পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ছোট্ট ছোট্ট দ্বীপগুলো অপার সৌন্দর্যের পসরা নিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এমনই এক সুন্দর দ্বীপের কথা আজ আমরা জানবো। দ্বীপটির নাম মেক্সিক্যান ভাষায় “ইস্লা দ্যা লাস মিউনিকাস” বা “আইল্যান্ড অব দ্যা ডলস”।
মেক্সিকো সিটি থেকে ২৮ কি.মি. দূরে দক্ষিণে জোচিমিকো ক্যানালের মাঝেই এই দ্বীপটি উঁকি দিয়ে যায়। জোচিমিকো একটি কৃত্রিম দ্বীপ। অপার সৌন্দর্যে বেষ্টিত হলেও এই দ্বীপটি কিন্তু টুরিস্ট ভূমি হয়ে উঠতে পারেনি ঠিকমত। কারণ দ্বীপটি একদিকের যেমন নীলাভ বিস্তৃত জলরাশির জন্য খ্যাত তেমনি অপর দিকে এই দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে ভয়ঙ্কর অদ্ভুত সব কাহিনী যা দ্বীপটির নামকরণকে দিয়েছে স্বার্থকতা। দ্বীপটির নামকরণের পিছনে রয়েছে রহস্যময় এক অতীত।
বছর পঞ্চাশ আগের এক সত্যি ঘটনা থেকে যার উৎপত্তি। দ্বীপটিতে রয়েছে হাজার খানেক লোকের বসবাস। জোচিমিকো অধিবাসীদের তথ্য মতে, এই দ্বীপের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের এক কিশোরী পুতুল নিয়ে খেলতে গিয়ে দ্বীপের জলে ডুবে মৃত্যু হয়। এই কিশোরীর মৃত্যুর কিছুদিন পর এই দ্বীপে ঘটতে থাকে অদ্ভুত যত ঘটনা। নির্জন দুপুরে বা একটু সন্ধ্যা নেমে আসলেই এই দ্বীপের অধিবাসীরা শুনতে পান এক কিশোরীর কান্নার ধ্বনি। কখনো হাসির আওয়াজ।
জেলেরা মাছ ধরে ফেরার পথে শুনতে পান কোন বাচ্চার অদ্ভুত সব ফিসফিসানি। স্থানীয়দের দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাতে থাকে, অপঘাতে মৃত কিশোরীর আত্মাই এর জন্য দায়ী। এরপর দ্বীপের অধিবাসীরা এমন এক অদ্ভুত কাজ করলো যা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে। এই ভৌতিক উপদ্রবকে ঠেকাতে আদি-বাসিন্দারা এমন এক উপায় অবলম্বন করলেন যাতে দ্বীপটি হয়ে উঠলো আরও ‘ভুতুড়ে’। মৃত আত্মাকে তুষ্ট করতে দ্বীপবাসীরা দ্বীপের সব গাছে পুতুল ঝোলাতে শুরু করেন। সেই থেকে গোটা দ্বীপটিতে আজ অসংখ্য পুতুলের ছড়াছড়ি।
আত্মার শান্তি কামনার জন্য গাছের ডালে ডালে পুতুল ঝোলানোর এই রীতি আরও দৃঢ়ভাবে প্রচলিত হতে শুরু করে ২০০১ সাল থেকে। সময় যত গড়িয়েছে হাজার হাজার পুতুল ঝুলানো গাছের সাথে সাথে শত শত পুতুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য ঝোপঝাড়ের আড়ালে। রোদে পুড়ে- বৃষ্টিতে ভিজে পুতুলগুলোর চেহারাই হয়ে দাঁড়িয়েছে হরর ছবির ভুতুড়ে পুতুলের মতো। এখন চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে পুতুলগুলোর বিচ্ছিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের অংশ বিশেষ, শূন্য দৃষ্টি যুক্ত বিচ্ছিন্ন মস্তক যা হলিউডের ভয়ঙ্কর সব মুভির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এখানেই শেষ নয়, এই সব পুতুলগুলিকে ঘিরেও নানান ভৌতিক কাহিনী রচনা করেছেন স্থানীয়রা। তাদের কথায়, রাতের অন্ধকারে নাকি পুতুলরা জীবন্ত হয়ে ওঠে, তারা ফিস ফিস করে কথা বলে নিজেদের মধ্যে! লোক-কাহিনী আছে যে, পুতুলগুলোর বিচ্ছিন্ন অঙ্গ- প্রত্যঙ্গের অংশ বিশেষ, বিশেষত মাথা- হাত-পা নাকি মাঝে মাঝে নড়াচড়া করতে দেখা যায়। অনেক সময় পুতুলগুলোর চোখ খুলতে ও বন্ধ করতেও কেউ কেউ দেখেছেন বলে জাহির করেন। তাছাড়া অনেক সময় শোনা যায় যে, পুতুলগুলো নাকি দ্বীপের সন্নিকটে কোন বোট যেতে দেখলে বোটের লোকগুলোকে ঈশারায় দ্বীপে নামতে বলে। সত্যিকার অর্থে, ভর দুপুরেও পুতুলগুলো ভীষণ আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে।
এই অঞ্চলের স্থানীয় লোকদের একজন ডন জুলিয়ান স্যান্টানা ব্যারেরা এমন এক কাহিনী পর্যটকদের মধ্যে জন্ম দিয়েছেন যা এক কথায় লোমহর্ষকর। জুলিয়ান ছিলেন এই আইল্যান্ডের কেয়ার টেকার। তার বলা গল্পটি এখানে বহুল জনশ্রুত। একদিন জুলিয়ান রহস্যজনকভাবে ভেসে আসা এক বালিকাকে খুঁজে পান। অনেক চেষ্টা করেও তিনি মেয়েটির প্রাণ বাঁচাতে পারলেন না। মেয়েটির সাথে তিনি একটি খেলার পুতুলও ভেসে আসতে দেখেছিলেন। মেয়ে শিশুটির মৃত্যুতে জুলিয়ান এতই শোকাকূল হয়ে পড়েন যে শিশুটির মৃত আত্মার শান্তি কামনায় তার খেলার পুতুলটি নিকটবর্তী একটি গাছে ঝুলিয়ে দেন। এলাকাবাসীর অনেকের ধারণা যে, জুলিয়ানের একাকীত্ব থেকেই তিনি অজান্তেই এই গল্প সৃষ্টি করেছিলেন।
যাই হোক, ধীরে ধীরে জুলিয়ান মৃত শিশুটির অন্তরাত্মার খোঁজে আরও পুতুল ঝুলানো শুরু করলেন। তার ধারণা হতে শুরু করে যে এতে মৃত শিশুটির আত্মা শান্তি পাচ্ছে। এও দাবি করে বসেন যে তিনি রাতের আঁধারে ঐ মেয়ের কান্না শব্দ শুনতে পান, এমনকি মেয়েটির পদাঙ্ক তার অগোচরে থাকে না। ক্রমে জুলিয়ানের কাছের মানুষদের মনে হতে থাকে যে অদৃশ্য এক শক্তি তাকে ভর করে রেখেছে। আর সেই অদৃশ্য শক্তিতে আচ্ছন্ন জুলিয়ান বার বার আরও পুতুল ঝুলাতে লাগলেন। মেয়েটির মৃত্যু ঘটনা ভেবে তিনি সব সময় বিষন্ন থাকতেন।
প্রায় ৫০ বছর কেটে গেলো জুলিয়ানের এভাবে গাছে গাছে পুতুল ঝুলাতে ঝুলাতে। তখন হঠাৎ একদিন ঘটলো সেই অদ্ভুত আরেক ঘটনা। ডন জুলিয়ানকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সেই জায়গাতেই যেখানে তিনি সেই মেয়েটিকে ভাসমান অবস্থায় খুঁজে পান। পরবর্তীতে আতঙ্কগ্রস্থ তার আত্মীয়- স্বজনেরা তাদের আবাসস্থল পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান।
এইসব ঘটনা প্রেক্ষাপট থেকেই মূলত এই অদ্ভূত রীতির জন্ম হয়। সেই কিশোরীর জন্য বেদনা আর ঝুলন্ত পুতুলের ভৌতিকতা—এই দুইয়ের স্বাদ পেতে ২০১১ সাল থেকেই প্রায়শ প্রচুর পর্যটক সমাগম ঘটে এই রহস্যে ঘেরা দ্বীপে। ফটোগ্রাফারদের কাছেও জোচিমিকো আজ এক উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ। উল্লেখ্য জুলিয়ানের মৃত্যুর পর ২০০১ সাল হতে ঐ স্থানটির নাম “চায়নাম্পাস” নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছে।
অনেকে আবার জুলিয়ানকে স্মরণ করে নতুন নতুন পুতুল ঝুলিয়ে রেখে আসেন। জুলিয়ানের মৃত্যুর ১৫ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও অনেকেই এমনটা বলতে শোনা যায় যে, তারা নাকি এমনটা অনুভব করেন যে গাছের আড়ালে পুতুলগুলোর চোখ জোড়া যেন তাদের অনুসরণ করছে।
ইউনেস্কো ১৯৮৭ সালেই চায়নাম্পাসকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেও ভূতুড়ে পুতুলের দরুন তা টুরিস্ট প্লেস হিসেবে জমজমাট হয়ে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি এই বছরের শুরুর দিকে, সিনডি ভাস্কো নামের একজন ফটোগ্রাফার এই দুঃস্বপ্নের দ্বীপ ভ্রমণ শেষে তার অভিজ্ঞতা মেইল মারফত শেয়ার করেন। তাতে তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কীভাবে অপার সৌন্দর্যের মাঝে পাড়ি জমাতে জমাতে হঠাৎ সেই বিরক্তিকর, ভয়ংকর পুতুল ঘেরা দ্বীপে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তো যারা ভুত দেখার বা তার অস্তিত্ব অনুভব করার চেষ্টা করেন তারা ঘুরে আসতে পারেন মেক্সিকোর এই “আইল্যান্ড অফ দ্যা ডলস” এ।