গোয়েন্দা গল্প বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের। আর তাদের প্রিয় দুই গোয়েন্দা চরিত্র অবশ্যই ফেলুদা ও ব্যোমকেশ। একজনের স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়, অপরজনের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের মধ্যে কে সেরা, এ নিয়ে যুগে যুগে বহু তর্ক-বিতর্ক হয়ে গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জয় হয়েছে ফেলুদারই। তার পেছনে কারণটাও বেশ বোধগম্য।
এমন নয় যে ফেলুদার থেকে ব্যোমকেশের মগজাস্ত্র কম শক্তিশালী, কিংবা ফেলুদার গোয়েন্দাসুলভ ক্যারিশমা ব্যোমকেশের মাঝে অনুপস্থিত। কাহিনীগত বৈচিত্র্যের দিক থেকেও ফেলুদার চেয়ে কোনো অংশে ব্যোমকেশ পিছিয়ে নেই, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়েই রয়েছে। তারপরও সার্বিক বিচারে বাঙালি ফেলুদাকেই বেছে নেয়, এর পেছনে একটি কারণ ফেলুদার কাহিনীর সার্বজনীনতা।
সত্যজিৎ রায় ছোটদের জন্য ফেলুদা লিখেছিলেন বটে, কিন্তু তা পড়তে পারে ছেলেবুড়ো সকলেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর পাঠকশ্রেণী বেশি। তাছাড়া নস্টালজিয়াও একটি বড় ধর্তব্য বিষয়। বাঙালি ছেলেমেয়েদের ছোটবেলায় বইয়ের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে ব্যোমকেশ নয়, ফেলুদা পড়েই। তাই ফেলুদার প্রতি তাদের হৃদয়ে খানিকটা বাড়তি আবেগের জায়গা তো থাকবেই।
কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, পর্দায় কে বেশি জনপ্রিয়, তাহলে আবার ব্যোমকেশই কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে। শুধু যে ফেলুদার চেয়েই ব্যোমকেশ এগিয়ে, তা নয়। গোটা বাংলা চলচ্চিত্র জগতেই এখন অবিসংবাদিত রাজত্ব চলছে ব্যোমকেশ চরিত্রটির। বিশেষ করে গত এক দশকে ব্যোমকেশ নিয়ে এত বেশি ছবি নির্মিত হয়েছে, এবং এত এত ফ্র্যাঞ্চাইজি গড়ে উঠেছে, তারপরও যে সাধারণ মানুষের ব্যোমকেশের প্রতি বিরক্তি ধরে যায়নি, এটিই ব্যোমকেশের সবচেয়ে বড় প্লাস পয়েন্ট।
তবে এখানে আরেকটি বিষয়ও মনে রাখতে হবে। ব্যোমকেশ নিয়ে যে এত এত ছবি, এমনকি টিভি সিরিয়াল ও ওয়েব সিরিজ নির্মিত হচ্ছে, তার কারণ ব্যোমকেশের স্বত্ব পাওয়া সহজ। হাতে টাকা থাকলেই এর স্বত্ব কিনে ফেলা গেছে। কিন্তু ফেলুদার বেলায় সেটি সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ওয়েব সিরিজের জন্য স্বত্ব ছেড়েছেন বটে, এবং হিন্দিতে সোনার কেল্লার স্বত্বও বিক্রি করেছেন, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ফেলুদার স্বত্ব সম্পূর্ণ নিজের করে রেখেছিলেন সত্যজিৎ রায়ের পুত্র সন্দীপ রায়। তাই বাংলা বড় পর্দায় তিনি ছাড়া আর কেউ নির্মাণ করতে পারেননি ফেলুদা নিয়ে ছবি, এবং অদূর ভবিষ্যতেও সে সম্ভাবনা নেই।
মজার ব্যাপার হলো, বড় পর্দায় জনপ্রিয়তার দিক থেকে ব্যোমকেশ ছাড়িয়ে গেছে যে ফেলুদাকে, সেই ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই কিন্তু প্রথম বড় পর্দায় এসেছিল ব্যোমকেশ। ১৯৬৭ সালে উত্তম কুমারকে ব্যোমকেশ আর শৈলেন মুখোপাধ্যায়কে অজিত চরিত্রে নিয়ে গোয়েন্দা গল্প থেকে ছবি নির্মাণে হাতেখড়ি হয়েছিল সত্যজিতের। চিড়িয়াখানা নামক ওই ছবিতে অভিনয়ের জন্য উত্তম কুমার সেরা অভিনেতা, আর সত্যজিৎ সেরা পরিচালকের জাতীয় পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।
কিন্তু যদি নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করতে চাওয়া হয় বড় পর্দায় ব্যোমকেশের প্রথম উপস্থিতিকে, বলতেই হবে সেটি সন্তোষজনক ছিল না। উত্তম কুমার বাংলা ছবির মহানায়ক হতে পারেন, কিন্তু এ ছবিতে তাকে দেখে ব্যোমকেশ হিসেবে মানতে কষ্ট হয়েছে অনেকেরই। অবশ্য ভিন্ন মতাবলম্বীও আছে অনেকে। তাদের মতে, ব্যোমকেশের বাঙালিয়ানা বেশ ভাল ভাবেই ধরা পড়েছিল উত্তমের অভিনয়ে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রতিভূ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই ছবির কাহিনীও এমন ছিল যে, স্বয়ং কাহিনীকার শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ও মনে করতেন তা নিয়ে ভালো ছবি নির্মাণ সম্ভব না। বাস্তবিক হয়েছিলও তা-ই। সত্যজিৎ তার নির্মাণের মুনশিয়ানা দিয়ে ছবির শুরু ও মাঝের অংশকে উত্তেজনাপূর্ণ রাখার চেষ্টা করলেও, হুডানিটের শেষ পর্যায়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যা অংশে গিয়ে কাহিনী অনেকটাই ঝুলে গিয়েছিল বলে তার নিজের অভিমত।
চিড়িয়াখানা নির্মাণ শেষে সত্যজিৎ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন, এটি তার দুর্বলতম কাজ। এবং এরপর আরো আড়াই দশক কাজ করলেও, এটি তার অন্যতম দুর্বল কাজ হয়েই থাকে। এ ছবির ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা প্রমাণ পাওয়া যাবে ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে মেরি সেটনকে লেখা একটি চিঠিতে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “মনে হচ্ছে ভারতবর্ষে পুরস্কার পাবার যোগ্য পরিচালকের বড্ড আকাল! তুমি জেনে মজা পাবে, আমি সেরা পরিচালক হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি, চিড়িয়াখানার জন্য!!”
ব্যোমকেশকে নিয়ে এক চিড়িয়াখানা বানিয়েই শিক্ষা হয়ে গিয়েছিল সত্যজিতের। তাই দ্বিতীয়বার আর ব্যোমকেশ বানাবার উদ্যোগ করেননি তিনি। বরং ব্যোমকেশ বানাতে গিয়ে পাওয়া শিক্ষা তিনি কাজে লাগিয়েছিলেন নিজস্ব সৃষ্টি ফেলুদাকে নিয়ে বানানো ছবি সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথে। বইয়ের পাতায় ফেলুদার কাহিনীকে হুডানিট আকারে সাজাতেন তিনি, এবং একদম শেষে গিয়ে বৈঠকি কায়দায় নিজের ট্রেডমার্ক স্টাইলে প্রদোষ চন্দ্র মিত্রকে দিয়ে রহস্যের জট ছাড়াতেন তিনি। কিন্তু বড় পর্দায় ফেলুদা বানাতে গিয়ে তিনি আর সেগুলোকে হুডানিট রাখেননি, বরং শুরু থেকেই দুষ্টু লোককে দেখিয়ে দিয়ে হাউডানিট আকারে উপস্থাপন করেছেন কাহিনী।
তবে সত্যজিৎ আর ব্যোমকেশ না বানালেও, চিড়িয়াখানা বানানোর আগে স্টার প্রোডাকশন নামে যে প্রযোজনা সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেটি থেকেই ১৯৭৪ সালে আবার প্রযোজনা করা হয় ব্যোমকেশের নতুন ছবির। এবারের পর্বের নাম সজারুর কাঁটা। এ ছবিতে পরিচালকের খড়ম পায়ে গলালেন মঞ্জু দে। অজিতের ভূমিকায় সেই শৈলেন বন্দোপাধ্যায়ই, কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে উত্তম কুমারের স্থলাভিষিক্ত হলেন সতীন্দ্র ভট্টাচার্য।
বলাই বাহুল্য, পরিচালক ও প্রধান অভিনেতার ভূমিকা থেকে সত্যজিৎ ও উত্তম কুমারের মতো দুইটি বড় নাম চলে যাওয়ার পর এই ছবির ব্যাপারে জনমনে আগ্রহ গিয়ে ঠেকেছিল তলানিতে। অনেকে তো এখন স্বীকারও করতে চান না এই ছবির অস্তিত্বের কথা। অঞ্জন দত্ত তো এ-ও দাবি করেন, সত্যজিৎ রায়ের চিড়িয়াখানার পর তার হাত ধরেই বড় পর্দায় ফিরেছে ব্যোমকেশ। এর কারণ হয়তো তিনি মাঝের ছবিগুলোকে ‘সত্যিকারের ব্যোমকেশ’ বলে মানতে চান না।
সে যা-ই হোক, ১৯৭৪ সালের সজারুর কাঁটার পর ব্যোমকেশ নির্মাণে কিছুটা ছেদ পড়েছিল। সবেধন নীলমণি হিসেবে আশির দশকে দূরদর্শনের বাংলা সংস্করণ ডিডি বাংলায় প্রচারিত হয়েছিল ব্যোমকেশ বক্সী নামে একটি সিরিজের বেশ কিছু পর্ব। সেখানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন অজয় গাঙ্গুলি। তবে এই সিরিজটিও পারেনি খুব বেশি দর্শকের মন জয় করতে।
কিন্তু দূরদর্শনেই হিন্দিতে যখন জাতীয়ভাবে প্রচার শুরু হলো ব্যোমকেশ বক্সী, তা হয়ে উঠল তুমুল জনপ্রিয়। সেটি নব্বই দশকের কথা। খ্যাতিমান নির্মাতা বাসু চ্যাটার্জির পরিচালনায় সেই হিন্দি সিরিজে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন রজিত কাপুর। এছাড়া অজিত চরিত্রে দেখা যায় কে কে রায়না, আর সত্যবতী চরিত্রে সুকন্যা কুলকার্নিকে। মোট দুই মেয়াদে (যাকে আজকের দিনে বলা হয় সিজন) প্রচারিত হয়েছিল এটি। ১৯৯৩ সালে প্রথম মেয়াদে ১৪ পর্ব, আর ১৯৯৭ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ২০ পর্ব।
সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে, এখন পর্যন্ত পর্দায় ব্যোমকেশের সেরা রূপান্তর ঘটেছিল বাসু চ্যাটার্জির এই সিরিজেই। প্রচারের সময় থেকেই দারুণ প্রশংসিত হতে থাকে সিরিজটি, এবং এরপর দুই দশকেরও অধিক পেরিয়ে গেলেও, এখনো এতটুকু কমেনি এর আবেদন। বরং দূরদর্শনের স্বর্ণালী যুগের অনুষ্ঠানমালার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয় এটি।
বাড়াবাড়ি রকমের মূলানুসারী এই সিরিজটির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল এর অনাড়ম্বর উপস্থাপন। খুব আহামরি লোকেশন না, দামি সেট না, ক্যামেরার কাজও তেমন বলার মতো কিছু না। শুধু শরদিন্দুর বইয়ের পাতা থেকে এমনভাবে ব্যোমকেশসহ অন্যান্য চরিত্রদের পর্দায় তুলে আনা, যেন তাদেরকে জীবন্ত মনে হয়। আর এতেই কেল্লাফতে। তাছাড়া এই সিরিজের আরেকটি বিশেষ দিক ছিল সংলাপ। প্রচলিত হিন্দিতে নয়, বরং শুদ্ধ সংস্কৃত ঘেঁষা হিন্দিতে কথা বলত চরিত্ররা, যা মানের দিক থেকে সমসাময়িক অন্যান্য অনুষ্ঠানের চেয়ে একে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল।
যেহেতু এই সিরিজটি প্রচারিত হয়েছিল রাষ্ট্রীয় চ্যানেল দূরদর্শনে, এবং তখনকার দিনে এখনের মতো এত বেশি স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিল না ভারতে, তাই সারা দেশের অসংখ্য মানুষ দেখেছিল সিরিজটি। মূলত এই সিরিজের মাধ্যমেই অবাঙালি ভারতীয়দের কাছে ব্যোমকেশ চরিত্রটি পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে। এবং ব্যোমকেশ চরিত্রে রজিত কাপুরের অভিনয় ছিল এতটাই অনবদ্য যে আজো ব্যোমকেশের নাম শুনলেই অনেকের চোখের সামনে রজিত কাপুরের চেহারা ভেসে ওঠে। আবার রজিত কাপুরও ব্যোমকেশের দুই মেয়াদের মাঝখানে বড় পর্দায় মহাত্মা গান্ধী চরিত্রে অভিনয় করলে কী হয়েছে, অনেক দর্শক তাকে ব্যোমকেশ বক্সী হিসেবেই চেনে!
হিন্দি দূরদর্শনে ব্যোমকেশ বক্সী শেষ হওয়ার পর আবার বেশ কয়েক বছরের বিরতি। এরপর ২০০৪ সালে বাংলা দূরদর্শনে ফেরে ব্যোমকেশ বক্সী। স্বপন ঘোষালের পরিচালনায় ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন সুদীপ মুখোপাধ্যায়। এছাড়া অজিত ও সত্যবতী চরিত্রে যথাক্রমে দেবদূত ঘোষ ও মৈত্রেয়ী মিত্র। যথারীতি বাংলা টেলিভিশনে নির্মিত আগের সিরিজটির মতো এটিও ব্যর্থ হয় জনপ্রিয়তা লাভে। কারণ ততদিনে কলকাতায় চলে এসেছে বাংলা ভাষার বিভিন্ন স্যাটেলাইট চ্যানেল, আর সেগুলোর ধারাবাহিক নাটকে বুঁদ হতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ।
এরপরও হাল ছাড়েননি স্বপন ঘোষাল। ২০০৭ সালে তিনি আবারো হাজির হন ব্যোমকেশ বক্সী নামের টিভি সিরিজ নিয়ে। এবার অবশ্য দূরদর্শন নয়, তারা মিউজিকের জন্য তিনি নির্মাণ করেন সিরিজটি। সেখানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, আর সত্যবতীর ভূমিকায় পিয়ালি মিত্র। বলাই বাহুল্য, এই সিরিজটিও দর্শকমনে দাগ কাটতে পারেনি।
সব মিলিয়ে একটি বিষয় বেশ পরিষ্কার, সেই যে ১৯৬৭ সালে সত্যজিৎ রায় বানিয়ে গিয়েছিলেন চিড়িয়াখানা, সেটি যেমনই হোক, তারপর বাংলা ভাষায় আর যেসব ব্যোমকেশ ছবি ও টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে, তার কোনোটিই গুণেমানে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। ফলে ২০০৯ সালে যখন প্রায় কাছাকাছি সময়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ ও অঞ্জন দত্তের মতো দুইজন হাই-প্রোফাইল নির্মাতা ঘোষণা দিলেন ব্যোমকেশকে নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানাবেন, নড়েচড়ে বসল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। বিষয়টি নিয়ে এমনভাবে আলোচনা হতে লাগল যেন সত্যজিৎ রায় চিড়িয়াখানা বানিয়ে যাবার পর বাংলায় আর ব্যোমকেশ নিয়ে কিছুই হয়নি।
কিন্তু একই সময়ে দুইজন বড় পরিচালক একই চরিত্র নিয়ে ছবি বানানোর পরিকল্পনা করবেন, আর তাদের মধ্যে রেষারেষি হবে না, তা কী করে হয়! ফলে অনুমিতভাবেই বাক-বিতণ্ডায় জড়িয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত ও ঋতুপর্ণ ঘোষ। অঞ্জনের ভাষ্য অনুযায়ী, ঋতুপর্ণ এটিকে বড় কোনো ব্যাপার বলে মানতে চাননি। তার যুক্তি ছিল, শার্লক হোমস নিয়েও তো একই সময়ে একাধিক নির্মাতা কাজ করেছেন। ফেলুদার স্বত্ব যদি পাওয়া যেত, সেটি নিয়েও হয়তো একই সময়ে তিনি নিজে ছাড়াও অঞ্জন ও সৃজিত মুখার্জির মতো নির্মাতারা ছবি বানাতে চাইতেন। তাহলে ব্যোমকেশ নিয়ে একসাথে দুইজনের ছবি বানানোয় অসুবিধা কী আছে!
তাদের এই মতপার্থক্যের কোনো সুরাহা হয়নি। তাই অঞ্জন আর ঋতুপর্ণ দুজনেই একসাথে ব্যোমকেশ নিয়ে ছবি বানানোর উদ্যোগ শুরু করে দেন। অঞ্জন দত্ত যেখানে আবীর চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন তথাকথিত ‘নোবডি’-র উপর বাজি ধরেন, সেখানে ঋতুপর্ণ তার ব্যোমকেশ হিসেবে বেছে নেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে।
প্রসেনজিৎ তখনো সৃজিতের সাথে জুটি বাঁধেননি, অটোগ্রাফ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারের পুনর্জাগরণ ঘটাননি। ঋতুপর্ণের ছবিগুলো করছেন বটে, কিন্তু এর বাইরে তার ক্যারিয়ারে মোটামুটি ভাটার টানই চলছে। তাই ব্যোমকেশ চরিত্রে হতে পারত তার ক্যারিয়ারের একটি সম্ভাব্য টার্নিং পয়েন্ট। অপরদিকে আবীরকে তখনো বেশিরভাগ মানুষই চেনে না। অঞ্জন দত্তের ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয়, তা-ও আবার ব্যোমকেশের মতো চরিত্রে, সব মিলিয়ে তার কাঁধে ছিল প্রত্যাশা ও বাস্তবতার দ্বিগুণ চাপ। তাই শেষ পর্যন্ত কে জয়ী হয়, ঋতুপর্ণ নাকি অঞ্জন, প্রসেনজিৎ নাকি আবীর, তা হতে পারত কলকাতার চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির একটি চুম্বকীয় ঘটনা।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হলো না। বলা ভালো, একজন ব্যক্তি হতে দিলেন না। তিনি স্বপন ঘোষাল। বাংলা চলচ্চিত্রের দুই মহারথী যখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যোমকেশকে বড় পর্দায় আনার, তখন হুট করে তিনি ঘোষণা দিয়ে বসলেন, তিনিও ছবি বানাবেন ব্যোমকেশকে নিয়ে! এবং তারপর তুমুল বেগে লো বাজেটের মগ্ন মৈনাক বানানো শুরুও করে দিলেন। সেখানে ব্যোমকেশের ভূমিকায় শুভ্রজিৎ দত্ত।
স্বপন ঘোষালও ব্যোমকেশকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছেন শুনে ব্যোমকেশ প্রজেক্টে ইস্তফা দিলেন ঋতুপর্ণ-প্রসেনজিৎ জুটি। ঋতুপর্ণের ভাষ্যমতে, “আমরা যখন ব্যোমকেশ নিয়ে ছবি বানানোর সিদ্ধান্ত নিই, তখন আমরা জানতাম অন্য চলচ্চিত্র নির্মাতারাও এটি নিয়ে ছবি বানাতে আগ্রহী। কিন্তু আমি জানতাম না অন্য ছবিগুলোও একই সময়ে হতে থাকবে। শুধু ঘোষণাই নয়, সবগুলো ছবির শুটিং ও মুক্তির তারিখও কাছাকাছি সময়ে নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বড় ধরনের বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। এতগুলো ব্যোমকেশ বক্সী একসাথে পর্দায় এলে আমার ছবিটির কোনো স্বাধীন অস্তিত্ব থাকবে না। তাই আমি ও প্রসেনজিৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপাতত ব্যোমকেশ বানানো থেকে সরে আসার।”
ঋতুপর্ণ ঘোষ সাময়িকভাবে সরে দাঁড়ালেও, অঞ্জন দত্ত কিন্তু ব্যোমকেশকে নিয়ে ছবি বানানোয় বদ্ধপরিকর, এবং তিনি তার পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোতে লাগলেন। তবে আগে মুক্তি পেল স্বপন ঘোষালের মগ্ন মৈনাকই। বিষয়টি বেশ বিস্ময়করই যে যিনি সবার শেষে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার হাত ধরেই কিনা দীর্ঘ ৩৫ বছর পর বড় পর্দায় ফিরল ব্যোমকেশ!
কেমন ছিল সেই ব্যোমকেশ? স্বপন ঘোষালের নিজের দাবি, “টিভি সিরিজে সুদীপ মুখার্জী ব্যোমকেশ করেছেন, কিন্তু শুভ্রজিৎ সেরা। সত্যি কথা বলতে, তাকে অনেকটা শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের মতোই দেখায়!” কিন্তু শরদিন্দুর মতো দেখতে ব্যোমকেশকে গ্রহণ করল না বাংলার মানুষ। স্বপন ঘোষালের দুর্বল নির্মাণের সেই ব্যোমকেশকে দর্শকের গ্রহণ করার পেছনে কোনো যুক্তিও অবশ্য ছিল না। বরং তারা অপেক্ষা করে ছিল অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশের জন্য। ইতিমধ্যেই গণমাধ্যমে ব্যোমকেশ হিসেবে আবীরের প্রথম ঝলক দেখে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল অনেক দর্শক। তাই তারা অপেক্ষা করে ছিল অঞ্জন-আবীর জুটির কাছ থেকে দুর্দান্ত কিছুর।
অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ২০১০ সালে বড়পর্দায় মুক্তি পেল অঞ্জন দত্তের বহুল প্রতীক্ষিত সেই ব্যোমকেশ বক্সী। মুক্তির আগেই যেভাবে দর্শকমনে আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল ছবিটি, তাতে করে মুক্তির পর দর্শক যে হলে হুমড়ি খেয়ে পড়বে, তা এক প্রকার অনুমিতই ছিল। কিন্তু যেটি অনুমিত ছিল না, তা হলো আবীর ছাড়াও, অজিত চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় এবং সত্যবতী চরিত্রে ঊষসী চক্রবর্তী অভিনয় করা, আদিম রিপু গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিটি ঠিক এতটা ভালো হবে।
একটি জটিল মনস্তাত্ত্বিক গল্পের এমন সহজ-সরল, হৃদয়স্পর্শী নির্মাণ কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। এই ছবির মধ্য দিয়ে পরিচালক হিসেবে অঞ্জন দত্তের যেন এক নবজন্মই হলো। তবে আর সবকিছুকে ছাপিয়ে যাকে নিয়ে সাধারণ দর্শক মেতে উঠল, তিনি আবীর চট্টোপাধ্যায়। গালে কাটা দাগওয়ালা এই সৌম্যদর্শন যুবক ব্যোমকেশ হিসেবে পুরোপুরি মানিয়ে গেলেন। তার চোখমুখ থেকে যেমন ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি ঠিকরে বের হয়, তেমনই তার চলনে-বলনে প্রস্ফুটিত হয় শতভাগ বাঙালিয়ানা। রজিত কাপুর যত ভালোই করুন, তিনি তো কথা বলতেন হিন্দিতে। এইবার যেন বাংলাভাষী আবীরের মুখে দর্শক খুঁজে পেল সত্যিকারের ব্যোমকেশকে, যাকে তারা তাদের কল্পনার চোখে দেখে এসেছে।
অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ বক্সীতে আবীর ছাড়াও সমান উজ্জ্বল ছিলেন শাশ্বত ও ঊষসী। আবীরের সাথে তাদের দুজনের রসায়নই ছিল সমান ভালো। বিশেষত পর্দায় বেশি সময় পাওয়া শাশ্বতের সাথে আবীরের জুটিটা ছিল দেখার মতো। চিড়িয়াখানায় উত্তম কুমারের দুর্দান্ত পর্দা উপস্থিতির পাশে ম্লান ছিলেন শৈলেন মুখোপাধ্যায়। একই কথা প্রযোজ্য বাসু চ্যাটার্জির ব্যোমকেশে কে কে রায়নার ক্ষেত্রেও। এবারই যেন প্রথম কোনো অজিতকে পাওয়া গেল, যে ব্যোমকেশের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করতে পারবে। তাই তো কোথায় দেব-শুভশ্রী, আর কোথায় জিৎ-শ্রাবন্তী, গত দশ বছরে কলকাতার বাংলা ছবিতে সেরা জুটি হিসেবে আবীর-শাশ্বতের নামই আসবে।
অঞ্জন দত্ত তার প্রথম ব্যোমকেশ বক্সীতে অভাবনীয় সাফল্যের পর ২০১২ সালে বানালেন চিত্রচোর অবলম্বনে পরের পর্ব, আবার ব্যোমকেশ। মানের দিক থেকে এটি প্রথম পর্বকে পিছনে ফেলতে পেরেছে কি না, তা তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু এটি যে সিক্যুয়েল হিসেবে সফল ছিল, সে কথা অনস্বীকার্য। ফলে বড় পর্দায় প্রথমবারের মতো দাঁড়িয়ে গেল ব্যোমকেশকে নিয়ে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজি।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই ফ্র্যাঞ্চাইজির পথ চলা যেমনটি হবে বলে সকলে আশা করেছিল, তা আর হয়নি। এর পেছনে আবীরের কিছুটা দায় অবশ্যই রয়েছে। কেননা ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করে যখন সাফল্যের সপ্তম স্বর্গে পরিভ্রমণ করছেন, ঠিক তখনই তিনি সন্দীপ রায়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হলেন বাদশাহী আংটি ছবিতে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। এর আগে একটা লম্বা সময় সব্যসাচী চক্রবর্তী বড় ও ছোট পর্দায় ফেলুদা চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে এ চরিত্রের সমার্থক হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তার বয়স হয়ে যাওয়ায়, সন্দীপ রায় সব্যসাচীর উত্তরসূরী হিসেবে বেছে নেন আবীরকে। আবীর একই সাথে ব্যোমকেশ ও ফেলুদা দুইটি চরিত্রেই অভিনয় করবেন, এ বিষয়টি অন্য অনেকের মতো সহ্য করতে পারেননি অঞ্জন দত্তও। তাই আবীরের সাথে বেশ মনোমালিন্য হয় তার।
তবে অভিমান ভুলে আবীরের সাথে ফের মিলে যেতে বেশিদিন সময়ও নেননি তিনি। যখন বুঝতে পারলেন আবীর ফেলুদা করবেনই, তখন তিনি ছুটে গেলেন আবীরের কাছে। তাকে প্রস্তাব দিলেন শেষ একটি ব্যোমকেশ তৈরী করার। বেশ তড়িঘড়ি করেই নির্মাণ হলো ব্যোমকেশ ফিরে এলো ছবিটি, যেটি অঞ্জন দত্তের পরিচালনায় আবীরের শেষ ব্যোমকেশ। একই সাথে ব্যোমকেশ-অজিত হিসেবে আবীর-শাশ্বতেরও শেষ ছবি এটিই।
২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা। একই দিনে মুক্তি পেল ব্যোমকেশ ও ফেলুদা। এবং আরো আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, দুইটি চরিত্রের অভিনেতা একই ব্যক্তি, আবীর চট্টোপাধ্যায়! বড়দিনের ছুটিতে দুইটি ছবিই চলল রমরমিয়ে, ব্যবসায়িকভাবেও পেল সাফল্য। কিন্তু অধিকাংশ দর্শক আবীরকে ব্যোমকেশ হিসেবে যতটা গ্রহণ করল, ঠিক ততটাই আপত্তি জানাল ফেলুদার ভূমিকায় তাকে দেখে। সব্যসাচীকে ফেলুদা হিসেবে দেখে আসা দর্শক কমবয়েসী আবীরকে মেনে নিতে পারল না। পাশাপাশি একই ব্যক্তিকে ব্যোমকেশ ও ফেলুদা হিসেবে দেখাটাও তাদের জন্য ছিল যথেষ্ট অস্বস্তিকর একটি ব্যাপার।
ফেলুদা হিসেবে আবীরকে সেবারই প্রথম ও শেষবার দেখা গেছে। কেননা ২০১৬ সালে ফেলুদার ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে সন্দীপ রায় ডাবল ফেলুদা নামের যে ছবিটি বানান, সেটিতে তিনি ফিরিয়ে আনেন সব্যসাচীকে। দর্শক সব্যসাচীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবার মাধ্যমে প্রমাণ করে দেয়, কমবয়েসী আবীরের চেয়ে বুড়ো সব্যসাচীই এখনো ফেলুদা হিসেবে তাদের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্য! সন্দীপ রায়ের আবীরকে ফেলুদা চরিত্র থেকে বাদ দেয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হলো, আবীরের ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে বিদায় বলতে রাজি না হওয়া। সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসব।
২০১৪ সালে ব্যোমকেশ-ফেলুদা নিয়ে এত নাটকের আগেই অবশ্য বড়পর্দায় চলে এসেছিল নতুন আরেক ব্যোমকেশ। তিনি কাহানিখ্যাত সুজয় ঘোষ। আর পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রথম দফায় যে ব্যোমকেশকে নিয়ে ছবি করতে চেয়েও পারেননি, সেই ব্যোমকেশকে নিয়েই তিনি করেছেন তার জীবনের শেষ ছবি সত্যান্বেষী। ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের মৃত্যুর পর। তিনি মারা যান ২০১৩ সালের ৩০ মে, আর সত্যান্বেষী মুক্তি পায় ওই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর।
ঋতুপর্ণ মারা যাওয়ার আগেই সত্যান্বেষীর শুটিংয়ের সিংহভাগই শেষ করে গিয়েছিলেন। অবশিষ্ট যেটুকু ছিল, তা সম্পন্ন করেন দীর্ঘদিন তার ছবিতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করা অভিক মুখোপাধ্যায়। এই ছবিতে ব্যোমকেশ চরিত্রে সুজয় ঘোষ ছাড়াও অজিত হিসেবে অভিনয় করেছিলেন সংগীতশিল্পী ও পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। তাছাড়া ঋতুপর্ণের ব্যোমকেশে শেষ পর্যন্ত প্রসেনজিতের অভিনয় করা হয়ে না উঠলেও, একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তার স্ত্রী অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যোমকেশ ও ফেলুদা পরস্পরের মুখোমুখি হওয়ার আগে, ওই বছরের জানুয়ারিতে কিন্তু তারা একই ছবিতে পাশাপাশি দেখা দিয়েছিলেন! বলছি স্বাগত চৌধুরীর ছবি দূরবীনের কথা। সেখানে ফেলুদা চরিত্রে যথারীতি ছিলেন সব্যসাচী। আর ব্যোমকেশ হিসেবে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যিনি ছিলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা! কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, খুবই চিত্তাকর্ষক একটি কনসেপ্ট নিয়ে এই ছবিটি নির্মিত হলেও, শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়িয়েছিল তা দর্শকমনে ভালোলাগার চেয়ে বিরক্তি উদ্রেকই করেছিল বেশি।
২০১৪ সালে টেলিভিশনে ফেরে ব্যোমকেশ। এবং এবার ব্যোমকেশ ফেলুদার ছেলে! মানে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন সব্যসাচীর ছেলে গৌরব চক্রবর্তী। কালার্স বাংলা (শুরুতে ইটিভি বাংলা) চ্যানেলে প্রচারিত হয় টিভি সিরিজটি। এটিও অনেকাংশে মূলানুসারী, কিন্তু অনেকটা টিভি সোপের মতো করে এখানেও অহেতুক কাহিনী টেনে বড় করার প্রবণতা লক্ষণীয় ছিল। এই সিরিজে অজিতের ভূমিকায় ছিলেন সৌগত বন্দোপাধ্যায়, এবং সত্যবতী চরিত্রে রিধিমা ঘোষ। বিভিন্ন পর্বের পরিচালনা করেন অমিত সেনগুপ্ত, গোপাল চক্রবর্তী ও জয়দীপ মুখার্জী। আর সৃজনশীল পরিচালক হিসেবে ছিলেন মৈনাক ভৌমিক।
ছোট পর্দার জন্য নির্মিত এই সিরিজটিতে অবিশ্বাস্য রকমের ভালো করেন গৌরব চক্রবর্তী। ইতিপূর্বে তিনি কয়েকটি ছবি ও টিভি ধারাবাহিকে অভিনয় করলেও, নিজের প্রতিভার যথাযথ স্বাক্ষর রাখেন এই সিরিজে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই। এই সিরিজে অজিত হিসেবে সৌগত হয়তো খুব একটা ভালো করেননি, কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে এমনকি অঞ্জন দত্তেরও মন জয় করে নেন গৌরব। আবীর চলে যাওয়ার পর অঞ্জন যখন নতুন ব্যোমকেশ খুঁজছিলেন, তখন তিনি গৌরবের কথাও চিন্তা করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বয়স কম হওয়ায় সে সুযোগটি পাননি গৌরব। কিন্তু আরেকটু পরিণত ও পরিপক্ব হলে তাকেও হয়তো বড়পর্দায় ব্যোমকেশের ভূমিকায় ঠিক দেখা যাবে।
২০১৫ সাল ব্যোমকেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল বছর। কেননা এ বছর দেখা মিলেছিল চারজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যোমকেশের। শুরু করা যাক আবীরকে দিয়েই। যেমনটি আগেই বলেছি, তিনি ব্যোমকেশকে বিদায় বলতে পারেননি। অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে বেরিয়ে এলেও, ব্যোমকেশ চরিত্র করতেই তিনি গিয়ে ভেড়েন অরিন্দম শীলের শিবিরে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা চরিত্র শবরকে সফলভাবে বড়পর্দায় নিয়ে আসার পর, তিনি এবার ব্যোমকেশ নিয়ে ছবি বানাতে শুরু করেন, আর সেখানে ব্যোমকেশ হিসেবে বেছে নেন আবীরকেই।
তবে অরিন্দমের ছবিতে ব্যোমকেশ হিসেবে আবীর থাকলেও, পালটে যায় বাকি লাইন-আপ। অজিত চরিত্রে আসেন ঋত্বিক চক্রবর্তী, আর সত্যবতী হিসেবে সোহিনী সরকার। এই তিনজনকে মূল চরিত্রে নিয়েই ২০১৫ সালে মুক্তি পায় অরিন্দমের হর হর ব্যোমকেশ। এ ছবিতে ব্যোমকেশের উপস্থাপনও অনেকটাই বদলে যায়। ব্যোমকেশ হিসেবে আবীরকে রাখলেও, অরিন্দম চাচ্ছিলেন অঞ্জনের ছায়ামুক্ত স্বাতন্ত্র্য কিছু বানাতে। তাই অঞ্জন যেমন মূলানুসারী ছিলেন, সে দর্শন থেকে সরে এসে অরিন্দম নিজের মতো করে অনেক কিছু ঢোকালেন কাহিনীতে। হিন্দু পৌরাণিক বিষয়াবলি বেশ প্রাধান্য পেল। অ্যাকশন ও বুদ্ধির পাশাপাশি ব্যোমকেশের প্রেমিক সত্তাটিকেও উন্মোচন করলেন তিনি।
অরিন্দমের ছবিতে ব্যোমকেশ-অজিত হিসেবে আবীর-ঋত্বিকের রসায়ন তেমন একটা না জমলেও, একক অভিনেতা হিসেবে বেশ ভালো করলেন ঋত্বিক। কিছু কিছু জায়গায় আবীরকেও ছাপিয়ে গেলেন তিনি। কিন্তু তারপরও দর্শকের কাছে কোথাও যেন একটা তাল কেটে যাওয়ার অনুভূতি হতে লাগল। তবে সেই ক্ষতে কিছুটা হলেও প্রলেপ দিল আবীর-সোহিনীর রোমান্স, যা তুলনামূলক কম ছিল আবীর-ঊষসীর মাঝে। কিন্তু তাদের এই অযাচিত রোমান্স যে অনেক সিরিয়াস দর্শককে ক্ষুব্ধ করেনি, সে কথাও জোর দিয়ে বলার জো নেই।
এরপর ২০১৬ ও ২০১৮ সালে অরিন্দম শীলের আরো দুইটি ব্যোমকেশ মুক্তি পেয়েছে। একটি ব্যোমকেশ পর্ব, অপরটি ব্যোমকেশ গোত্র। ব্যোমকেশ পর্বে অজিত হিসেবে ঋত্বিকই ছিলেন, কিন্তু এরপর আর ব্যোমকেশের ছবিতে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তার কাছে মনে হচ্ছিল, ওই চরিত্রে আর নতুন করে কিছু দেয়ার বাকি নেই তার। ফলে বিপাকে পড়ে যান অরিন্দম। অনেক চেষ্টা-চরিত্র করেও অজিত হিসেবে যোগ্য কাউকে না পেয়ে শেষমেষ তিনি দ্বারস্থ হন শাশ্বতের। ঘোষণা দেন, আবারো আবীর-শাশ্বতকে দেখা যাবে ব্যোমকেশ-অজিত হিসেবে। কিন্তু তার এই ঘোষণার বাস্তবায়ন আর হয়নি। আইনি জটিলতার কারণে অজিত হিসেবে কাজ করতে পারেননি শাশ্বত। শেষ পর্যন্ত ব্যোমকেশ গোত্র-তে নতুন অজিত হিসেবে আগমন ঘটে রাহুল বন্দোপাধ্যায়ের। ঋত্বিকের স্থলাভিষিক্ত হয়ে বেশ ভালোই করেন তিনি। এছাড়া এই ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন অঞ্জন দত্ত।
আবার ফিরে যাওয়া যাক ২০১৫ সালে। আবীর ছেড়ে চলে গেছেন, তাই বলে কি অঞ্জন ব্যোমকেশ বানানো বন্ধ করে দেবেন? তা তো হতে পারে না। তাই তিনি সন্ধান শুরু করলেন নতুন ব্যোমকেশ খোঁজার। প্রথমবার তিনি নতুন মুখ হিসেবে আবীরকে নিয়েছিলেন, কেননা তার ইচ্ছা ছিল মানুষ মূলত ব্যোমকেশ হিসেবেই আবীরকে চিনবে। তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে বটে, কিন্তু এখন তো আবীর চলে গেছেন। তাই অঞ্জনের বর্তমান চাওয়া একজন পরিচিত মুখ, কিন্তু যার কোনো আলাদা ইমেজ নেই। সেই চাওয়া মিলল যীশু সেনগুপ্তে। দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন যীশু। ছোটপর্দা-বড়পর্দা সবখানে কাজ করেছেন, কিন্তু কখনো টাইপকাস্ট হয়ে যাননি। সুতরাং তিনিই তো হতে পারেন অঞ্জনের নতুন ব্যোমকেশ।
যীশুকে তো পাওয়া গেল ব্যোমকেশ হিসেবে, কিন্তু অজিত-সত্যবতী হবে কে? অঞ্জন চেয়েছিলেন নতুন ব্যোমকেশ এলে তার পাশাপাশি অন্য দুই চরিত্রেও পরিবর্তন আনবেন তিনি। কিন্তু শাশ্বত-ঊষসীর সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর তার মনে হলো, তা কেন, শাশ্বত-ঊষসীই তো সম্ভাব্য সেরা অজিত-সত্যবতী। তাই তাদের দুজনকেই রাখলেন তিনি। পাশাপাশি মনোনিবেশ করলেন ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে নতুন করে ঢেলে সাজানোয়। আবীরের বিশেষত্ব ছিল চোখা সংলাপ ও মর্মভেদী চাহনি। সেটির পরিবর্তে যীশুর ব্যোমকেশে তিনি প্রাধান্য দিলেন অননুমেয়তাকে। ব্যোমকেশরূপী যীশু কখন কী করবে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। সে হয়তো ভুলও করে বসবে, আবার সময়মতো সেটি সংশোধনও করে নেবে। এভাবে ঘটবে এমন সব ঘটনা, যা দর্শক অনুমান করতে পারবে না।
এর পাশাপাশি যীশুর স্পষ্ট উচ্চারণ, সংযত অভিনয়, আর অনবদ্য পর্দা-উপস্থিতিকে ঢাল করে ২০১৫ সালে অঞ্জন দত্ত মুক্তি দেন কহেন কবি কালিদাস অবলম্বনে নির্মিত ব্যোমকেশ বক্সী। মুক্তির আগ পর্যন্ত যীশুকে নিয়ে সবার মনে যত সন্দেহ ছিল, সব এক ফুঁৎকারে উড়ে যায়। এরপর অঞ্জন নেন যীশুকে নিয়ে আরো বড় চ্যালেঞ্জ। ২০১৬ সালে তিনি বানান ব্যোমকেশ ও চিড়িয়াখানা। অর্থাৎ সত্যজিৎ রায় যে চিড়িয়াখানা বানিয়েছিলেন, ঠিক সেটিরই কাহিনী অবলম্বনে নতুন একটি ছবি। সরাসরি হয়তো সত্যজিতের ছবিটির রিমেক নয়, কিন্তু তারপরও সবাই বলাবলি করতে থাকে, এবার দেখা যাবে ব্যোমকেশ হিসেবে কে এগিয়ে, উত্তম কুমার নাকি যীশু সেনগুপ্ত। শেষ পর্যন্ত অঞ্জন দত্ত বেশ ভালো একটি ছবিই উপহার দেন, কিন্তু ব্যোমকেশ হিসেবে কে শ্রেয়, তা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। অবশ্য অনেকে যীশুকেই এগিয়ে রেখেছেন।
২০১৭ সালে অঞ্জন যীশুকে নিয়ে নির্মাণ করেন ব্যোমকেশ ও অগ্নিবাণ। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন এরপর আর ব্যোমকেশকে নিয়ে কোনো ছবি পরিচালনা করবেন না তিনি। সে হিসেবে আবীরকে নিয়ে তিনটি ও যীশুকে নিয়ে তিনটি, মোট ছয়টি ছবির মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে। এখন অবশ্য তিনি ব্যোমকেশ সংশ্লিষ্টই একটি নতুন ভূমিকায় রয়েছেন। তবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যাক টু ২০১৫। এ বছর মুক্তি পায় ব্যোমকেশকে নিয়ে নির্মিত প্রথম হিন্দি ভাষার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রও। বাংলা ব্যতীত আর সকল ভারতীয় ভাষায় নির্মাণের লক্ষ্যে ব্যোমকেশের সবগুলো কাহিনীর স্বত্ব কিনে নিয়েছিলেন পরিচালক দিবাকর ব্যানার্জি ও যশ রাজ ফিল্মস। এরপর যশ রাজ ফিল্মসের ব্যানারেই মুক্তি পায় ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী ছবিটি। এখানে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রে অভিনয় করেন সুশান্ত সিং রাজপুত।
মূলত সত্যান্বেষী, পথের কাঁটা ও অর্থনর্থমের কাহিনীর অংশবিশেষের সাথে অধিকাংশ নতুন প্লট সাজিয়ে দিবাকর ব্যানার্জি তৈরি করেন এ ছবিটি। সুশান্ত সিং রাজপুতের অভিনয়সহ গোটা ছবিটিই দারুণ প্রশংসিত হয়, সমালোচকদের প্রশংসা কুড়োয়। কিন্তু অনেক রক্ষণশীল বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীই সহ্য করতে পারেনি এই ছবিটির কাহিনী। তাদের মতে, দিবাকর অসম্মান করেছেন শরদিন্দুর মূল কাহিনীকে। এ ছবিতে প্রদর্শিত চুম্বনদৃশ্যও হয়েছে অনেকের মর্মপীড়ার কারণ। তবে সে যা-ই হোক, এ ছবিটি পুনরায় ভারতব্যাপী ব্যোমকেশের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে রেখেছিল বড় ভূমিকা। এ ছবি মুক্তির পর অনেক অনলাইন স্টোরে ব্যোমকেশ সমগ্র স্টক-আউট হয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বেও আলোড়ন তুলেছিল ছবিটি। এ ছবির ট্রেইলার দেখেই ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন বড় পর্দায় শার্লক হোমসের চরিত্রে অভিনয় করা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। আশার কথা হলো, ভবিষ্যতে দিবাকর-সুশান্ত জুটির কাছ থেকে আরো ব্যোমকেশ কাহিনী আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এছাড়া ২০১৫ সালেই বুড়ো ব্যোমকেশের দেখা মেলে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রে। শৈবাল মিত্রর শজারুর কাঁটা ছবিতে ব্যোমকেশ চরিত্রে অভিনয় করেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। তবে সাধারণ দর্শক খুব একটা সাদরে গ্রহণ করতে পারেনি ছবিটিকে। এর পেছনে প্রধানত তিনটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, পর্দায় বৃদ্ধ ব্যোমকেশকে সহ্য হয়নি অনেকের। দ্বিতীয়ত, ধৃতিমানের অভিনয় নিয়ে কোনো আপত্তি না থাকলেও, তার মাঝে ব্যোমকেশসুলভ বাঙালিয়ানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। আর তৃতীয়ত, শজারুর কাঁটা গল্পটিই প্রচলিত ব্যোমকেশ কাহিনীগুলোর চেয়ে অনেকটা আলাদা, যা দিয়ে একটি সফল চলচ্চিত্র বানানো বেশ কঠিন কাজ।
২০১৬ সালে মুক্তি পায় নীলোৎপল সিংহরায় পরিচালিত বরদা ও বহুরূপী ছবিটি। শরদিন্দুর বহুরূপী গল্প অবলম্বনে নির্মিত এ ছবিতে ব্যোমকেশ বক্সী চরিত্রে দেখা যায় সুব্রত রায়কে। আগামীতে একই পরিচালকের প্রিয় চরিত্র নামের ছবিটিতে আবারো ব্যোমকেশ হিসেবে দেখা যাওয়ার কথা রয়েছে সুব্রত রায়কে।
২০১৮ সালে আসে একটি অন্য ধরনের ব্যোমকেশ। ব্যোমকেশ সিরিজের স্পিন-অফ বলতে পারেন এটিকে। বর্তমান সময়ের পটভূমিতে ব্যোমকেশ ও তার পরবর্তী দুই প্রজন্মকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ মৌলিক কাহিনীর বিদায় ব্যোমকেশ নির্মাণ করেন দেবালয় ভট্টাচার্য। এ ছবিতে বৃদ্ধ ব্যোমকেশ ও তার নাতি সাত্যকির ভূমিকায় দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন আবীর। এছাড়া অজিত হিসেবে ছিলেন রাহুল, আর সত্যবতী হিসেবে সোহিনী। বেশ চমৎকার একটি কনসেপ্টই ছিল ছবিটির। কিন্তু অসংখ্য প্লটহোল ও অতিমাত্রায় বাজে মেক-আপের দরুণ দর্শকেরা ছবিটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। প্রতি বছর যেখানে মূল ব্যোমকেশ নিয়েই এত এত ছবি নির্মিত হচ্ছে, সেখানে এমন একটি স্পিন অফের কী দরকার ছিল, অতি যৌক্তিক সেই প্রশ্নও তোলে অনেকে।
বর্তমান সময়ে টিভি সিরিজ ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পাশাপাশি ওয়েব সিরিজ হিসেবেও দারুণ সুনাম কুড়াচ্ছে ব্যোমকেশ। অনেকের মতে এই মুহূর্তে ব্যোমকেশের সেরা প্রোডাকশনও সেটিই। ২০১৭ সাল থেকে হইচই ওটিটি প্ল্যাটফর্মে স্ট্রিম হচ্ছে ব্যোমকেশ নামের ওয়েব সিরিজটি, যেখানে ব্যোমকেশের চরিত্রে অভিনয় করছেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য। এছাড়া অজিত হলেন সুব্রত দত্ত, এবং রিধিমা ঘোষ সত্যবতী। সিরিজটির এখন পর্যন্ত চার সিজন পরিচালনা করেছেন সায়ন্তন ঘোষাল ও সৌমিক চট্টোপাধ্যায়। শীঘ্রই আসছে পঞ্চম সিজন।
অপেক্ষাকৃত নবীন হওয়া সত্ত্বেও, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ব্যোমকেশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন অনির্বাণ। অভিনেতা হিসেবে তো তিনি অতুলনীয় বটেই, পাশাপাশি তার বাচনভঙ্গি, উচ্চারণ, মৌখিক অভিব্যক্তি কিংবা শরীরী ভাষা, সবকিছুই ব্যোমকেশের সাথে দারুণ মানানসই। ওয়েবের দুনিয়া ছেড়ে কবে তিনি ব্যোমকেশ হিসেবে বড়পর্দায় পদার্পণ করবেন, সেজন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবাই।
এবার আসা যাক এক ব্র্যান্ড নিউ ব্যোমকেশ ও অঞ্জন দত্তের নতুন ভূমিকা বিষয়ক আলাপে। যেমনটি আগেই বলেছি, পরিচালক হিসেবে আর ব্যোমকেশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অঞ্জন। কিন্তু ইতিমধ্যেই অভিনেতা হিসেবে ব্যোমকেশে মুখ দেখিয়ে ফেলেছেন তিনি, এবং তার নতুন ভূমিকা হলো উপদেষ্টা হিসেবে। ব্যোমকেশ ওয়েব সিরিজ, আলিনগরের গোলকধাঁধা ও যকের ধন সিরিজের সফল নির্মাতা সায়ন্তন ঘোষাল নির্মাণ করেছেন বড়পর্দার জন্য ব্যোমকেশের নতুন ছবি, আর সেখানে চিত্রনাট্যকারের পাশাপাশি উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন অঞ্জন।
এই নতুন ব্যোমকেশ ছবিতে ব্যোমকেশ হিসেবে কে? তিনি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। ইতিপূর্বে ফেলুদা, তোপসে ও বিমল হিসেবে কাজ করা এই গুণী অভিনেতা এবার আসছেন ব্যোমকেশ হিসেবে। তাকে ব্যোমকেশ হিসেবে কল্পনা করা একটু কঠিনই বটে। আবীর কিংবা অনির্বাণদের চেহারায় যেমন ব্যোমকেশসুলভ ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে, মুখের আদলে ব্যোমকেশসুলভ কাঠিন্য রয়েছে, সেগুলো পরমব্রতের মধ্যে অনুপস্থিত। কিন্তু তারপরও তিনি এবার হতে চলেছেন নতুন ব্যোমকেশ।
পরমকে ব্যোমকেশ ও রুদ্রনীল ঘোষকে অজিতের ভূমিকায় নিয়ে (থাকছে না সত্যবতী) মগ্ন মৈনাক গল্প অবলম্বনে নির্মিত সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ ছবিটি ইতিপূর্বের ব্যোমকেশগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা ব্যতিক্রমই হতে চলেছে। এতদিন আমরা যেসব ব্যোমকেশ দেখে এসেছি, এবং শরদিন্দুও ব্যোমকেশকে নিয়ে যেসব কাহিনী লিখেছেন, সেগুলোতে ব্যক্তিমানুষের অভাবী জীবনের কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা প্রভৃতি প্রাধান্য পেয়েছে। রাজনীতির বিষয়টি সেখানে খুব একটা আসেনি। কিন্তু এবারের ব্যোমকেশে খুব মোটা দাগেই আসতে চলেছে রাজনীতি। কারণ এই ছবির কাহিনীই যে এক রাজনৈতিক অস্থির সময়কে কেন্দ্র করে। সময়টা ১৯৭১, যখন এক বাংলায় চলছে মুক্তিযুদ্ধ, আর অন্য বাংলায় নকশাল আন্দোলন। ইতিহাসের এই দুই যুগান্তকারী ঘটনাকে এক সুতোয় গাঁথার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে আসন্ন দুর্গাপূজায় মুক্তির অপেক্ষায় থাকা এই ছবির টিজার ও ট্রেইলারে।
তবে ছবির কাহিনীর চেয়েও বেশি করে আলোচনা হচ্ছে যে বিষয়টি নিয়ে, তা হলো ব্যোমকেশ হিসেবে পরম। একে একে টলিউডের সব অভিনেতাকেই ব্যোমকেশ বানিয়ে ফেলা হবে কি না, এমন ব্যাঙ্গাত্মক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছে অনেকে। কিন্তু অঞ্জন দত্তের ব্যাখ্যা হলো, এবারের ব্যোমকেশ নির্বাচনে তিনি চেয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত কিন্তু এমন কাউকে নিতে, যাকে কেউ ব্যোমকেশ হিসেবে কল্পনাও করতে পারেনি। এক দিক থেকে অঞ্জন দত্ত সঠিক, পরমকে ব্যোমকেশ হিসেবে সত্যিই ভাবতে পারেনি কেউ। এবার দেখা যাক, আবীর ও যীশুর উপর বাজি ধরে যেভাবে জিতেছিলেন তিনি, এবার পরমকে নিয়েও তেমনই কিস্তিমাত করতে পারেন কি না।
দীর্ঘ এই রচনার ইতি টানার আগে একটি কথা বলতেই হচ্ছে, কোনো একটি নির্দিষ্ট সাহিত্য চরিত্রকে নিয়ে কোনো ইন্ডাস্ট্রিতে আলাদা আলাদা এত চলচ্চিত্র ও সিরিজ নির্মাণের বিষয়টি সত্যিই বিরল। ব্যোমকেশ যেন এক সোনার ডিম পাড়া হাঁস, তাই সকলেই চাচ্ছে এই হাঁসের ভাগ পেতে। আর সে কারণেই, বাঙালি চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কোনো মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স বা উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড না থাকলে কী হয়েছে, ব্যোমকেশকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠছে তাদের একদম নিজস্ব একটি ইউনিভার্স। আমাদের শুধু চাওয়া, অতিভোজনে যেমন অমৃতেও অরুচি এসে যায়, ব্যোমকেশকে নিয়ে এমন অতিনির্মাণের ফলে কালজয়ী এই চরিত্রটির আবেদন যেন মলিন হয়ে না যায়, এই চরিত্রের আগুন যেন নিভে না যায়।
ব্যোমকেশ সমগ্র পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিঙ্কে-
বই-সিনেমা সংক্রান্ত চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/