মানুষ খুবই ভাগ্যবান। সে শুধু বিশাল ভালোবাসাই নয়, সে সব ভালোবাসাই মনে রাখতে পারে। শৈশবের কোনো টুকরো ভালোবাসার স্মৃতিও মধ্যবয়সে এসে হারিয়ে যায় না। কোনো এক অলস দুপুরে কিংবা নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায়, হঠাৎ কোনো স্মৃতি মনে করে মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে। কিংবা বেরিয়ে যায় একটি ছোটো দীর্ঘশ্বাস।
এক ঘনঘোর বর্ষার দিনে গল্পকথক সিদ্ধান্ত নিলেন পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার। শিক্ষকতার পেশা। মফস্বল শহরে পোস্টিং। কর্মক্ষেত্রের নাম, প্রফেসর আব্দুস সোবহান কলেজ ক্যাম্পাস। এলাকাটা বেশ মনোরম। চারিদিকে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতার আবেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি যাকে বলে। নাগরিক জীবনের কোলাহল থেকে দূরে এ ধরনের নিভৃত জীবনযাপন নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক। অথচ বিস্ময়কর ব্যাপার, গল্পকথকের জীবনে এক ফোঁটা স্বস্তি নেই। ফেলে আসা অতীতের গ্যাড়াকলে আটকে গিয়ে বর্তমানের বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। হারিয়ে ফেলেছেন নিজের অস্তিত্বের স্বকীয়তা। একবার নয়, বারবার।
গল্পকথকের অতীত জীবনের অধিকাংশ জুড়ে এক নারীর গল্প, রেনুমা তার নাম। রেনুমার অতীতের প্রেম গল্পকথককে বর্তমানে স্বস্তি পেতে দেয় না। তাছাড়া অতীতে সৌমিত্রের সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল গল্পকথকের। দুজনে মিলে একসময় তুমুল আগ্রহে জীবনানন্দ চর্চা করতেন। চায়ের কাপে ঝড় তুলে নিরুদ্বেগ আড্ডায় মেতে উঠতেন। সেইসব ফেলে আসা দিনের সুখের স্মৃতি গল্পকথকের বর্তমান জীবনের একাকীত্বের পাল্লা ভারী করে। দুঃখ বাড়ায়।
কিন্তু তার বর্তমান জীবনটা কীরকম? বর্তমানে গল্পকথকের জীবনে কিছু মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ে, রহমান স্যার তাদের মধ্যে অন্যতম। পাখিপ্রেমিক মানুষ তিনি- পাখির সাথে ভালোবাসা বিনিময় করার লক্ষ্যে রোজ ছুটে চলেন ঘন বাঁশঝাড়ের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাঁশঝাড় ভ্রমণের আড়ালে পাখিপ্রেমই কি মুখ্য বিষয়? নাকি অন্য কোনো রহস্য আছে? গল্পকথকের হেনা নামের যে ছাত্রী, তার জীবনেও কি কোনো রহস্য আছে?
“অতীতের কিছু ভয়ংকর স্মৃতি মানুষ আজীবন বয়ে বেড়ায়। আমিও বেড়াই। তবু মানবসম্পর্কের জটিলতায় যে ক্ষোভ তৈরি হয়, মানুষ হয়তো তা ভালোবাসার মতো মনে রাখে না। সে ক্ষমা করে দিয়ে সামনে এগোতে চায়।
তবে দুই একটা দুঃখ সে মনের ভেতরে রেখে দেয়। যে দুঃখে আমরা দুঃখিত হই, সেই দুঃখ আমরা অনবরত অন্যকে দিয়ে যাই। নিজের দেয়া দুঃখ মনে থাকে না। অন্যের দেয়া আঘাত আমরা মনের ভিতরে রেখে দেই।”
আসলে মানব মনের তল মাপা ভারী কঠিন ব্যাপার। নিরর্থক হাসি হাসতে গিয়ে কান্না চাপা পড়ে গভীর অতলে। চোখে সুখের ঝিলিক দেখলে প্রজাপতি ছেড়ে দেয় চিরচেনা কোণ, মুহুর্তেই জমে যায় ঈর্ষার পাহাড়। অন্যের আঘাত দিব্যি বহনযোগ্য। কালের হিসেব চুকিয়ে যায়। ফুরিয়ে আসে আয়ু। কিন্তু অন্যকে দেয়া নিজের আঘাত? সে খবর আর রাখা হয় না। প্রয়োজনও পড়ে না।
‘নিভৃতে’ উপন্যাসে অস্তিত্ব সংকটের টানাপোড়েনের ব্যাপারটা প্রকট আকার ধারণ করতে দেখা যায়। অতীতকে ভুলে থাকার সামান্য প্রচেষ্টা এখানে বৃহৎ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অথচ টের পাওয়া যায় না। শুরুটা হয় স্মৃতিকাতরতায় মাখামাখি হয়ে। সেকালের সৌমিত্রের নির্ভেজাল বন্ধুত্ব বর্তমানে এসে গল্পকথককে দারুণ ভোগায়। ঝিম ধরা ক্ষত জেগে উঠে আরও একবার। তখন মন পুড়তে থাকে রেনুমার এক মুঠো প্রেমের জন্য। বাবার এক চিলতে নির্ভরতার আকাশের জন্য। আর অস্তিত্ব সংকটের প্রভাব এত ভয়াবহ, যার কারণে বাস্তবের সাজানো জগৎ ভেঙে পড়ে আয়নার মতো। প্রতিবিম্বে যখন মনের খোঁজ মেলে না, হারিয়ে যায় জীবনানন্দের চিরকালের অরুণিমা; অস্তিত্বের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না তখন। থাকে শুধু শূন্যতা।
হ্যাঁ, আলোচিত উপন্যাসের পরতে পরতে লেপ্টে আছে শূন্যতার গল্প। মনস্তাত্ত্বিক কারুকাজে একাকীত্বের বিচিত্র আখ্যান এখানে ঠাঁই পেয়েছে। কণ্ঠ রোধ হয়ে আসা নির্জনতার স্বরূপ লেখক, রিয়াজ ফাহমী তুলে ধরেছেন বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। এক্ষেত্রে বর্ণনাশৈলীতে লক্ষ্য করা যায় চমকপ্রদ এক ছন্দময়তা। আর শব্দের পর শব্দ বসে এমন এক কাহিনীর অবতারণা ঘটায়, যা মনোঃচোখে দেখতে পাওয়া যায় খুব সহজে। এ যেন আমাদের নিজেদের গল্প। সুবিশাল পৃথিবীতে প্রতিদিন একটু একটু করে একা হয়ে উঠার গল্প।
আকারের দিক থেকে ছোট হলেও ‘নিভৃতে’ বিষয়বস্তুর পরিসর বেশ বড়। একটি বইয়ের কাহিনীতে উঠে এসেছে তিন তিনটে ভিন্ন ধারার গল্প। অল্প কথায় গল্প বলা বেশ কঠিন একটি কাজ। পারদর্শিতা না থাকলে সফল হওয়া যায় না এখানে। এদিক দিয়ে নিভৃতের লেখক এ কাজে যথেষ্ট সফল হয়েছেন বলা যায়। প্রথম গল্প আবর্তিত হয়েছে গল্পকথক আর রেনুমাকে কেন্দ্র করে। অতীতের নস্টালজিকতা এই গল্পের মুখ্য বিষয়।
রহমান স্যারকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে দ্বিতীয় গল্প; যা আর পাঁচটা সাধারণ গল্পের চেয়ে একেবারে অন্যরকম। ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার কারণেই মূলত সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে এই গল্প। হেনার গল্পটা প্রাধান্য পেয়েছে শেষাংশে। ভিন্নধর্মী সমাপ্তির জন্য দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠেছে এই গল্প।
পুরো উপন্যাসের কাহিনি এগিয়ে গিয়েছে সাবলীলভাবে। সহজ ভাষার প্রয়োগে কাহিনির বর্ণনা পড়তে বেশ ভালো লেগেছে। কিন্তু হ্যাঁ, উত্তম পুরুষে রচিত এই উপন্যাসের কাহিনি চিত্রিত হয়েছে মূলত গল্পকথকের চোখ দিয়ে। ফলে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে ঠিকঠাকভাবে জানা যায়নি। যেমন রেনুমার মধ্যে রহস্য থেকে গেছে অনেকখানি।
উপন্যাস: নিভৃতে || লেখক: রিয়াজ ফাহমী
প্রকাশক: চন্দ্রভুক || প্রকাশকাল: ২০২০