মানবসভ্যতা যতটা পুরনো, যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাসও সম্ভবত ততটাই পুরনো। ঠিক সেই কারণেই কখন প্রথম দুই দল মানুষ পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল সেটা বলা প্রায় অসম্ভব। লিখিত ইতিহাসের সূচনা আজ থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে, তাও সংগঠিত আকারে আমাদের জানা ইতিহাসের আকারে আসতে আসতে আরো প্রায় এক-দেড় হাজার বছর লেগে যায়।
এই লম্বা সময়ে সংঘটিত যুদ্ধের ব্যাপারে জানা গেলেও বিস্তারিত বিবরণ তাই পাওয়া যায় না। এজন্য অপেক্ষা করতে হয় ইতিহাসের পাতায় আনুষ্ঠানিকভাবে লিখিত প্রথম যুদ্ধ ‘ব্যাটল অব মেগিড্ডো’ পর্যন্ত, যার সময় ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। তৎকালীন ফারাও তৃতীয় থুতমোসের সম্মানে নির্মিত থিবসের মন্দিরে বিস্তারিতভাবে লিখে রাখা হয় এই কীর্তির কথা।
মেগিড্ডো
মিশর আর মেসোপোটেমিয়ার মধ্যবর্তী বাণিজ্যপথের ওপর কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছে প্রাচীন শহর মেগিড্ডো। তখনকার দিনে এই এলাকাকে বলা হতো কানান। বর্তমান হাইফার দক্ষিণ-পূর্বে নাজারেথের কাছে ইসরায়েলের জ্যাজরেল উপত্যকার উপরে অবস্থিত মেগিড্ডোর নিয়ন্ত্রণ তাই মিশর আর প্রাচ্যের মধ্যে যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল একসময়। এজন্য উঁচু পাঁচিল আর দুর্গবিশিষ্ট মেগিড্ডোর নিরাপত্তাব্যবস্থাও ছিল খুব শক্ত।
একসময় মেগিড্ডোর অঞ্চলে ফারাওদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া সাম্রাজ্য হারিয়ে ফেলেছিল তার আগের ক্ষমতা। এমনকি নিজের দেশের একাংশও দখল করে নিয়েছিল বহিঃশত্রু। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় অভিজাতেরা স্বাধীনভাবে মেগিড্ডো শাসন করতো, ফারাওয়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতো নামমাত্র।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫ শতকে মেসোপোটেমিয়া ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু রাজ্য অত্যন্ত ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে ছিল হিট্টাইট, মিটান্নি আর কাসাইটরা। মিশরের সামরিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো শক্তি স্থানীয় নগররাষ্ট্রগুলোর না থাকলেও এই রাজ্যগুলোর ছিল। মেগিড্ডো ও তার আশেপাশের এলাকার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল তাদেরও। ফলে ফারাও তৃতীয় থুতমোস যখন মিশরের পুরনো প্রতিপত্তি ফিরিয়ে আনতে যুদ্ধাভিযান আরম্ভ করেন, মেগিড্ডো তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয় থুতমোস
ক্ষমতাশালী মিশর তখন ভঙ্গুর, সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে হিক্সোসরা (পশ্চিম এশিয়া থেকে আগত লোকেরা) ফারাও উপাধি গ্রহণ করেছে। প্রথম আহমোস তাদের তাড়িয়ে সাম্রাজ্য একীভূত করেন, পত্তন করেন নিউ কিংডম অব ইজিপ্টের। এর স্থায়িত্ব ছিল আনুমানিক ১৫৭০-১০৬৯ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত।
আহমোসের বংশধর ছিলেন দ্বিতীয় থুতমোস। তার এক সঙ্গিনীর গর্ভে (আইসিস বা আইলেট) জন্ম নেন তৃতীয় থুতমোস। দ্বিতীয় থুতমোস যখন মারা যান, তখন তার ছেলের বয়স সবে দুই (মতান্তরে আট) । শিশু রাজা আইন অনুযায়ী ফারাও হলেন, তবে তার প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নেন রানী হাশেপ্সুত (Hatshepsut)।
প্রশাসক হিসেবে হাশেপ্সুত ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তিনি মিশরকে যুদ্ধবিগ্রহ থেকে দূরে রেখেছিলেন, তবে চালিয়ে গিয়েছিলেন সামরিক বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি। তার দক্ষ নেতৃত্বে থুতমোসের সিংহাসনে আরোহণ কোনো ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হয়। নতুন ফারাওকে পাঠিয়ে দেয়া হয় থিবসে, সেখানে তিনি যুদ্ধবিদ্যা ও রাজকার্য শিখতে থাকেন।
হাশেপ্সুত মারা গেলে থুতমোসের হাতে পুঞ্জীভূত হলো পরিপূর্ণ ক্ষমতা। পরবর্তী বিশ বছরে তিনি অন্তত ১৭টি সফল যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন। তার প্রথম এবং সম্ভবত সবচেয়ে বিখ্যাত যুদ্ধ ‘ব্যাটল অব মেগিড্ডো’ নামে খ্যাত।
যুদ্ধের পটভূমি
হিট্টাইট, মিটান্নি আর কাসাইটদের ক্রমবর্ধমান রাজ্য সম্প্রসারণ হুমকি হয়ে এসেছিল মিশরের জন্য। ফারাওয়ের সেনারা সিরিয়া আর ইরাকের এলাকায় অভিযান চালায়, প্রচুর ধনসম্পদ লুটে নিয়ে আসে। কানানের অনেক নগররাষ্ট্র বাধ্য হয় তাদের বশ্যতা স্বীকারে।
মিটান্নিদেরও নজর ছিল কানানে। তারা তলে তলে নগররাষ্ট্রগুলোকে বিদ্রোহের ইন্ধন দিতে থাকে, উদ্দেশ্য মিশরের ক্ষমতা হ্রাস করা। মিটান্নিদের সমর্থন পেয়ে এরা সৈন্য ও সমরাস্ত্র জড়ো করে, তবে বিদ্রোহের ঘোষণা দেয়ার জন্য দরকার ছিল উপযুক্ত সময়ের।
কাঁচা বয়সের অনভিজ্ঞ ফারাও তৃতীয় থুতমোস যখন এককভাবে ক্ষমতায় বসেন, তখন তারা সেই ক্ষণ উপস্থিত বলে মনে করল। কানানের বিভিন্ন শহর মিশরের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণা করে, তাদের নেতৃত্বে কাদেশের রাজা (মতান্তরে রাজপুত্র), দুরুশা। তার অধীনে সম্মিলিত সেনাবাহিনীতে ছিল প্রায় ১০,০০০-১৫,০০০ লোক।
দুরুশার অন্যতম মিত্র মেগিড্ডো। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে এখানে ঘাঁটি করলেন কাদেশের রাজা। লক্ষ্য মিশরের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটানো। আবার মেগিড্ডোতে তার উপস্থিতি কানানের ভেতরের দিকে থাকা অন্যান্য শহরের জন্য রক্ষাকবচের কাজ করছিল। ফলে থুতমোস বুঝলেন আগে মেগিড্ডোর ব্যবস্থা না করলে লাভ নেই।
রণপ্রস্তুতি
থিবসে জড়ো করা হলো প্রায় ২০,০০০ সৈন্য। শুভদিনে থুতমোস নিজেই তাদের নেতৃত্ব দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। সময়টা তার রাজত্বের ত্রয়োবিংশ বছর, ১৪৭৯ (মতান্তরে ১৪৮২/১৪৫৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। দশ দিনে প্রায় দেড়শো মাইল অতিক্রম করে তারা গাজায় একরাত যাত্রাবিরতি করলেন, এরপর চলে যান ইয়েহেম শহরে।
ইয়েহেম থেকে মেগিড্ডো বেশি দূরে নয়। দুই শহরের মাঝে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণী। ফারাওয়ের চরেরা খবর আনল- তিনটি পথ দিয়ে যাওয়া যায় সেখানে। পাহাড়ের উত্তর ও দক্ষিণ দিক দিয়ে দুটি প্রশস্ত রাস্তা, একটু ঘুরপথ হলেও স্বচ্ছন্দে সেনাদল নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তৃতীয় পথ পাহাড়ের মাঝ দিয়ে সংকীর্ণ গিরিখাদ। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত, কিন্তু বিপদজনক পথ। সেনাদের পার হতে হবে এক লাইন করে, যুদ্ধরথ টেনে নেয়া সম্ভব না। শত্রুরা এখানে অ্যাম্বুশ পেতে রাখলে খুব সহজেই ধ্বংস করে দিতে পারবে তাদের।
থুতমোস তার জেনারেলদের সাথে আলাপ করলেন। সবাই মতামত দিলেন উত্তর বা দক্ষিণের যেকোনো একটা রাস্তা বেছে নিতে। ফারাও ধারণা করলেন- জেনারেলরা যা বলছেন, সেটা তার শত্রুরও মাথায় আসবে, তাই তিনি নির্দেশ দিলেন গিরিখাদ ধরে যাবার।
ফারাওয়ের চিন্তা ছিল শতভাগ সঠিক। কাদিশের রাজা তার পদাতিক সেনাদের রেখেছিলেন উত্তর আর দক্ষিণ পথের পাহারায়, রথবাহিনী ছিল মেগিড্ডোর সামনে। তার পরিকল্পনা উত্তর বা দক্ষিণ দিক থেকে ফারাও অগ্রসর হলে পদাতিকেরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে তাদের টেনে নিয়ে আসবে রথবাহিনীর কাছে, এরপর সম্মিলিত সেনাদল বিপুল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়বে মিশরীয়দের ওপর।
দারুশের অল্প কিছু লোক ছিল গিরিখাদে। ফারাওয়ের একটি অগ্রবর্তী বাহিনী তাদের কচুকাটা করে ফেলে। এরপর মূল বাহিনী একসারিতে পার হয়। অশ্বারোহীরা ঘোড়ার লাগাম ধরে হেঁটে যেতে থাকে, যুদ্ধরথের বিভিন্ন অংশ আলাদা করে খুলে নিয়ে বয়ে নিয়ে যায় সৈনিকেরা। নিরাপদেই এরপর মেগিড্ডোর পাশে কিনা উপত্যকায় পৌঁছে যান থুতমোস।
কাদেশের রাজা ভাবতেই পারেননি এমন কিছু করবে মিশরীয়রা। ফলে থুতমোসের লোকেরা যখন কিনায় শিবির করলো, ভয়ঙ্কর এক ধাক্কা খেলেন তিনি। বানচাল হয়ে যায় তার আগের পরিকল্পনা, দ্রুত তিনি সমস্ত সেনা ডেকে আনেন মেগিড্ডোর দিকে। শহরের দুর্গের সামনে উঁচু জায়গায় শিবির করে তারা।
লড়াই
পরদিন সকালে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় দু’পক্ষই। তৎকালীন মিশরীয়দের হিসেবে সেটা ছিল তৃতীয় মৌসুমের প্রথম মাস, তৃতীয় থুতমোসের রাজত্বের ২৩ তম বছর।
থুতমোস অনেকটা বাঁকা চাঁদের মতো করে সাজান তার সেনাদল। নিজে থাকলেন মধ্যভাগে, চাঁদের পেটের দিকে। বামবাহু কিনার পার্শ্ববর্তী এক পাহাড়ে আর ডানবাহু পড়েছে মেগিড্ডোর উত্তর-পশ্চিমে। তিনি দেখতে পেলেন শত্রুরা তখনও নিজেদের গুছিয়ে উঠতে পারেনি। তিনি রথচালকদের নির্দেশ দিলেন আক্রমণের, একইসাথে ডান আর বামবাহুকে এগিয়ে আসতে বলা হলো।
দুই দলেরই রথের সংখ্যা ছিল প্রায় হাজারখানেক। তবে কাদিশের রাজার বাহিনী তখনও বিশৃঙ্খল। ফলে মিশরীয়দের আঘাতে বেসামাল হয়ে পড়ে তারা। অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে পড়ে তাদের ব্যূহ। শত্রুদের প্রায় ৮,০০০ নিহত আর ৩,৪০০ সৈন্য আহত হয়, ফারাওয়ের হতাহত ছিল ৫,০০০।
দারুশ আর অবশিষ্ট সৈনিকরা পালিয়ে যায় শহরের দিকে। ততক্ষণে নগরপ্রাচীরের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ভেতরে থাকা লোকেরা দড়ি ফেলে সবাইকে টেনে নেয় দেয়ালের উপর দিয়ে। ফারাও যদি সেই সময় হামলা করতেন, তাহলে শত্রুদের একেবারে নির্মূল করে দেয়া সম্ভব ছিল, তখন শহরের পতন সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত। কিন্তু বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত মিশরীয় সেনারা তখন লুটপাটে মত্ত, ফলে সুবর্ণ এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়।
এর মূল্য চুকাতে হয় প্রায় সাত মাসের লম্বা অবরোধের মাধ্যমে। এই সময় কাদিশের রাজা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, ফলে চলতে থাকে কানানের বিদ্রোহ। অবশেষে যখন মেগিড্ডোর দরজা ফারাওয়ের সামনে খুলে যায়, তিনি তখন নমনীয় নীতি গ্রহণ করেন। ফারাওয়ের প্রতি শর্তহীন আনুগত্যের শর্তে শহরের রাজা আর নাগরিকদের প্রাণভিক্ষা দেয়া হয়।
প্রভাব
মেগিড্ডোর বিজয় থুতমোসকে শক্তিশালী ফারাও হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। এর মাধ্যমে কানানের উত্তরাংশে মিশরীয় আধিপত্যের সূচনা করেন তিনি। মেসোপোটেমিয়ার সাথে বাণিজ্যপথ নিষ্কণ্টক হওয়ায় মিশরের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।
তবে কাদেশের রাজা পালিয়ে যাওয়ায় বিদ্রোহ পুরোপুরি শেষ হয়নি। মিটান্নিদের সাথে মিলে তিনি আরো অনেক বছর থুতমোসের পথের কাঁটা হয়ে থাকেন। যদিও ফারাও সিরিয়ার বিস্তির্ণ এলাকা দখল করতে সক্ষম হন, মিটান্নিদের কখনোই পুরোপুরি পরাজিত করা যায়নি।
আধুনিককালে অবশ্য মেগিড্ডোর পরিচিতি লিখিত ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে নয়, বরং বাইবেলে (বুক অব রিভিলেশন ১৬:১৬) বর্ণিত শুভ এবং অশুভের চূড়ান্ত লড়াইয়ের ক্ষেত্র বা আর্মাগেডন হিসেবে। আর্মাগেডন প্রকৃতপক্ষে মেগিড্ডোর গ্রীক নাম।