১৮৮০ থেকে ১৯১৪; সময়ের ব্যপ্তি মাত্র ৩৪ বছরের। ‘মাত্র’ বলা হলো এ কারণে যে, ইতিহাসের হাজার হাজার বছরের পথপরিক্রমায় ৩৪ বছর নিতান্তই অল্প সময়। এই ‘মাত্র’ ৩৪ বছরে আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলোর স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের মতো বিষয়গুলোতে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। ১৮৮০ সালে যেখানে আফ্রিকা মহাদেশের মাত্র ১০ শতাংশ ভৌগলিক এলাকা ‘উপনিবেশ’ হিসেবে বাইরের শক্তি দ্বারা শাসিত হয়েছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ১৯১৪ সালে এসে তা দাঁড়ায় ৯০ শতাংশে! মাত্র ৩৪ বছরেই আবিসিনিয়া (ইথিওপিয়া) ও লাইবেরিয়া বাদ দিয়ে আফ্রিকার বাকি সব অঞ্চল বাইরের মহাদেশ থেকে যাওয়া মানুষের দখলে চলে যায়।
আফ্রিকা মহাদেশের প্রতি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আকৃষ্ট হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল দামী প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য। আফ্রিকার সুবিধাবাদী স্থানীয় শাসকগোষ্ঠী ও জনগণের সারল্যকে কাজে লাগিয়ে তারা বছরের পর বছর সেসব মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করেছে, স্থানীয় জনগণ প্রতিবাদ করলে তাদের উপর নিপীড়ন চালিয়েছে। অ্যাঙ্গোলাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বক্সাইট, হীরা ও সোনার খনি কিংবা তেলের বিশাল মজুত থাকার কারণে এই দেশও স্বাধীনতা হারিয়ে পর্তুগালের ‘উপনিবেশ’ হিসেবে শাসিত হয়ে আসছিল অনেক দিন ধরেই। কিন্তু কার্নেশন রেভ্যোলুশনের পরে হঠাৎ করে পর্তুগাল আফ্রিকা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করতে শুরু করলে বিশৃঙ্খলা চরম আকার ধারণ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ বলতে গেলে একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। ইউরোপীয় দেশগুলোর ভগ্নদশার সুযোগ নিয়ে উপনিবেশগুলোতে শুরু হয় স্বাধীনতাকামী জনতার তুমুল আন্দোলন। আর বিশ্বযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পর উপনিবেশগুলোর বিদ্রোহ-আন্দোলন দমনের অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না উপনিবেশবাদী ইউরোপীয় দেশগুলোর। তাই তুমুল আন্দোলন-বিদ্রোহের জের ধরে একের পর এক উপনিবেশ স্বাধীন হতে শুরু করে। পর্তুগালের ক্ষেত্রেও এর কোনো পরিবর্তন হয়নি।
১৯৭৪ সালে পর্তুগালের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। পর্তুগিজ সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও উচ্চপদস্থ অফিসারেরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এস্তাদো নোভো সরকারকে উৎখাত করে। রক্ষণাত্মক ও কর্তৃত্ববাদী চিন্তাভাবনার ধারক হিসেবে এস্তাদো নোভো বা ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ সরকারের উপনিবেশগুলো টিকিয়ে রাখার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। ষাটের দশক থেকেই আফ্রিকার উপনিবেশগুলোতে সে দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করলে এস্তাদো নোভো সরকার পর্তুগিজ সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয় বিদ্রোহ দমনের জন্য। সামরিক অভ্যুত্থানের পর সামরিক জান্তারা বিনা রক্তপাতে পর্তুগালের শাসনক্ষমতা দখল এবং উপনিবেশমুক্ত গণতান্ত্রিক পর্তুগালের পথ উন্মোচিত করেছিল। ফলে উপনিবেশগুলো থেকে পর্তুগিজ সেনাবাহিনীর সদস্যদের ঘরে ফেরা অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
অ্যাঙ্গোলায় তিনটি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র পক্ষ আলাদা করে পর্তুগিজদের সাথে লড়ে যাচ্ছিল। সমস্যার শুরু এখান থেকেই। যেমন- মোজাম্বিক কিংবা গিনি বিসাওয়েও পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন হয়। কিন্তু সেখানে পর্তুগিজদের বিপক্ষে লড়েছিল একটি দল। তাই যখন সামরিক অভ্যুত্থান বা ‘কার্নেশন রেভ্যলুশন’ সফল হওয়ার পর পর্তুগিজদের বিদায় ঘণ্টা বেজে যায়, তখন তারা সেই দলকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে দেশত্যাগ করে। অ্যাঙ্গোলায় ছিল তিনটি ভিন্ন সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী দল এবং পর্তুগিজরা কাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে সেটি কোনোভাবেই বুঝে উঠতে পারছিল না। ফলে একটি গৃহযুদ্ধ অ্যাঙ্গোলার নাগরিকদের জন্য অবধারিত হয়ে ওঠে।
যে সশস্ত্র দলগুলো অ্যাঙ্গোলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিল, তাদের নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। দলগুলোর ভিন্ন মতাদর্শ ছিল, ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সমর্থন পেয়েছিল প্রতিটি দল। দ্য পিপলস’ মুভমেন্ট ফর লিবারেশন অব অ্যাঙ্গোলা বা এমপিএলএ (MPLA) ছিল অন্যতম বড় দল। এটি ১৯৫৬ গঠিত হয়েছিল অ্যাঙ্গোলান কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরসূরি হিসেবে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা মার্ক্সিস্ট চিন্তা-চেতনা নিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হতে চেয়েছিল। এমবুন্দু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বিশাল সমর্থন পেয়েছিল তারা।
দ্য ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অব অ্যাঙ্গোলা বা এফএনএলএ (FNLA) ছিল এমপিএলএ–র একেবারে বিপরীত রাজনৈতিক চেতনা লালনকারী সংগঠন। এটি ছিল গতানুগতিক পুঁজিবাদী ভাবধারার সংগঠন এবং এর সমর্থনকারীরা ছিল ব্যাকোঙ্গো জনগোষ্ঠী। এটি গঠিত হয় ১৯৬২ সালে।
সবার শেষে সাবেক এফএনএলএ (FNLA) নেতা জোনাস স্যাভিম্বির নেতৃত্বে গঠিত হয় ন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর দ্য টোটাল ইনডিপেন্ডেন্স অব অ্যাঙ্গোলা বা ইউনিটা (UNITA)। এই সংগঠনের পতাকাতলে এসে জড়ো হয় ওভিম্বুন্দু জনগোষ্ঠীর মানুষেরা।
পর্তুগিজরা চলে গেলে তিনটি সশস্ত্র সংগঠনের ভেতর অ্যাঙ্গোলার রাষ্ট্রক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সেই চুক্তি বিলুপ্ত হয় এবং অ্যাঙ্গোলা গৃহযুদ্ধের যুগে প্রবেশ করে।
মার্ক্সিস্ট ভাবধারার এমপিএলএ রাজধানী লুয়ান্ডা দখল করে নেয় এবং নিজেদের অ্যাঙ্গোলার সরকার হিসেবে ঘোষণা করে। আফ্রিকা মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলোর একটি বড় অংশ অ্যাঙ্গোলার জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে এমপিএলএ (MPLA)-কে স্বীকার করে নিয়েছিল। মূলত মার্ক্সিস্ট ভাবধারার কারণে তারা কিউবা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন লাভ করে, কিউবার সৈন্যরা সশরীরে অ্যাঙ্গোলায় তাদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
এফএনএলএ অ্যাঙ্গোলার অভ্যন্তরে তেমন জনসমর্থন তৈরি করতে পারেনি। ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে তাদের শক্তি কমে আসতে থাকে, গৃহযুদ্ধের শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন শুরু হয়। তারা ক্রমাগত দুর্বল হয়ে পড়ার ফলে যে ঘাটতি দেখা দেয়, তা পূরণ করতে এগিয়ে আসে ইউনিটা। বাইরের দেশগুলোর সামরিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতার ফলে তারা ধীরে ধীরে এমপিএলএ–র শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। এফএনএলএ ও ইউনিটা মিলে হুয়াম্বোতে পাল্টা সরকার গঠন করে। দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্যরা এই দুই দলের জোটে সরাসরি অংশগ্রহণ করে।
দুই পক্ষের যুদ্ধ যেমন ক্ষমতা দখলের জন্য ছিল, তেমন মতাদর্শগত কারণ ও বাইরের শক্তি দ্বারা প্রভাবিতও ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা নিজ স্বার্থেই অ্যাঙ্গোলার গৃহযুদ্ধে নিজ সেনাবাহিনীকে নিয়োজিত করে, কারণ অ্যাঙ্গোলাকে অন্যান্য আফ্রিকান দেশগুলোর মাঝে ‘বাফার স্টেট’ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য ডানপন্থী এফএনএলএ জোটকে ক্ষমতায় রাখা প্রয়োজন ছিল। স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়ে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোর নেতা সোভিয়েত ইউনিয়ন চেয়েছিল অ্যাঙ্গোলাতে মার্ক্সিস্ট ভাবধারার এমপিএলএ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হোক। এজন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র কমিউনিস্ট রাষ্ট্র কিউবার সেনাবাহিনীর সদস্যরা সশরীরে এমপিএলএ-র পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় দেশগুলোও সোভিয়েত-বিরোধিতার অংশ হিসেবে এমপিএলএ–র বিপরীত মতাদর্শের দলগুলোকে অব্যাহত সমর্থন দিয়ে গেছে।
অ্যাঙ্গোলার বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ হয়েছে। হতাহতের সংখ্যাটা নেহায়েত কম নয়; সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। পর্তুগিজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর কথা ছিল অ্যাঙ্গোলা অসংখ্য নৃগোষ্ঠীর জন্য রক্তপাতহীন বহুমাত্রিক এক সমাজ প্রতিষ্ঠা করবে। মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করে শিল্পনির্ভর শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা ছিল তাদের। অথচ বাস্তবে বিভিন্ন সংগঠন সোনা, হীরার, তেল, বক্সাইট, ইউরেনিয়ামের খনিগুলো দখল করে যুদ্ধের গোলাবারুদ কেনে বিদেশি দেশগুলোর কাছ থেকে, আর সেগুলো বৃষ্টির মতো বর্ষণ করে নিজ দেশের জনগণের উপরেই।
গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দুবার থামানোর জন্য চেষ্টা করা হয়। কিন্তু দুবারই সেই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ইউনিটা বাইরের দেশগুলোর কাছ থেকে সামরিক, কূটনৈতিক সমর্থন লাভের পর অনেকখানি এগিয়ে যায়, কিন্তু শেষপর্যন্ত বাইরের প্রভাবশালী দেশগুলোর সমর্থন এমপিএলএ–র দিকেই যায়।
২০০২ সালে ইউনিটার প্রধান নেতা জোনাস স্যাভিম্বিকে হত্যা করা হয়। এরপর ইউনিটা এমপিএলএ-র সাথে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয় এবং এপ্রিলে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ সাতাশ বছরের গৃহযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো ভেঙে যায়। এমনিতে ঔপনিবেশিক শাসনের কারণে জাতীয় পর্যায়েই অনেক বছর পিছিয়ে পড়েছিল তারা। এই গৃহযুদ্ধ তাদেরকে আরও অনেক দশক পিছিয়ে দেয়। পর্তুগিজদের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার পর একটি প্রজন্ম চোখের সামনে যুদ্ধের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করতে করতে বেড়ে ওঠে। একটি সার্বজনীন নির্বাচন, সব সশস্ত্র আন্দোলনের কাছে গ্রহণযোগ্য ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি কিংবা অন্য কোনো উপায়ে হয়তো গৃহযুদ্ধ আটকে রাখা যেত, প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো যেত। পর্তুগিজদের প্রস্থানের পর অ্যাঙ্গোলার সশস্ত্র আন্দোলনকারী দলগুলোর গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ, “স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন”-এর এই বাস্তবতাই সামনে নিয়ে আসে।