জ্যাকি চ্যান অভিনীত রাশ আওয়ার টু চলচ্চিত্রটি নিশ্চয়ই অনেকেই দেখেছেন। সিনেমার শেষের দিকে লাস ভেগাসের এক ক্যাসিনোর ভেতর মানি লন্ডারিং চক্রের মূল হোতাদের একজনের সাথে জ্যাকি চ্যানের মারামারির একপর্যায়ে অপরাধীর হাত থেকে ডলার ভর্তি স্যুটকেস ছুটে যায় এবং কয়েক লাখ ডলার ছাদ থেকে বাতাসে ভাসতে ভাসতে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। উড়ন্ত টাকাগুলোর দিকে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়, টাকাগুলো নিছকই সাদা কাগজের বান্ডিল ছিল না। সেগুলো দেখতে সত্যি সত্যিই ১০০ ডলারের নোটের মতো ছিল।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই নোটগুলো কি আসল ছিল? সত্যি সত্যিই কি লাখ লাখ, বা কখনও মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার সেটে নিয়ে এসে শুটিং করা হয়? সিনেমার প্রয়োজনে কি সেগুলোকে পানিতে ফেলে দেয়া হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়? নাকি এসব ক্ষেত্রে জাল টাকা ব্যবহার করা হয়? যদি জাল টাকাই হয়, তবে সেগুলো আসে কোথা থেকে? তাতে কি আইনী ঝামেলার সৃষ্টি হয় না? শুটিং শেষ হওয়ার পরেই বা এই টাকাগুলোর পরিণতি কী হয়? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন।
ডলারের পরিবর্তে মেক্সিকান মুদ্রার ব্যবহার!
টাকার পরিমাণ যদি অল্প হয়, তাহলে সবচেয়ে সহজ সমাধান হচ্ছে আসল টাকা ব্যবহার করা। বর্তমানে অল্প পরিমাণ টাকা প্রদর্শনের দরকার হলে অনেক স্টুডিও সেই কাজটাই করে। কিন্তু সব সময় ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশ ঘটছিল, তখন একইসাথে জাল টাকার উপদ্রবও ছিল বেশ বড় একটি সমস্যা। ফলে সে সময় জাল টাকার প্রসার রোধে বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি আইন ছিল, আসল মুদ্রার কোনো চিত্র ধারণ করা এবং প্রচার করা যাবে না।
এই বাধা অতিক্রম করার জন্য বিশের দশকে সিনেমা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিকল্প একটি পথ খুঁজে বের করেছিল। ১৯১০ সালে মেক্সিকান বিপ্লবের সমাপ্তির পর নতুন মুদ্রা চালু হওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ পুরাতন মুদ্রা অকেজো হয়ে পড়েছিল। ফলে হলিউডের চলচ্চিত্র প্রযোজকরা তখন মার্কিন ডলারের পরিবর্তে চলচ্চিত্রের পর্দায় বাতিল হয়ে যাওয়া মেক্সিকান মুদ্রা ব্যবহার করতে শুরু করেন। বাতিল মুদ্রার যোগান শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা আসল মেক্সিকান মুদ্রা ব্যবহার করতে শুরু করেন, যেহেতু আইনগতভাবে সেটার উপর কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
সাদা কাগজের বান্ডিলের ব্যবহার!
দীর্ঘদিন পর্যন্ত হলিউডে মেক্সিকান মুদ্রা ব্যবহারের রীতি চালু ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতায় ধীরে ধীরে জাল টাকার দৌরাত্ম্য কমে আসতে থাকে। ফলে একসময় পুরাতন আইনগুলো শিথিল হয়ে আসতে থাকে এবং আসল মুদ্রার চিত্র ধারণের উপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা উঠে যেতে শুরু করে। ষাট এবং সত্তরের দশক থেকে নির্মাতারা চলচ্চিত্রে আসল মার্কিন ডলার ব্যবহার করতে শুরু করেন।
মানিব্যাগ ভর্তি কয়েক হাজার ডলার সিনেমায় দেখানোটা কোনো সমস্যা না। সেটা প্রযোজক নিজের পকেট থেকেই বের করে দিতে পারেন। কিন্তু যখন ব্যাংক, ক্যাসিনো বা ড্রাগ ব্যবসার দৃশ্যের জন্যে লাখ লাখ বা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দেখানোর প্রয়োজন পড়ে, তখন সেটার ব্যবস্থা করা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে একটা সহজ সমাধান হচ্ছে, ডলারের পরিবর্তে সাদা কাগজ ব্যবহার করা।
যদি শুধুমাত্র ব্রিফকেস ভর্তি অথবা টেবিল বা মেঝের উপর রাখা সারি সারি বান্ডিল বাঁধা টাকা একনজর দেখানোর প্রয়োজন হয়, তাহলে এটাই সবচেয়ে কার্যকর সমাধান। এক্ষেত্রে নির্মাতারা ডলারের মাপের সারি সারি সাদা কাগজের বান্ডিল ব্যবহার করেন, শুধুমাত্র দৃশ্যমান বান্ডিলগুলোর উপরের নোটগুলোর স্থানে আসল ডলার বসিয়ে দেন। কিন্তু সব দৃশ্যে তো আর টাকা এরকম অলসভাবে বসে থাকে না! যখন উপরে বর্ণিত রাশ আওয়ার টু’র মতো দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন হয়, তখন ভিন্ন পথ খুঁজে বের করা ছাড়া উপায় থাকে না।
ব্যাংক থেকে লোন নেওয়া টাকার ব্যবহার!
রাশ আওয়ার টু’র মতো দৃশ্যেও অবশ্য আসল টাকা ব্যবহার করা যায়, কিন্তু সেই টাকা যে প্রযোজককে ঘর থেকেই এনে দিতে হবে, এমন না। উদাহরণ হিসেবে ১৯৭৮ সালের দ্য ব্রিঙ্কস জব সিনেমাটির কথা বলা যেতে পারে। ঐ সিনেমায় বিপুল পরিমাণ টাকার ক্লোজ-আপ দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন ছিল। সিনেমাটির নির্মাতারা স্থানীয় এক ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে নিয়ে আসেন। তারা সার্বক্ষণিকভাবে ঐ টাকার উপর কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করেন এবং নির্দিষ্ট দৃশ্যের শুটিং শেষে কালক্ষেপণ না করে সবগুলো নোট সংগ্রহ করে, গণনা করে পুনরায় ব্যাংকে ফেরত দিয়ে আসেন।
ব্যাংক ছাড়াও অনেক প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান আছে, যারা সিনেমার প্রয়োজনে অর্থের বিনিময়ে আসল টাকা ধার দিয়ে থাকে। বিশেষ করে ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে মুদ্রার দৃশ্যের শুটিং করার সময় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কাজে আসে, যদি তাদের কাছে পুরনো দিনের মুদ্রার সংগ্রহ থাকে।
জাল টাকার ব্যবহার এবং আইনী জটিলতা!
ষাট এবং সত্তরের দশক থেকে হলিউডে প্রপ ইন্ডাস্ট্রিগুলো (সিনেমায় ব্যবহৃত জিনিসপত্র নির্মাণ এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) বিকাশ লাভ করতে থাকে। ফলে সিনেমাতে মুদ্রার ব্যবহারের সংস্কৃতিতেও ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। বর্তমানে অধিকাংশ হলিউড চলচ্চিত্রেই ক্লোজ-আপে যে বিপুল সংখ্যক ডলার দেখানো হয়, সেগুলো আসে এ ধরনের প্রপ ইন্ডাস্ট্রি থেকে, যারা সিনেমার প্রয়োজন অনুযায়ী মিলিয়ন মিলিয়ন জাল ডলার সরবরাহ করে থাকে।
শুরুতে উল্লেখিত রাশ আওয়ার টু’র দৃশ্যটির কথাই ধরা যাক। ঐ সিনেমার জন্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্টুডিও সার্ভিস (Independent Studio Services – ISS) নামের একটি প্রপ হাউজ কয়েকশো মিলিয়ন জাল ডলার সরবরাহ করেছিল। হুবহু জাল ডলার মুদ্রণ করা অবশ্য আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। তাই তারা ডলারের ডিজাইনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো পরিবর্তনও এনেছিল। যেমন ‘In God We Trust’ এর স্থলে তারা প্রিন্ট করেছিল ‘In Dog We Trust’। কিন্তু তারপরেও তারা ঝামেলা এড়াতে পারেনি।
সিনেমাটির শুটিং শেষ হওয়ার পর উপস্থিত এক্সট্রা অভিনেতাসহ অনেকেই সেট থেকে কিছু জাল ডলার পকেটস্থ করে ফেলে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন স্থানীয় দোকানগুলোতে সেই জাল ডলার সফলভাবে চালিয়ে দিতে সক্ষম হয়, তখন সিক্রেট সার্ভিস হানা দেয় আইএসএস স্টুডিওতে। তারা প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১০০ মিলিয়ন জাল ডলার এবং সেই ডলার মুদ্রণের সকল যন্ত্রপাতি বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়!
ঐ ঘটনার পর থেকে প্রপ হাউজগুলো বেশ সাবধান হয়ে যায়। অনেকেই বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৯২ সালের যে কাউন্টারফিট ডিটেকশন আইন আছে, তা মেনে চলে। ঐ আইন অনুযায়ী, কোনো কারণে যদি নকল মুদ্রা ছাপানোর প্রয়োজন হয়, তবে তার আকার হতে হবে আসল মুদ্রার চেয়ে কমপক্ষে ৭৫% ছোট, অথবা ১৫০% বড় এবং শুধুমাত্র একপাশে মুদ্রিত। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যভাবে চিত্রায়নের স্বার্থে অনেকেই এ নিয়ম মানতে চান না। ফলে তারা এমনভাবে জাল ডলার প্রিন্ট করেন, যেগুলো সিনেমার পর্দায় একনজর দেখলে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়, কিন্তু হাতে নিয়ে কাছ থেকে দেখলে সহজেই ধরা পড়ে যায়।
এ ধরনের জাল মুদ্রা প্রস্তুত এবং সরবরাহকারী একটি প্রপ হাউজ হচ্ছে আরজেআর প্রপস। দ্য উলফ অব ওয়াল স্ট্রিট, দ্য ফাস্ট অ্যান্ড দ্য ফিউরিয়াস, ফার্গো, দ্য ডার্ক নাইট, দ্য হ্যাংওভারসহ বিশ্বের অনেক নামকরা চলচ্চিত্র এবং ধারাবাহিক তাদের মুদ্রিত জাল ডলার ব্যবহার করেছে। তারা প্রধানত দুই ধরনের মুদ্রা সরবরাহ করে।
একটি হচ্ছে স্ট্যান্ডার্ড গ্রেড, যেগুলোকে ১৫ ইঞ্চি দূর থেকে দেখলেও আসল বলে মনে হবে, কিন্তু এর বেশি কাছে আনলেই এদের ত্রুটিগুলো ধরা পড়ে যাবে। আরেকটি হচ্ছে হাই কোয়ালিটি গ্রেড, যেগুলো একেবারে ক্লোজ-আপ থেকে দেখালেও আসল বলে মনে হবে। স্ট্যান্ডার্ড গ্রেড কাগজের উভয় পার্শ্বে প্রিন্ট করলেও আইনী ঝামেলা এড়ানোর জন্য তারা হাই কোয়ালিটি গ্রেডের শুধুমাত্র এক পার্শ্বে প্রিন্ট করে।
আরজেআর প্রপসের স্ট্যান্ডার্ড গ্রেডের ডলারগুলোরও আকার এবং গুণগত মান আসল ডলারের খুব কাছাকাছি হয়। কিন্তু এর ডিজাইনে যথেষ্ট ভিন্নতা রাখা হয়। যেমন 100 এর নিচে যেখানে United States Federal Reserve লেখা থাকার কথা, সেখানে তারা লিখে রাখে Unreal Fake Currency Reserve। United States এর স্থলে তারা লেখে Wnted States। এমনকি সেক্রেটারি অব ট্রেজারির স্বাক্ষরের স্থলে যে নামটা তারা ব্যবহার করে, সেটি হচ্ছে Ima Not Real এবং Not Real Currency!
শুধু আরজেআর প্রপস একা না, এরকম প্রতিষ্ঠান আরও অনেক আছে। প্রপ মুভি মানি এরকমই আরেকটি প্রতিষ্ঠান, যাদের মুদ্রিত জাল টাকা ব্যবহৃত হয়েছে অ্যানিমেল কিংডম, জন উইক, স্পাইডার-ম্যান হোমকামিং এবং নেটফ্লিক্সের নার্কোসসহ বিভিন্ন মুভি ও সিরিয়ালে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন অনুযায়ী ৫, ১০,২০, ১০০ সহ সব ধরনের নোটই সরবরাহ করে। সিনেমায় ব্যবহৃত অন্যান্য জিনিসপত্র সাধারণত ধার দেওয়া হলেও জাল টাকাগুলো ধার দেওয়া হয় না। সেগুলো একেবারেই বিক্রয় করে দেয়া হয়।
এ ধরনের টাকার খরচও কিন্তু কম না। উদাহরণস্বরুপ, আরজেআর প্রপসের ১০০ ডলারের এক বান্ডিল নোটের (১০,০০০ ডলার) মূল্য স্ট্যান্ডার্ড গ্রেডের ক্ষেত্রে ৪৫ ডলার এবং হাই কোয়ালিটি গ্রেডের ক্ষেত্রে ৬০ ডলার। যদি ব্যবহৃত জাল টাকার প্রয়োজন হয়, তবে প্রিন্ট করার পর প্রতিটি নোটকে হাতে দুমড়ে-মুচড়ে পুরাতন করে সরবরাহ করা হয়। ফলে সেগুলোর দাম বান্ডিল প্রতি আরও ২০ ডলার করে বৃদ্ধি পায়।
যেসব মুভিতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের ক্লোজ-আপ দৃশ্য দেখানোর প্রয়োজন হয়, তাদেরকে এই নকল টাকার পেছনেই খরচ করতে হয় বিপুল পরিমাণ আসল টাকা। কিন্তু দিনে দিনে ক্যামেরা যেরকম উন্নত হচ্ছে, মানুষ ঘরে বসে মুভি দেখার সুবাদে ইচ্ছেমতো পজ এবং জুম করে খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানে দর্শকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা ধরে রাখার জন্য এ ছাড়া উপায় কী!