আমরা সাধারণত ভাবি যে, মানব শরীর সম্পূর্ণ প্রকৃতির দ্বারা সৃষ্ট একটি ব্যাপার। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমাদের শরীরের গঠনের সাথে সংস্কৃতিও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বিশেষ করে নারীদের শরীরের গঠনে। অর্থাৎ পুরো পৃথিবী জুড়ে যেসব সংস্কৃতি আছে সবগুলোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে যে মানুষের শরীর কিভাবে নতুন করে ঢেলে সাজানো উচিৎ। নারীদের উপর এর প্রভাব, আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে কুপ্রভাব, পড়েছে সবচেয়ে বেশি। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ কাজ করেছে, কখনো আদর্শ শারীরিক গঠন দিয়ে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারিত হয়েছে, কখনো নারীকে বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতীক দিয়ে আদর্শ নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, আবার কখনো শুধুমাত্র নিজ স্বার্থ চরিতার্থের জন্যই। যেমন ধরা যাক পশ্চিমা বিশ্বের ফ্যাশন শিল্পের কথাই। নারীদের শরীরের আকার কেমন হওয়া উচিৎ তা পশ্চিমা ফ্যাশন দুনিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের পোশাক ও অন্তর্বাসের ধরনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে নির্দেশ করে আসছে। তারা সবসময়েই নারী শরীরকে এমন একটি সত্ত্বা হিসেবে বিবেচনা করেছে যাকে চাইলেই যেকোন রূপ দেয়া যায়, যা সমাজের জটিল প্রথা মেনে বা নেহায়েতই ফ্যাশনের খামখেয়ালী ঝোঁকে পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে অনেক সচেতন গবেষণার ফলাফলে এটি স্পষ্ট যে রুচিসম্মত শারীরিক গঠন বা আদর্শ শারীরিক গঠন বলে যা যুগের পর যুগ ধরে চলে আসছে তা মূলত সংস্কৃতির ভ্রান্ত চিন্তার ফলাফল।
বিভিন্ন কারণে ও বিভিন্নভাবে নারী শরীরের ও অঙ্গের “আদর্শ” মাপকাঠি সমাজ নির্ধারণ করেছে যার কিছু বেশ পীড়াদায়কও বটে। ১৮ শতকের দিকে পশ্চিমা বিশ্বে ফ্যাশনেবল শরীর ব্যাপারটা কেবল অভিজাতদেরই মাথাব্যাথার কারণ ছিল। ফিতাযুক্ত শরীরবন্ধনী যা Stays নামে পরিচিত ছিল, তা অপরিহার্য পরিধেয় হিসেবে গণ্য করা হত। বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র সরু দেখানোর জন্যে যে তা পরা হত তা নয়, বরং এর পেছনে জাতিগত ও নারীর শরীরের সাথে সম্পর্কিত আরো জটিল কিছু সাংস্কৃতিক ধারণা জড়িয়ে আছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাস সবসময়েই ছিল যে নারী শরীর সহজাতই দুর্বল এবং তার সহায়তা প্রয়োজন। আর স্টেস (Stays) তার শরীরের জন্য এক স্বতন্ত্র দৃঢ় বাহনের সৃষ্টি করে। এই অস্বস্তিদায়ক পোশাকটি পরা অবস্থায় বেশ আভিজাত্যপূর্ণ চলনভঙ্গি আয়ত্ত করতে পারাকে শিষ্টাচারের লক্ষণ হিসেবে ধরা হত। তৎকালীন বেশ কয়েকজন প্রসিদ্ধ লেখক ও চিন্তাবিদদের দ্বারা ব্যাপারটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল। সামাজিক প্রথা দ্বারা ব্যক্তি বিশেষকে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে রাখাকে রূপকঅর্থে পোশাকটিকে তুলনা করা হয়। তবে এসব চিন্তাধারার সমাজের ওপর তেমন বিশেষ প্রভাব পড়েনি।
কোমর আঁটা উপরিভাগের উদ্দেশ্য অর্থাৎ শরীরের উপরের অংশে মনযোগ আকর্ষণের সবচেয়ে সুবিধাজনক পদ্ধতি ছিল নিচের অংশ অর্থাৎ পায়ের দিকটা যথাযথভাবে ঢেকে রাখা। কেননা পশ্চিমা সংস্কৃতিতে নারী শরীরের উপরিভাগকেই “মূল্যবান” হিসেবে বিবেচনা করা হত। তাই ১৮৪৫-৭০ সাল পর্যন্ত প্রচলন ছিল বৃহদায়তনের ক্রিনোলিন, যা শরীরের নীচের অংশকে সম্পূর্ণভাবে চোখের আড়াল করে রাখত।
পোশাকের এই ধরণটি মধ্যবিত্ত থেকে একটু উপর দিকে উঠতি সম্প্রদায়ের জন্য তাদের নতুন সম্পদ জাহির করার উপযুক্ত উপায় ছিল। পুরুষদের বেশভূষা এই সময়টায় অপেক্ষাকৃত সাদামাটা হলেও যদি কোনো ব্যক্তি তার স্ত্রীকে ক্রিনোলিনে সজ্জিত করতে পারত যাতে অনেক বেশি পরিমাণে কাপড় ও তা ধরে রাখার জন্য ভৃত্য নিযুক্ত করতে পারত, তবে তা তার প্রচুর পরিমাণে উপার্জনকে নির্দেশ করত।
এরপর এলো পেছন দিকটা যাতে আকর্ষণীয় দেখায় তার চল। ১৮৭০ এর পরের সময়ে নারীরা পোশাকের নিচে পেছনদিকে এক ধরণের উঁচু প্যাড ব্যবহার শুরু করল, যা বাসেল (Bustle) নামে পরিচিত। তদ্দিনে পোশাকের বিভিন্ন ধরণ অভিজাত শ্রেণী থেকে সাধারণ শ্রেণীতে প্রচলিত হতে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ নারী শরীরের আদর্শ মাপকাঠি অভিজাত থেকে সাধারণের মনেও ঢুকতে শুরু করেছে। তাই অনেক সক্রিয় কর্মী ও ডাক্তারদের সাবধানবাণীর তোয়াক্কা না করেই ক্ষতিকর শরীরবন্ধনী কেনা শুরু করল সাধারণ নারীরাও।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে শৈল্পিক পোশাক বেশ আলোড়ন তোলে। শরীরবন্ধনীর কয়েদ থেকে নারীদের মুক্তি দিতে অভিজাত ও ঢোলা গাউনের আবির্ভাব ঘটে। শিল্প মহলে পোশাকের এই ধরণ বেশ সমাদৃত হলেও সাধারণ জনগণের কাছে তা একটু অদ্ভুতই গণ্য হল। কেননা ততদিনে তাদের মাথায় নারী শরীরের একটি নির্দিষ্ট নমুনা গেঁথে গেছে। এমনকি যারা আগ্রহী হয়ে নতুন ধরনের পোশাকটি কিনত, তারা তা বাইরে পরত না, বাসাতে পরাই সীমাবদ্ধ রাখত।
১৯২০ সালের দিকে নতুন ধরণ ‘ফ্ল্যাপার স্টাইল’ আসার পর শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে রাখা পোশাক আবেদন হারাতে শুরু করে। ফ্ল্যাপার স্টাইল মূলত তুলনামূলক চওড়া কাঁধ আর অপেক্ষাকৃত সরু কোমরের সন্নিবেশ। অনেকেই ভাবতে থাকেন এবার শরীরবন্ধনী বা করসেট থেকে নারী মুক্ত হবে। কিন্তু নতুন ধরনের শরীরের আকৃতিও কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্টি করা হত কোমরে আটোসাটো বন্ধনী দিয়ে কোমরকে যতটা সম্ভব সরু করা যায় তার মাধ্যমেই। তবে হ্যাঁ, এই পদ্ধতি শরীরবন্ধনীর চেয়ে আরামদায়ক ছিল বটে।
১৯৩০ এর দিকে সরু কোমরের জনপ্রিয়তা থাকলেও কিছু পোশাক শিল্পী চিরাচরিত ‘ফ্যাশনেবল’ শরীরের বাইরে অপেক্ষাকৃত স্থূল শরীরের নারীদের জন্যও পোশাক তৈরী করতেন। তখনকার সময়ের কিছু পোশাকে ৩১ ইঞ্চি কোমরের মাপ দেখে এমনটাই বোঝা যায়।
১৯৪০ ও ১৯৫০ সালের দিকে সরু কোমরের চল কমে গিয়ে একটি নতুন ভঙ্গিতে নারী শরীরকে দেখা শুরু করে পোশাক শিল্পীরা, যেই ধারণানুযায়ী শরীরের উর্ধাংশ ও কোমরের মাপে আগের চেয়ে পার্থক্য চোখে পড়ে। ১৯৬০ সালের দিকে পুনরায় একটু চওড়া কাঁধ ও বালকসুলভ পোশাকের চল শুরু হয় এবং সেটাই ফ্যাশন হিসেবে গণ্য হয়।
এর মধ্যেই শরীরবন্ধনী ও কটিবন্ধনীর ব্যবহার কমতে কমতে বিলুপ্তপ্রায় হলেও ১৯৭০ ও ‘৮০ এর দিকে নারীদের শারীরিক সৌন্দর্য বর্ধনের উপায় হিসেবে শুরু হয় খাবার নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিক কসরতের চল। অর্থাৎ এবার আর কৃত্রিম উপায়ে শরীরকে সঠিক আকৃতি দেয়া নয়, পরিমাণে কম খেয়ে বা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে প্রকৃতপক্ষেই শরীরকে সরু আকৃতি দিতে হবে। কিন্তু এর সাথে যুক্ত হয় ফ্যাশন ম্যাগাজিনগুলোর আদর্শ শরীরের নিজস্ব ধারণা। তারা মডেল হিসেবে এমন মেয়েদের ছবি প্রকাশ করতে থাকে যাদের শরীর ও বক্ষের আকারের অনুপাত উল্লেখযোগ্য অসামঞ্জস্যতা প্রকাশ করে। এই ধরণের শারীরিক আকৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিক সার্জারি দ্বারা পাওয়া সম্ভব। যার কারণে সেই সময়ে অবস্থাসম্পন্ন নারী বা গণমাধ্যমে কাজ করা মডেল ও নায়িকাদের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জারির একটি প্রচলন শুরু হয়। আর সাধারণ মেয়েরা ভুগতে থাকে হতাশায়, আদর্শ শারীরিক আকৃতি না পাওয়ার হতাশা।
১৯৯০ থেকে আবার শুরু হয় অতিরিক্ত পাতলা শারীরিক আকৃতির ফ্যাশন, গণমাধ্যমের কল্যাণে যা ‘জিরো ফিগার’ নামে পরিচিত। মূলত পশ্চিমা পোশাক শিল্পের নারী শরীরের এহেন চিন্তা ধারা যুগের পর যুগ ধরে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সমাজকে নারী শরীরের আদর্শ রূপের একটি ভ্রান্তিমূলক ধারণা দিয়ে আসছে। সমাজের প্রতিষ্ঠিত এই ধারণা থেকে ন্যূনতম বিচ্যুতি নারীদের জন্য বিপুল পরিমাণ হতাশা ও প্রত্যাখ্যানের গল্প তৈরী করেছে সমাজে। এখনো এই সংখ্যা খুব কম নয়। ২০১৬ তে ‘ডাভ’ একটি জরিপ করে, ১৩টি দেশের কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীর উপর, যাদের বয়স ১৩ থেকে ৬০ এর মধ্যে। জরিপের বিষয় ছিল কতজন নারী তাদের শারীরিক সৌন্দর্য ও আকৃতি নিয়ে সন্তুষ্ট ও আত্মবিশ্বাসী। দেখা যায়, সেই সংখ্যা ২০ শতাংশের বেশি নয়। অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী নারীরা তথাকথিত আদর্শ শরীরের জন্য হতাশায় ভুগছে, নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারছে না, কারণ সমাজের চোখে সে ‘আদর্শ নারী’ হয়ে উঠতে পারেনি।
এভাবেই দিনের পর দিন পোশাকের বৈচিত্র্যের আড়ালে নিজের শারীরিক আকৃতি নিয়ে প্রতিনিয়ত হীনম্মন্য করা হয়েছে নারীদের। নারী যে শারীরিক সৌন্দর্যের বাইরেও এক আলাদা স্বত্ত্বা, নিজেকে চাইলেই সে যেকোনো মূহুর্তে সুন্দর ভাবতে পারে সেই ধারণাই কেড়ে নেয়া হয়েছিল অনেকটা সময় ধরে। এখনো অনেকেই সেই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, তথাকথিত আদর্শ শরীরের প্রত্যাশায় নিজেকে কষ্ট দিচ্ছে শারীরিক ও মানসিকভাবে। এমন ধারণা সমাজের মধ্যে ঢোকানোর পেছনে পশ্চিমা পোশাক শিল্পের বেশ বড়সড় ভূমিকাই লক্ষ্য করা যায়।
আশার ব্যাপার হলো, স্রোতের বিপরীতে হাটা নারীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। নিজের শরীরকে তথাকথিত আদর্শের মাপকাঠিতে না ফেলে বীরদর্পে এগিয়ে যাওয়া, এবং শুধু সৌন্দর্য নয়, বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সাফল্য পাওয়া নারীরাই হওয়া উচিৎ সমাজের ও নারীদের নিজেদের কাছেও ‘আদর্শ’।