অডিশন দিতে। থিয়েটার করা মেয়ে। কে জানত, পালাতে হবে জান বাঁচাতে? ভাবলো, বেঁচেই গেছে। কিন্তু এরপরই দুঃস্বপ্ন থেকে আরো বড় দুঃস্বপ্নেরর বাস্তবে পতিত হয় সে। গল্পে যুক্ত হয়ে যায় মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্র। যোগ হয় শাদাবের অতীত, বিনির গল্প। যোগ হয় আজারবাইজানের বিলুপ্তপ্রায় আদিবাসী গোত্রের গোপন আর হঠকারি একটি প্রথার কথা, জাদুবিদ্যার কথা। যোগ হয় এক গবেষণাকারী সাইকোপ্যাথের বিভীষিকার গল্প।
ডিটেক্টিভ রুদ্রনীল, তার আরেক সিনিয়রের সাহায্য নিয়ে নেমেছে রহস্যের সুতোটা টেনে শেকড়ে পৌঁছাতে। আম্রি রহস্য (সরল) আছে, পলাণ্ডু রহস্য (যৌগিক)ও আছে। এটা কোন প্রকারের রহস্য? দিনশেষে সবটাই যে অন্যায়ে ভরা পৃথিবীর কিছু বাস্তব সত্য। মানুষের কিছু বাস্তব চেহারা। গলায় দলাপাকানো ঘৃণার থুতুটা গলাতেই রেখে দেওয়া ভালো, নাহয় সত্যের এই দর্শনকে মিথ্যা বলে চোখ ফিরিয়ে নেওয়াটা যে কঠিন হবে।
‘মেটামরফিক নিশীথে’র গল্প নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভে বর্ণিত। গল্পের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এটাই আসলে উপযোগী ন্যারেটিভ। তবে বলতে হয়, সময়রেখাগুলো বর্ণনার কথা। ম্যানশন ফায়ারের ৩ ঘন্টা আগে, ১ ঘন্টা ১০ মিনিট আগে, ৫৫ মিনিট আগে, ২৫ মিনিট আগে; এভাবে অধ্যায়ে বিভক্ত করে ঘটনা বর্ণনার ফলে যেটা হয়েছে, সময়ের যথার্থতা আলাদাভাবে নজরে পড়েছে। ডিটেলিংয়ে আলাদা একটা স্তর তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতির বর্ণনাটা আরো নিখুঁত হয়েছে; মাঝে মাঝে চর্চাটা একটু বেশি হয়েছে যদিও।
তবে, এভাবে সময় বর্ণনার স্টাইল দেখে মহান পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘দ্য কিলিং’ সিনেমার কথা মনে পড়ে যায়। বোধকরি, অনুপ্রেরণাটা সেখান থেকেই। অবশ্য কুব্রিকের রেফারেন্স বইয়ে সরাসরিই আছে। তাই মনে হওয়াটা অযৌক্তিক নয়। রেফারেন্স আছে আরেক চলচ্চিত্র মাস্টার তার্কভস্কি এবং ইতালিয়ান মহাকবি দান্তের। তাদের রেফারেন্স যে শুধু শোভাবর্ধন করেছে, তেমনটি নয়। বইয়ের ভাবটায়ও খানিক প্রগাঢ়তা যোগ করেছে। তাছাড়া, নামটা পড়লেই তো কাফকার সেই অমর সৃষ্টি ‘মেটামরফোসিস’-এর কথা মাথায় আসে। বইয়ের সামগ্রিক বাতাবরণে সেটার স্পিরিচুয়াল টোনের প্রভাবও অনুভূত হয়।
পৃষ্ঠতলে এটি একটি মিস্ট্রি, ডিটেক্টিভ, সাইকো থ্রিলার ঘরানার বই। সিনেম্যাটিক কড়চা সম্বলিত। তবে বাতিঘর প্রকাশনীর বেশিরভাগ মৌলিক থ্রিলারের মতো পৃষ্ঠতল নির্ভর বই এটি নয়। এতে গভীর দর্শন আছে, সূক্ষ্ম বক্তব্য আছে; যা সাধারণত বাতিঘর প্রকাশনীর অনন্য লেখক কিশোর পাশা ইমনের উপন্যাসেই বেশি পড়তে পাওয়া যায়। সম্প্রতি রবিন জামান খানের ‘শব্দজাল’ বইতেও ছিল। এটি বাতিঘর প্রকাশনীর বই নয় যদিও, মৌলিক থ্রিলারের কথাপ্রসঙ্গে উল্লেখ করা। শুধু থ্রিলার এগুলো নয়। মেটামরফিক নিশীথেও নয়। জনরা সাহিত্যের মাঝেও যে সাহিত্যের ক্লাসিক উপাদান মিশ্রিত করা যায়, গভীর দর্শন উপহার দেওয়া যায়; দেশীয় এই থ্রিলার বইটি আরেকবার তা প্রমাণ করল।
এ বইয়ে মানবমনের অন্ধকার দিকটিতে আলো ফেলা হয়েছে। তার ভেতরের কুৎসিত রূপের স্বরূপ উদঘাটনে নামা হয়েছে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীকে মানুষ কম, পণ্য হিসেবে দেখার ও ব্যবহার করার দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। তার প্রতি ছড়িয়ে থাকা বিদ্বেষের দিকটিও উপস্থাপন করা হয়েছে। একটি বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে মানুষের নৈতিকতার দ্বন্দ্ব, পুরুষের ধর্ষকামী মনোভাবের গভীরে দেখা হয়েছে।
এছাড়া ধর্মবিশ্বাস এবং সেটিকে কল্যাণে ব্যবহার করা নিয়েও আছে লেখকের নিজস্ব বক্তব্য। তবে লেখক আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য কখনোই একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গল্পকে আটকে ফেলেননি। একবার বিশ্বাস আর আরেকবার অবিশ্বাস, যাতে প্রোথিত আছে একটা সূক্ষ্ম নায়েলিস্টিক টোন; দুটিকে পাশাপাশি রেখে অস্তিত্বের অনুসন্ধান চালিয়েছেন। সবশেষে, গড’স কমপ্লেক্সিটির মতো জটিল বিষয়কেও নিপুণ দক্ষতায় বইয়ের গল্পের সাথে একীভূত করেছেন। যা বইটিকে আরো ওজনদার করেছে।
গল্পের শুরু হয় একজন সর্বদর্শী গল্পকথক বা অমনিসিয়েন্ট ন্যারেটরের বয়ানে। তবে গোটা বইয়ে ন্যারেটিভের বদল হতে দেখা যায়। দুটি চরিত্রও নিজেদের উত্তম জবানিতে গল্প বলে। একটা জায়গায় এসে সেই গল্প বলার দায়িত্ব আবারো সর্বদর্শী ন্যারেটর নিয়ে নেয়। ন্যারেটিভের এই বাঁকবদলগুলো হয়েছে খুব মসৃণভাবে। ওই চরিত্র দুটি কাজ করে আনরিলায়েবল ন্যারেটর, অর্থাৎ অবিশ্বাসযোগ্য গল্পকথক হিসেবে। সে বিষয়ের উল্লেখ বইতেও সরাসরি আছে। বক্তব্যের পাশাপাশি, ন্যারেটিভের এই সূক্ষ্ম নিরীক্ষাগুলো বইটাকে করেছে ব্যতিক্রমী। লেখনশৈলীতেও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন লেখক আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য।
তার বাক্যের গঠনে আর বিন্যাসে আড়ষ্টতা নেই। অতি বর্ণনা বা অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রবণতা এড়িয়ে গদ্যভাষাকে করে তুলেছেন অকপট। এই বই যতটুকু থ্রিলার, ততটুকুই ড্রামা। বেশ প্রগাঢ় ড্রামা। এবং লেখায় সেই ড্রামাটাইজেশন সরলভাবেই করতে পেরেছেন তিনি। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ও সেগুলোর ক্রিয়া-বিক্রিয়ার বর্ণনায় যথাসম্ভব যথার্থতা রেখেছেন। থ্রিলারের কিছু গড়পড়তা বর্ণনা অবশ্য আছে, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লেখক সেটা এড়িয়ে কাব্যিক সূক্ষ্মতাও রেখেছেন তার গদ্যে।
তবে বইয়ের কিছু ঘাটতিও আছে। প্রারম্ভিকের ২৫ বছর আগের সেই ঘটনাটি, শেষ অব্দি গল্পের একটা বিচ্ছিন্ন অংশ হয়ে ছিল। মূল গল্পের সাথে এর সংযুক্ততা তৈরি হয়নি। ডিটেক্টিভ জনরার উপাদানগুলো সেভাবে ব্যবহার করা হয়নি গল্পে। ভাসাভাসা ভাবে সেটা লেখা হয়েছে। শেষদিকে তাড়াহুড়ো বেশি। ছোটখাট কয়েকটা প্লটপয়েন্টে তাই অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। কিছু চরিত্রের, চরিত্রায়ন সংকীর্ণ হয়েছে, যার ফলে চরিত্রগুলো গল্পের প্রয়োজন মেটানো ছাড়া স্বতন্ত্র চরিত্র হতে পারেনি। এগুলো নিয়ে কাজ করার দরকার ছিল। তাছাড়া অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তির মতো মুদ্রণ ত্রুটিও ছিল একটি।
শেষতঃ বলতে হয়; ‘মেটামরফিক নিশীথে’ বিষয়াদি আর বক্তব্যে প্রগাঢ়তা সম্পন্ন, এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ থ্রিলার বই। পাঠককে নিজের অস্তিত্ব এবং চারপাশের অস্তিত্বের প্রশ্নে ঠেলে দেওয়াই এ বইয়ের উদ্দেশ্য ও সফলতা। বহুমুখী প্রতিভাধর লেখক, আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য দেশীয় থ্রিলার সাহিত্যের ক্রমবর্ধমান জগতে একটা স্বকীয় কণ্ঠস্বর। তার এই প্রথম বই, সেই দক্ষতারই পরিচায়ক।
বই: মেটামরফিক নিশীথে
লেখক: আলী ওয়াহাব সৌহার্দ্য
প্রকাশনী: বাতিঘর প্রকাশনী
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০২০
পৃষ্ঠা: ১৯১
মূল্য: ২২০ টাকা