সাচিকো: পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিল যে মেয়েটি (পর্ব – ১৭)

অ্যা পাথ টু পিস

১৯৬২

সাচিকোকে জীবনযুদ্ধে জয়ী বললে অত্যুক্তি হবে না। সে থাইরয়েড ক্যান্সারের সাথে লড়াইয়ে জয়লাভ করেছিল। ফিরে পেয়েছিল নিজের কণ্ঠস্বর। কথা বলতে পারছিলো ঠিক আগের মতো করেই। নতুন করে জীবন শুরুর জন্য প্রস্তুত ছিলো সে।

২১ বছর বয়সী সাচিকো; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

কিন্তু তখনই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন তার মনে উঁকি দিতে লাগলো, যার উত্তর সে খুঁজে পাচ্ছিলো না। এখন সে আবারও কথা বলতে পারে- সেটা নাহয় ঠিক আছে, কিন্তু নতুন করে পাওয়া এই কণ্ঠস্বরকে সে আসলে কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে?

বিশ্বজগতের কেবলমাত্র এই অংশটাতেই আমরা বেঁচে থাকতে পারি রে মা। কখনোই খারাপ কথা বলবে না, তা না হলে কাঙ্ক্ষিত শান্তি চিরঅধরাই থেকে যাবে। ঘৃণা থেকে কেবলমাত্র ঘৃণারই জন্ম হয়,” বাবার সেই চিরচেনা উপদেশমালা আবারও সাচিকোর মনে পড়লো।

নিজের চারদিকেই সাচিকো যেন বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পেত; কর্পূর গাছের নিচে, বাড়ির বাইরে যে পাথরের উপর বসে সে পড়াশোনা করতো সেখানে, ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করে বাবার নিজ হাতে গড়া বাগানে- সবখানেই।

বিভিন্ন সময়ে বাবার দেয়া উপদেশগুলো নিয়ে সাচিকো খুব গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলো। মেয়ের জন্য তিনি কেবল এই সম্পদই রেখে যেতে পেরেছিলেন। স্মৃতির পাতায় ক্রমাগত হাতড়াতে লাগলো সে। আর কী কী কথা বাবা তাকে বলেছিলেন?

মহাত্মা গান্ধী; Image Source: DocumentaryTube

গান্ধীজির কাজকর্ম সম্পর্কে পড়ার বয়স এখনও তোমার হয়নি। কিন্তু একদিন তোমাকে অবশ্যই সেসব নিয়ে পড়তে হবে। পরবর্তী জীবনে চলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই তুমি জানতে পারবে সেখান থেকে।

১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাবা সাচিকোকে উদ্দেশ্য করে এই কথাগুলো বলেছিলেন। সেই দিনটির কথা তার খুব ভালোভাবেই মনে আছে। তখন তার বয়স ছিলো ন’বছর। তারা দুজন তখন বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাবার চোখে-মুখে ছিল গাঢ় বিষাদের ছায়া। মেয়ের কাঁধে হাত রেখে তিনি তাকে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর কথা বলছিলেন।

সাকামোতো সিমেট্রি; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

সাচিকোর মনে পড়লো, জীবনে প্রথমবারের মতো সে যেদিন মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে পড়েছিল, সেদিন সে সাকামোতো সিমেট্রির একপাশে গিয়ে বসেছিল। সিমেট্রির পাথুরে দেয়ালের তখনও বিস্ফোরণের ফলে সৃষ্ট প্রচণ্ড উত্তাপের কমলা দাগ লেগেছিল। সে বসে ছিল নতুন গাছগুলোর নিচে, চারদিকে ছিল সুনশান নীরবতা। যুদ্ধের স্মৃতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো চারদিকেই। এমনই এক পরিবেশে সাচিকো গান্ধীজির বইটি খুললো। সে পড়লো, “কেবলমাত্র ‘অহিংসা’ নামক অস্ত্র দিয়েই এ ধরণীকে রক্ষা করা সম্ভব।

সেখানে মহাত্মা গান্ধীর ছোটবেলার একটি ছবিও ছিলো। ছোট্ট এই বাচ্চাকে দেখে বোঝার কোনো উপায়ই ছিলো না যে, একদিন সে-ই বিশ্বজুড়ে কতটা বিখ্যাত হতে যাচ্ছে। চেয়ারে বসে একদৃষ্টিতে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিলো সে। গান্ধীজি নিজেই স্বীকার করেছেন, ছোটবেলায় অন্ধকারকে খুব ভয় পেতেন তিনি।

৭ বছর বয়সে মহাত্মা গান্ধী; Image Source: Sachiko – A Nagasaki Bomb Survivors Story

তিনি লিখেছেন, “আমি খুবই লাজুক স্বভাবের ছিলাম এবং সকল রকমের সঙ্গ যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম। পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়গুলোই ছিলো আমার সবচেয়ে বড় সঙ্গী। ঠিক সময়মতো স্কুলে উপস্থিত হওয়া এবং স্কুল ছুটির সাথে সাথে দৌড়ে বাড়ি ফেরা- এটাই ছিলো আমার প্রতিদিনকার রুটিন। আসলেই আমি দৌড়ে চলে আসতাম, কারণ আমি কারো সাথেই কথা বলতে পারতাম না। কেউ আমাকে নিয়ে মজা করবে- এটা ভেবেও আমি দারুণ ভয় পেতাম।

ছোটবেলায় সাচিকোরও কি এমনটাই হতো না? তার মানসিক অবস্থাও তো অনেকটাই গান্ধীজির মতোই ছিলো।

সে পড়ে যেতে লাগলো।

ইংল্যান্ডে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে গান্ধীজি ভারতে ফিরে এলেন। প্রথম কেসের কথা, নিজের মক্কেলের পক্ষে বিচারকের সামনে কথা বলতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কিন্তু সেদিন তিনি এতটাই নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন যে, সাময়িকভাবে বাকশক্তি হারিয়ে ফেললেন। তার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বেরোয়নি।

গান্ধীজি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলেন?

আবারও নিজের আর গান্ধীর মাঝে মিল খুঁজে পেলো সাচিকো। গান্ধীজিও তাহলে অনেক সংগ্রাম করেছেন।

সাচিকো আবারও পড়তে লাগলো।

১৮৯৩ সালে মাত্র তেইশ বছর বয়সে জীবিকার্জনের উদ্দেশ্যে ভারত ছেড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান গান্ধীজি। সেখানে পৌঁছেই তিনি ট্রেনে করে রাজধানী প্রেটোরিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। গায়ে ইংরেজদের ন্যায় পোশাক চাপিয়ে, হাতে প্রথম শ্রেণীর টিকিট নিয়ে তিনি একটি প্রথম শ্রেণীর কামরাতেই চড়ে বসেছিলেন। ঐ একই কামরায় সাদা চামড়ার এক লোকও ছিলো। গান্ধীকে দেখেই তিনি কন্ডাক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই ‘নোংরা কুলি’কে যেন তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় অতিসত্ত্বর রেখে আসা হয়। গান্ধী স্বাভাবিকভাবেই যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কন্ডাক্টর কোনো কথা না শুনে তাকে ট্রেন থেকেই বের করে দিয়েছিল।

সেই রাতে হাড়কাঁপানো শীতে একাকী একটি বেঞ্চে বসে ছিলেন গান্ধীজি। তার মনের মাঝে কেবল ট্রেনে ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটিই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ভোরের দিকে হঠাৎ একটি ভাবনা এসে তার রাগের আগুন নিভিয়ে দিয়ে গেলো। পূর্বসংস্কার এবং বৈষম্যকে তিনি সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখতে শুরু করলেন। এটা ঠিক যে, গান্ধীকে যখন ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়া হলো, তখন সেই কন্ডাক্টর ঘৃণার বশবর্তী হয়েই এমনটা করেছিল। কিন্তু এটাও সত্য যে, ঘৃণা নামক বিষয়টি একইসাথে সেই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি এবং কন্ডাক্টরের চরিত্রেও কালিমা লেপে দিয়ে গিয়েছিল। মানুষ বুঝতে পারুক কিংবা না-ই পারুক, পূর্বসংস্কার আর বৈষম্য প্রত্যেকের জীবনকেই বেশ সংকীর্ণ আর কুৎসিত করে তুলেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজী; Image Source: South African Tourism

গান্ধীর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসলো। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করাটাই জরুরি, ট্রেনে বসে থাকা লোকগুলোর বিরুদ্ধে না। কিন্তু একজন ক্ষুদ্র ব্যক্তি হয়ে পূর্বসংস্কারের মতো সমাজের এত গভীরে শিকড় গেড়ে বসা একটি ধারণার বিরুদ্ধে তিনি কীভাবে লড়াই করবেন?

গান্ধীজি তখন বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাবলেন। সকাল নাগাদ তিনি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন। আর কোনোদিন তিনি তার কিংবা অন্যদের সাথে হওয়া কোনোরকম বৈষম্যকেই প্রশ্রয় দেবেন না। তিনিও প্রতিবাদ করবেন। তবে তাতে থাকবে না কোনো সহিংসতা, বরং থাকবে মানবজতির প্রতি সীমাহীন, অকৃত্রিম ভালোবাসা, মিশে থাকবে ঘৃণা ও বৈষম্যকে জয় করার শাশ্বত বাণী।

এর মধ্য দিয়েই গান্ধী যেন তার কণ্ঠস্বর খুঁজে পেলেন।

গান্ধীজির সম্পর্কে জানতে পেরে সাচিকোর চিন্তাভাবনার নতুন দুয়ার খুলে গেলো, নতুন করে বিশ্বকে দেখতে শুরু করলো সে। যুদ্ধের ফলে তাকে অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে, শৈশবে স্কুলে অনেকের কটুক্তির শিকার হতে হয়েছে, ভাইবোনকে ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা তাকে প্রতিনিয়ত কাঁদিয়েছে, কিন্তু এতকিছুর পরও সম্ভবত এই পৃথিবীকে ভালোবাসা সম্ভব, সম্ভব একে বদলে দেয়াও!

বাবা আসলে ঠিকই বলেছিলেন। গান্ধীজির কাছ থেকে সে আসলেই এমন কিছু শিখতে পারে, যা তাকে বাকি দিনগুলোতে বেঁচে থাকতে সহায়তে করবে। গান্ধীজির জীবনী সম্পর্কে সে যতই জানতে লাগলো, ততই বুঝতে পারলো যে, সে আসলে ঠিক মহাত্মা গান্ধীর মতোই একজন হতে চায়। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব?

তিনি লিখেছিলেন, “ভালোবাসতে পারা একটি দক্ষতা। ক্ষমা করতে পারাও একটি দক্ষতা। আবার রাগকে বশীভূত করতে পারাও আরেক ধরনের দক্ষতা। এগুলোর সবই শেখা সম্ভব।

এগুলোর সবই শেখা সম্ভব? তাহলে সাচিকো সেই চেষ্টাই করবে।

সাচিকো একটি খাতা কিনে আনলো। প্রতিদিনই একাউন্টিং অফিসের কাজকর্ম শেষে সাকামোতো সিমেট্রির এক কোনায় বসে সে গান্ধীজি সম্পর্কে পড়তো এবং দরকারি জিনিসগুলো খাতায় লিখে রাখতো। সে পড়ছিলো, “অহিংসা কোনো পোশাক না যে চাইলেই সেটা গায়ে জড়ানো যাবে, আবার চাইলেই খুলে ফেলা যাবে। এর স্থান আমাদের অন্তরে, এবং একে আমাদের মানবসত্ত্বারই অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে হবে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় মহাত্মা গান্ধীর অহিংস বিদ্রোহ সম্পর্কে সাচিকো পড়াশোনা করলো, জানতে পারলো কীভাবে তার অসামান্য নেতৃত্ব তার মাতৃভূমি ভারতকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গিয়েছিল। শান্তি আর অহিংসতার এই দর্শন অনুসরণ করেই গান্ধীজি যেন কর্পূর গাছগুলোই মতোই বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন।

Image Source: Quartz

গান্ধীজির জীবনী সম্পর্কে পড়াশোনা করে সাচিকো আসলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই জানতে পেরেছিল: কীভাবে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আজকের ‘মহাত্মা গান্ধী’ হয়ে উঠেছিলেন; কীভাবে বাবা ‘একজন বাবা’ হয়ে উঠেছিলেন; এবং কীভাবে সে, সাচিকো ইয়াসুই, একদিন ঠিক সেই মানুষটি হতে পারবে, যেমনটা সে হবার স্বপ্ন দেখে।

এই সিরিজের পূর্ববর্তী পর্বসমূহ

১) পর্ব – ১  ||  ২) পর্ব – ২  ||  ৩) পর্ব – ৩  ||  ৪) পর্ব – ৪  ||  ৫) পর্ব – ৫  ||  ৬) পর্ব – ৬  ||  ৭) পর্ব ৭ ||  ৮) পর্ব ৮  ||  ৯) পর্ব ৯  ||  পর্ব ১০  ||  পর্ব ১১  ||  পর্ব ১২  ||  পর্ব ১৩  ||  পর্ব ১৪ ||  পর্ব ১৫  ||  পর্ব ১৬

This article is in Bangla language. It describes the story of Sachiko, a hibakusha from nagasaki. Necessary references have been hyperlinked inside.

Reference Book

1. Sachiko - A Nagasaki Bomb Survivors Story by Caren Stelson

Feature Image: Documentary Tube

Related Articles

Exit mobile version