“People must fight against the evil they feel equal to at that moment.”
– জান পালাহ
গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষ দিকে পুরো বিশ্ব ছিলো মোটামুটি উত্তাল। ভিয়েতনাম যুদ্ধের তখন আস্তে আস্তে মোড় ঘুরছে। আমেরিকায় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যাকাণ্ড, রবার্ট কেনেডির হত্যাকাণ্ড, রিচার্ড নিক্সনের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া ছাড়াও ছিলো সারা বিশ্বে ছাত্র আন্দোলন, প্রাগ বসন্তের পরিসমাপ্তি, মানুষের প্রথম চাঁদের বুকে পা রাখা। এতসব ঘটনা দিয়ে শেষ হয়েছিলো ষাটের দশক। যদিও এখানে আলোচনা করা হবে তখনকার সময়ে অপ্রাসঙ্গিক এক ঘটনা নিয়ে, যার কোনো ফল তখন পাওয়া যায়নি।
প্রাগের জন্য ১৯৬৯ এর জানুয়ারি ছিলো ‘প্রাগ বসন্ত’ শেষ হওয়ার পাঁচ মাস। রাস্তাঘাটসহ শহরের প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ পুরো চেকোস্লোভাকিয়ার নিয়ন্ত্রণ ছিল সোভিয়েত সরকারের হাতে। এরকম থমথমে অবস্থার মধ্যে একদিন জানা গেল শহরের প্রাণকেন্দ্রে (উইনসেসলাস স্কয়ার) একজন নিজেকে আগুনে জ্বালিয়ে দিয়েছে।
দিনটি ছিলো ১৬ জানুয়ারি। মানুষ রাস্তায় কম ছিল। যারা ছিল তারা কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখল একজন তরুণ জামাকাপড় সব খুলে হাতের গ্যালনে থাকা গ্যাসোলিন শরীরে ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। গ্যাসলিন আগুনের ছোঁয়া পেয়েই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ওয়েনসেসলাস স্কয়ারে থাকা মানুষরা স্তব্ধ হয়ে দেখতে লাগলো জ্বলন্ত একটি দেহের ছুটোছুটি। তার চিৎকারে কিছু লোক গায়ে কোট এবং পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু করলো । যখন সে প্রায় অচেতন, তখন তার স্যুটকেস থেকে একটি চিঠি পাওয়া গেল। চিঠিতে লেখা ছিল,
যদি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেশের সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে সোভিয়েত অক্যুপেশনের বিরুদ্ধে না দাঁড়ায় তবে আমার মতো আমার সংগঠন থেকে আরও আসবে নিজেকে দেশের জন্য বিসর্জন দিতে …………… টর্চ নং. ১।
তার নাম ছিল জান পালাহ। ২১ বছর বয়সী এই তরুণ প্রাগের চার্লস ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। ‘সেল্ফ ইমোলেশন’ বা নিজেকে আগুনে দগ্ধ করার মাধ্যমে কোনো বার্তাকে পৌঁছে দেওয়ার ঘটনা এর আগেও ঘটেছে। এই ঘটনার কয়েক বছর আগেই ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালে সাইগন শহরের পাবলিক স্ট্রিটে নিজের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন ‘দ্য বার্নিং মনক’ নামে পরিচিত বুদ্ধ ভিক্ষু থিহ কুয়াং দুক।
চেকোস্লোভাকিয়া নাৎসি জার্মানদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে দেশে কম্যুনিস্ট শাসন শুরু হয় পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশগুলোর মতোই। পরিবর্তন এর হাওয়া লাগতে শুরু করে যখন ১৯৬৮ এর জানুয়ারিতে আলেকজান্ডার দুবচেক ক্ষমতায় আসেন। দুবচেক শাসন ব্যবস্থাকে ‘মানবিকীকরণ’ এর জন্য কিছু প্রকল্প হাতে তুলে নেন। ফলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা বাড়ে এবং সাধারণ মানুষ তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে। তখন রেডিও, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্রে মানুষ সরকারের বিরুদ্ধেও সমালোচনাও করতে পারতো, যা কয়েক বছর আগেও ছিলো অসম্ভব। প্রাগের এই বসন্ত স্থায়ী হয়েছিল ৮ মাস, যা ভঙ্গ হয় ১৯৬৮ এর ২১ আগস্ট শহরে সোভিয়েত ট্যাংকের আগমনের মধ্য দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো প্রাগে কোনো বিদেশী সৈন্য প্রবেশ করে। প্রাগের জনগণ রাস্তায় নেমে এর প্রতিবাদ করে, যার শেষ হয় শতাধিক আন্দোলনকারীর হতাহত হওয়ার মাধ্যমে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়ায় সৈন্য পাঠিয়েছিল ‘ওয়ারশ চুক্তি‘ অনুসারে, যা সোভিয়েতসহ পূর্ব ইউরোপের আটটি দেশের মধ্যে সম্পাদিত হয় ১৯৫৫ সালে পোল্যান্ডের ওয়ারশে। এই চুক্তি অনুযায়ী এই আট দেশ (সোভিয়েত ইউনিয়ন, আলবেনিয়া, পোল্যান্ড, রোমানিয়া, পূর্ব জার্মানি, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও চেকোস্লোভাকিয়া) এর মধ্যে শান্তি, বন্ধুত্বপূর্ণ, আর্থসামাজিক এবং সামরিক সম্পর্ক বজায় থাকবে। ফলে যখন প্রাগে মুক্ত বাতাসে মুক্ত চিন্তার বসন্ত চলছিল, সোভিয়েত এবং পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট পার্টির নেতারা ভেবে বসলেন চেকোস্লোভাকিয়া বোধহয় কম্যুনিস্ট শাসন থেকে বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে।
প্রাগে সোভিয়েত ট্যাঙ্ক প্রবেশ করার পর দেশের লোকজনের প্রতিবাদ কয়েকদিনও টিকতে পারেনি। সৈন্যরা এসেই প্রথমে দখল নেওয়ার চেষ্টা করে রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রের দপ্তরগুলো। সোভিয়েতরা দুবচেককে মস্কোতে নিয়ে যাওয়ার আগে দুবচেক সাধারণ জনগণকে নির্দেশ দেন শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে। জনসাধারণের প্রবল বিরোধের মুখে সোভিয়েত সৈন্যরা চালায় গুলি, গুলির পর ছত্রভঙ্গ হয়ে আন্দোলন পণ্ড হতে বেশিদিন সময় লাগে না। রাস্তাগুলো পুরোপুরি দখল করে নেয় সোভিয়েত ট্যাঙ্ক।
এর পরের সময়টা যতটা না ছিল পরাধীনতার, তার চেয়েও বেশি ছিল ভয় এবং শঙ্কার। সোভিয়েত ট্যাঙ্কের রাস্তা দখলের সময় তরুণ সাংবাদিক, ফটোগ্রাফাররা রাস্তায় থেকে যে ছবিগুলো তুলে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, সেগুলোই পরে পুলিশ ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করার জন্য। মস্কো থেকে কয়েকদিনের মধ্যেই দুবচেককে প্রাগে ফিরিয়ে আনা হয় এবং আবারও তাকে ক্ষমতায় বসানো হয়। কিন্তু মূলত দেশের সব রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে মস্কো থেকে। দেশে ফেরার পর রাষ্ট্রীয় রেডিও এবং টেলিভিশনে দুকচেকের দেয়া প্রাণহীন ভাষণ চেকদের আন্দোলনের স্পৃহাকেই নষ্ট করে দেয়।
জান পালাহর আত্মহত্যার চেষ্টা ছিল চেকদের আবারও একত্র করার একটা প্রচেষ্টা। তার মৃত্যুর পাঁচ মাস পর অবস্থা ছিল এরকম- রাজনৈতিক বন্দীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি, সরকার বিরোধীদের তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া, প্রাগ বসন্ত চলাকালে কম্যুনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে দেয়া সকল বক্তব্য প্রত্যাহার, সকল প্রতিষ্ঠানেই সাধারণ চাকরিজীবীদের মধ্য থেকে ইনফর্মার নিয়োগ দেয়া। তখন অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে, সবাই একে অপরকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। ভীত মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। ব্যাপারটা ছিল দেশকে একপ্রকার মেধাশূন্য করার মতো। কিন্তু এতে সরকার টিকে থাকে।
তবে পালাহ আত্মহত্যাই বা কেন করেছিলো এটা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। কিছুদিন আগে প্রকাশ হওয়া চিঠি থেকে জানা যায়, তার প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল প্রাগের মূল রেডিও ভবন দখল করে জনগণকে আন্দোলনের জন্য ডাক দেওয়া। কিন্তু তখনকার ঝিমিয়ে পড়া মানুষকে জাগানোর জন্য প্রচেষ্টাটা তার কাছে যথেষ্ট মনে হয়নি এবং তার এই প্রস্তাব সেসময়ের ছাত্রনেতারাও আমলে নেয়নি। এজন্য সবাইকে চমকে দেয়ার মতো এমন একটি কাজই করে বসে সে।
পালাহ মারা যায় তিন দিন পর; শরীরের আশি ভাগের বেশি পুড়ে গিয়েছিল তার। সে যে বিরোধীতার আহ্বান করেছিল তা সম্ভব হয়নি সরকারের তীব্র বিরোধীতার কারণে। তবে মানুষ রাস্তায় ছুটে আসে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে। রাস্তায় পুলিশের সাথে বাঁধে সংঘর্ষ। সে যে সংগঠনের কথা বলেছিলো সেটা আদৌ ছিল কি না সেটা জানা যায়নি কখনও। তবে তার মৃত্যুর কয়েকমাসের মধ্যে আরো তরুণ আগুন জ্বালিয়ে আত্মহত্যা করে তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে। যদিও অনেকেই মনে করে, পালাহর কোনো সংগঠন ছিল না। এটা ছিল সাধারণ জনতাকে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার জন্য আহ্বান।
জান পালাহ তার সুইসাইড নোটে কাউকে আত্মহত্যা করতে নিষেধ করে। কোনো সঠিক তথ্য না থাকলেও তার মৃত্যুর পরে আরও ২৬ জন আত্মহত্যা করে নিজেদের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে। তার মৃত্যুর একদিন পরে একইভাবে আত্মহত্যা করে জোসেফ লাভাটি নামের একজন। পালাহর মৃত্যুর এক মাস পর আরও কয়েকজনকে নিয়ে আত্মহত্যা করে জান জাইচ। তাদের কাছ থেকেও কয়েকটি চিঠি পাওয়া যায়। তার মধ্যে একটি চিঠিতে লেখা ছিলো,
মা, বাবা, ছোট ভাই-বোনেরা!
যখন তোমরা এই চিঠি পড়বে তখন হয়তো বা আমি মৃত, অথবা প্রায় মৃত। আমি জানি আমার মৃত্যুর ফলে তোমাদের উপর কী বয়ে যাবে, কিন্তু আমার উপর তোমরা রাগ করো না। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা এই পৃথিবীতে একা নই। এমনটা মনে করো না যে, আমি জীবনের উপর বিরক্ত হয়ে এই কাজ করেছি। আসলে আমি জীবনটাকে অনেক বেশিই ভালোবাসি এবং জীবনের মূল্য বুঝি। আমি জানি জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছুই নেই। আমি তোমাদের সবার জন্যই এতটাই বেশি চাই, এজন্যই আমি এত বড় আত্মদান করেছি। জাসেক এবং মার্তাকে ভালোভাবে লেখাপড়া করতে বলো। কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ো না। তোমার সাথে এতটা ঝগড়া করার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও মা।
আমার পক্ষ থেকে বন্ধুদের সালাম জানিও, বিদায় জানিও আমার প্রিয় নদীকে।
জান পালাহর দাবির কোনোটিই প্রতিফলিত হয়নি তার মৃত্যুর বিশ বছরের মধ্যেও। তবে সেসময় একটা অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছিল তার লেখা চিঠির কারণে। কোনো সাধারণ বিদ্রোহ না হলেও ব্যাপারটির স্পর্শকাতরতার জন্য কেউই সেসময় তার বিরুদ্ধে কথা বলেনি। তবে ঘটনাটি আস্তে আস্তে স্তিমিত হতে থাকলে সেসময়কার সরকারপক্ষের ব্যক্তিরা তার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতে থাকে। এমনকি এক নেতা জান পালাহর ঘটনাকে নিছক মজা করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বলে বলে চালিয়ে দেয়। এটি শেষ পর্যন্ত আদালতে গিয়ে গড়ায় এবং পালাহর মা ও বড় ভাই সেই নেতার বিরুদ্ধে পাবলিক শেমিং ও একটি দেশাত্মবোধক ঘটনাকে বিকৃত করার অভিযোগ আনে। তখনকার সরকারের চাপে অবশ্য মামলার রায় সেই নেতার পক্ষেই যায়। চার বছর পরে তার স্মৃতিকে সম্পূর্ণভাবে মিশিয়ে দেয়ার জন্য তাকে কবর থেকে তুলে আগুনে পুড়িয়ে শেষ চিহ্নটুকুও বিলীন করে দেয়া হয়। আন্দোলনের ভয়ে জান জাইচের অন্তেষ্টিক্রিয়া প্রাগে করতে দেয়া হয়নি। তাকে সমাহিত করা হয় তার নিজের শহর ভিতকভে।
এই ঘটনাগুলোর পরে দেশের বেশিরভাগ মানুষই রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় এবং নিজেদের পরিবারে বেশি সময় দিতে থাকে। আশির দশকের শেষ দিকে যখন পূর্ব ইউরোপ থেকে সোভিয়েত প্রভাব কমতে থাকে তখন প্রাগেও সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে জান পালাহর বিশতম মৃত্যুদিবসে ১৫-২১ জানুয়ারি ‘জান পালাহ সপ্তাহ’ ঘোষণা করা হয়। এই সপ্তাহ পালনের সময় পুলিশের সাথে সরকারবিরোধীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এর দশ মাস পরে ভেলভেট রেভ্যলুশনের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়ায় কম্যুনিস্ট সরকারের পতন হয়। ধারণা করা হয়, ‘জান পালাহ সপ্তাহ’ এর পেছনে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯০ সালে তাকে আবারও সেমেটারিতে পুনরায় দাফন করা হয়। প্রাগের একটি সড়কের নামও তার নামে করা হয়। এছাড়াও কিছু ইউরোপীয় শহরে তার নামে স্থাপনা রয়েছে এবং ১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত একটি গ্রহাণুর নামকরণ করা হয় ‘১৮৩৪ পালাহ’। পালাহ ও জাইচের সম্মানে উইনসেসলাস স্কয়ারে স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। এছাড়াও তাদের ভাস্কর্য আছে। ১৯৯১ সালে পালাহকে পুরস্কৃত করা হয় গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতায় অবদান রাখার জন্য।