১৯৬৮ সাল, চেকোস্লোভাকিয়া তখনও চেক রিপাবলিক ও স্লোভেনিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র। মানবিক সমাজতন্ত্র– এই স্লোগানকে সামনে রেখে সেবারের বসন্তে চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানীতে জন্ম নিয়েছিলো প্রাগ বসন্ত, যার নায়ক ছিলেন চেকোস্লোভাকিয়ার তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নেতা অ্যালেক্সান্ডার দুবচেক। তিনি ছিলেন জনগণের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীন মতামতপ্রকাশে বিশ্বাসী এক নেতা। মস্কোর অতি অনুগত বাম নেতারা নিজ জনগণ থেকে যে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিলো, তা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি এক সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, আর এর থেকেই প্রাগ বসন্তের সূচনা ঘটে।
১৯৪৮ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চেকোস্লোভাকিয়া ছিল কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে (এর দুই বছর পর, অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে চেক রিপাবলিক ও স্লোভেনিয়ার জন্ম হয়)। এর মাঝে ১৯৬৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা দুবচেকের গৃহীত সংস্কার কর্মসূচীর ফলে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে এমন সব মতামত প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা কমিউনিস্ট দলের শক্ত হাতের শাসনামলে ছিল অকল্পনীয়। একটি স্বাধীন, আধুনিক ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য দুবচেকের গৃহীত পদক্ষেপগুলো মস্কোকে উত্তেজিত করে তোলে। ওদিকে চেক জনগণের মনে বসন্তের নতুন ফুল ফোটার মতো করেই জন্ম নিয়েছিল নতুন আশা। কিন্তু প্রাগের সেই বসন্তের ফুলগুলো পুরোপুরি ফোটার আগেই সোভিয়েতরা তাদের টি-৫৪ ট্যাঙ্ক দিয়ে তা পিষে ফেলে।
আজ থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সোভিয়েত ব্লকভূক্ত দেশগুলোর সেনাবাহিনী চেকোস্লোভাকিয়ায় প্রবেশ করে। তাদের কঠোর এই কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাগ বসন্তকে দমন করা হয়, যার প্রভাব আজও সে অঞ্চল থেকে যায়নি। দুবচেক চেক জনগণের উপর থেকে সরকারের যে কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা হ্রাস করেছিলেন, তা সোভিয়েতরা পুনরায় আরোপ করতে পারলেও এর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। শীতল যুদ্ধ চলার সময়ে সোভিয়েত এই আগ্রাসনকে মতপ্রকাশ ও ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রতি মস্কোর অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশের উদাহরণ হিসেবে ধরা হয়। পশ্চিমা গণমাধ্যম এ সময় সমাজতন্ত্রকে এমন আদর্শ হিসেবে চিত্রিত করে, যাতে দেখানো হয় সমাজতন্ত্রকে কেবল বন্দুকের নল দিয়েই টিকে থাকতে হয়।
১৯৬৮ সালের ৫ জানুয়ারি অ্যালেক্সান্ডার দুবচেক ক্ষমতা গ্রহণ করে সমাজতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর সংস্কার শুরু করেন। এ সংস্কারের অংশ হিসেবে তিনি কমিউনিস্ট শাসনের বদ্ধ কাঠামোর মধ্যেও নাগরিকদের জন্য কিছু ব্যক্তিস্বাধীনতার সুযোগ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিদেশ ভ্রমণে স্বাধীনতা দেওয়ার মাধ্যমে দুবচেক চেয়েছিলেন সমাজে মুক্তচিন্তার এক পরিবেশ তৈরি করতে। তিনি কখনোই কমিউনিস্ট শাসনের অবসান চাননি, বরং মানুষের মন জয় করে সেই আদর্শের ভিতকে আরও মজবুত করার প্রচেষ্টা নিয়েছিলেন। তার পূর্বসূরী আন্তন নোভতনির কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬৭ সালে চেক জনগণ ফুঁসে উঠেছিলো। মানুষের মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ দূর করতেই দুবচেক ১৯৬৮ সালের ৫ এপ্রিল একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব অনুমোদন করেন।
কিন্তু তার এই সংস্কারকে সোভিয়েত ব্লকভূক্ত দেশগুলো ভালোভাবে গ্রহণ করলো না। মস্কোসহ অন্যান্য নেতারা ধারণা করলেন, দুবচেক বোধহয় চেকোস্লোভাকিয়ার উপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছেন। এমনকি তারা এটাও ধারণা করলেন যে, দুবচেক হয়তো ওয়ারশ চুক্তি থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্কিন পক্ষে যোগ দেবেন। এজন্য তারা দুবচেকের উদ্দেশ্যে কঠোর বার্তা প্রেরণ করলেন। তবে দুবচেক তা আমলে না নিয়ে তার সংস্কার কর্মসূচীর কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন।
১৯৬৮ সালের ২০ আগস্ট রাত ১১টা। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি এবং পোল্যান্ডের এক সম্মিলিত বাহিনী সীমান্ত পেরিয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার ভেতরে প্রবেশ করে। সম্মিলিত এ বাহিনীতে ছিল প্রায় আড়াই লক্ষ সৈন্য, দুই সহস্রাধিক ট্যাঙ্ক এবং শতাধিক যুদ্ধ বিমান। এর ফলে নাৎসি অনুপ্রবেশের ২৯ বছর পর চেক ও স্লোভাকরা তাদের মাটিতে বিদেশী সৈন্যদের উপস্থিতি দেখতে পায়। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনী প্রাগে উপস্থিত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে দুবচেককে তার অফিস থেকে গ্রেফতার করে জোর করে মস্কো প্রেরণ করে। মস্কো যাবার আগে দুবচেক দেশবাসীকে যেকোনো প্রকার রক্তপাত পরিহার করার আহ্বান জানান। চেকোস্লোভাকিয়ার সেনাবাহিনীকে এ সময় নিজ নিজ ব্যারাকে অবস্থান করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তবে ঠিক কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে চেক ও স্লোভাকদের কোনো ধারণা না থাকায় এ সময় তারা রাস্তায় মানববন্ধন করে ট্যাঙ্কের গতিপথ রোধ করার পাশাপাশি দখলদার সৈন্যদের সাথে হাতাহাতি শুরু করে। কোথাও কোথাও ঘরে নির্মিত গ্রেনেড দিয়ে সেনাদের উপর আক্রমণও করা হয়।
প্রাগ বসন্তের আগে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে দুটো বড় ধরনের আন্দোলন ইউরোপে হয়েছিলো, যার একটি হয়েছিল ১৯৫৩ সালে পূর্ব জার্মানিতে, আর অপরটি হয়েছিল ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে। উভয় আন্দোলনকেই মস্কোর সরাসরি হস্তক্ষেপে স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে শক্ত হাতে দমন করা হয়। সেই দুই আন্দোলনের সাথে ১৯৬৮ সালের প্রাগ গণজাগরণের একটা বড় পার্থক্য হলো, এ গণজাগরণ শুরুই হয়েছিলো স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে, যার মূল চেতনা আরও অধিকতর শুদ্ধ কমিউনিজম চর্চা। এ আন্দোলন কমিউনিস্ট শাসনের অবসান নয়, বরং কমিউনিস্ট শাসনের ধারাকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিলো।
কিন্তু মস্কো, বিশেষ করে তৎকালীন সোভিয়েত নেতা লিওনিভ ব্রেজনভ প্রাগের এ সংস্কারকে মোটেই ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশে এমন সংস্কারের ছোঁয়া যেন না লাগে, সেজন্য তিনি দ্রুত দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। দুবচেকের সংস্কারের দরুন প্রাগের গণমাধ্যমগুলো যেভাবে সোভিয়েত স্টাইলের সমাজতন্ত্রের সমালোচনা শুরু করেছিলো, তা ব্রেজনভকে অত্যন্ত উত্তেজিত করে তোলে। এ জন্যই হয়তো প্রাগে প্রবেশের পর সোভিয়েত সেনাদের সবার আগে প্রাগের রেডিও এবং টিভি ষ্টেশনগুলো দখল করতে দেখা যায়। প্রাগ রেডিও স্টেশন দখল করার সময় সাধারণ মানুষের সাথে সেনাদের তুমুল হাতাহাতি হয়। সাধারণ মানুষ পাবলিক বাস দিয়ে রেডিও স্টেশনের রাস্তা ঘিরে রাখলে সোভিয়েত ট্যাঙ্কগুলো বাস ভেঙে এগিয়ে যায়। এ সময় উত্তেজিত জনতা কয়েকটি ট্যাঙ্কে আগুন ধরিয়ে দেয়। একপর্যায়ে সেনারা নিরস্ত্র মানুষের উপর গুলি চালায়। ধারণা করা হয়, প্রাগের রাস্তায় সেদিন শতাধিক চেক নাগরিক নিহত হন। এই বিক্ষোভ ও হাতাহাতি পরের বেশ কয়েকদিন ধরে চলমান থাকে।
পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেবার পর মস্কো পছন্দের শাসক দিয়ে চেকোস্লোভাকিয়াতে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক সরকার ব্যবস্থা পুনরায় চালু করে। দুবচেক মস্কো থেকে কয়েকদিন পর ফিরে আসলেন। কাগজে-কলমে তিনি দেশের প্রধান থাকলেও সত্যিকার অর্থে তার কোনো স্বাধীন ক্ষমতা আর অবশিষ্ট ছিল না। ১৯৬৯ সালে তাকে পার্টি প্রধান থেকে অপসারণ করা হয়। তার অনুসারী পাঁচ লাখের বেশি সমর্থককে চেক কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করার পর ১৯৭০ সালে দুবচেককেও কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সোভিয়েত সৈন্য সমাবেশের কথা জানলেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিনডন বি জনসন ধারণা করেননি, সোভিয়েত সেনারা সত্যি সত্যিই প্রাগের অভ্যন্তরে প্রবেশ করবে। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থে কিছুই করার ক্ষমতা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। ১৯৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজ দেশেই বেকায়দা অবস্থায় ছিল। সে বছরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং সিভিল রাইট নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রকে হত্যা করা হয়। সেই সাথে চলছিলো ভিয়েতনাম যুদ্ধ। নিজ দেশ নিয়ে ব্যস্ত থাকা মার্কিন সরকার চেকোস্লোভাকিয়া প্রশ্নে বিবৃতি প্রদান ছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে অন্য কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়ার মতো বোকামি করার কথা চিন্তাও করেনি।
প্রাগ বসন্ত দমনের বহু বছর পর সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কারের জন্য যে ‘পেরেস্ত্রোইকা’ বা ‘গ্লাসোনস্ত’ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা মূলত দুবচেকের মানবিক সমাজতন্ত্র কর্মসূচী দ্বারাই অনুপ্রাণিত।