“রাইটার’স ব্লক নিয়ে লেখার চাইতে একদম না লেখাই ভালো”
জার্মান-আমেরিকান সাহিত্যিক চার্লস বুকোওস্কি যদিও এমনটাই মনে করেন, তবু আজকের লেখাটি এ বিষয়েই। যারা লিখতে ভালোবাসেন এবং অনেকটা নিয়মিত লিখেন, তাদের ক্ষেত্রেই দেখা দেয় এই সৃজনশীল সমস্যাটি। ছন্নছাড়া অবস্থা, একের পর এক কাটাকুটি, এক লাইন লিখে থ মেরে বসে থাকা, লেখার বিষয়ের অধিক মাত্রায় অভাব, ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিছুই না করে বসে থাকা; একজন লেখকের পক্ষে সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত বোধ করি এগুলোই। একজন সৃষ্টিশীল ব্যক্তির সৃজনশক্তি ব্যাহত হলে তিনি প্রচণ্ড অসহায় বোধ করেন, তার অভিব্যক্তির দরজায় ঝুলতে থাকে বড়সড় একটা তালা! এই থমকে যাওয়া সময়টা যেন কাটতেই চায় না, বেরিয়ে আসা দুঃসাধ্য লাগে!
এ নিয়ে রয়েছে লেখকমহলে একটি মিথও। এখন আমরা যত সহজেই সমস্যাটিকে নির্ধারিত করে ফেলি ‘রাইটার’স ব্লক’ শব্দগুচ্ছ দ্বারা, প্রথমে তা এমন ছিল না মোটেও। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্যামুয়েল টেইলর কোলরিজ ‘অনির্দিষ্ট অবর্ণনীয় আতঙ্ক’ বলে অভিহিত করলেন লেখালেখিতে তার অনুৎপাদনশীলতাকে, এবং তা থেকেই ক্রমে আজকের এই ধারণাটি পেলাম আমরা। তারও আগের রোম্যান্টিক ইংরেজ কবিরা ভাবতেন, বাইরের কোনো এক জাদুকরী উৎস থেকে তাদের কলমে লেখা ফুটতো। যখন লেখা আসতো না, তারা ভাবতেন তাদের সেই কলমের কালি শুকিয়ে গিয়েছে এবং সেই জাদুর উৎস আর তাদের প্রতি অনুগ্রহ করছে না।
গদ্য-পদ্য সকলেই থামিয়ে দিয়েছে কলকাকলি, আপনি নিজস্ব ধু ধু মরুভূমিতে বসে আছেন, যদি একবার শব্দমালা এসে ধরা দেয় আপনার কলমে! হচ্ছে না, কিছুতেই হচ্ছে না। আপনার মনে হচ্ছে আপনি কখনো লিখেনইনি, পুরনো লেখা দেখে অবিশ্বাস হচ্ছে। ক্রমেই হতাশা জেঁকে ধরছে আপনাকে, এদিকে বয়ে যাচ্ছে সময়ের স্রোত, আপনার কাজের ঝুলিতে জমা পড়ছে একের পর এক শিডিউল মিস করা রুটিন! চাপ পড়ছে মাথায়, তা-ও কমছে না এই শূন্যতার বাতিক। নিজের অনুর্বরতায় নিজেই ক্ষুব্ধ আপনি।
কী করবেন এখন? ছেড়ে দেবেন বহু কষ্টে ধরা হালটা? নাকি ‘লেখক’ তকমাই ঝেড়ে ফেলবেন বলে ঠিক করলেন? একটু থামুন তবে। একসাথে ভাবা যাক, কী করে সুরাহা করা যায় এই অদ্ভুত সমস্যার, কীভাবে দূর করা যায় বিশেষ এই ব্লকটি?
কার্যের সাথে অনিবার্যভাবে যুক্ত কারণ। এক্ষেত্রেও প্রথমে আলোকপাত করা যাক কারণের দিকে।
কেন হয়?
- অনেক বেশি তাড়াহুড়া করে ফেলছেন না তো? যে বিষয়ে এখন না লিখে আরো একটু ভেবেচিন্তে ভাবনায় জমাট বাঁধার অপেক্ষা করতে হবে, তাকে এখনই কাগজে-কলমে বা কম্পিউটারের স্ক্রীনে উতরে দিতে খুব বেশি চাপ দিচ্ছেন কি নিজেকে? অনেকগুলো বিষয় মিলে মাথায় জটলা করেছে, কোনটা আগে বেরুবে বুঝতে পারছে না, স্থির হতে পারছেন না আপনিও। এই অস্থিরতার জন্যও কমে যেতে পারে আপনার গতি, থেমে যেতে পারে আপনার লেখনী।
- ভয়ের কারণে নিজস্ব পথও অচেনা মনে হয়, সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করা হয়। আপনিও কি ভয় পাচ্ছেন? লিখবার পর তা কেমন হবে, পাঠক-সমালোচকের অবিরত মতামতের কষ্টিপাথরে তা কতটা নিখাদ যাচাই হবে, এই ভাবনায় ঠিক নিজের মতো করে লিখতেই পারছেন না। লিখবার পর কী হবে সে ভাবনাই আপনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। কর্মফল এতটা গুরুত্বপূর্ণ আপনার কাছে যে কর্মই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠেছে। কিছু ‘লেখক’ কখনো লেখক হয়ে উঠতেই পারেন না এই ভয়ের জন্য, তা জানেন তো?
- খুঁতখুঁতে স্বভাবের পারফেকশনিস্ট হওয়ায় আপনার স্বতঃস্ফূর্ত লেখনী ডালপালা মেলতে পারছে না। তাদেরকে আপনি নিজেই যেন ছেঁটে ফেলছেন অভিজাত বাগানের সাজানো গোছানো একই আকৃতির সুশোভন কিন্তু কৃত্রিমতার স্বাদলাগা সৃষ্টিতে। খসড়াটা কখনোই হয়তো চূড়ান্ত রূপ হয় না, কিন্তু প্রথম খসড়াতেই থাকে পুরো লেখার আসল আদল। মূলভাবনাটা প্রথমবারেই ধরা পড়ে, তারপর শুধু তাকে ঠিকঠাক রূপটা দিতে হয়। কিন্তু আপনি সেই প্রথমেই চূড়ান্ত রূপ চাচ্ছেন, যা ঠিক লেখার নিয়মের মধ্যে পড়ে না! এ থেকে আপনার লেখার সংকট প্রতিনিয়ত বর্ধিষ্ণু।
- অখণ্ড মনোযোগের বিলাসিতা সব লেখকের জোটে না। হয়তোবা মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু সরে গেছে আপনারও। লক্ষ্যভেদে তাই এত মুশকিল হচ্ছে। আপনি আশেপাশের কোনো বিষয় বা কোনো দুশ্চিন্তায় জর্জরিত, ব্যক্তিজীবন ভারি হচ্ছে লেখকজীবনের উপর। লেখা শুধু লিখে ফেলাই নয়, এতে জড়িয়ে আছে শিল্পের কমনীয়তা। যান্ত্রিকভাবে আপনি খুব ভালো কিছু লিখে ফেলতে পারবেন না। লেখার প্রতি মনোযোগ না রেখে লিখতে গেলে কিছু দায়সারা শব্দ ছাড়া কিছুই উপহার দিতে পারবেন না। তবে হ্যাঁ, কিছু অতি দক্ষ লেখক যেকোনো পরিবেশেই লিখতে পারেন। তারা ব্যতিক্রম। সাধারণীকরণে দেখা যায়, মনোযোগের হেরফের এবং অন্যান্য দিকে ব্যস্ততা বৃদ্ধি লেখনী শক্তিকে রহিত করতে পারে।
- বাংলা সাহিত্যের সবচাইতে রোম্যান্টিক ডায়লগ “পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ”– এর মতোই আপনিও দিকভ্রান্ত হয়েছেন। আপনার লেখা নিয়ন্ত্রণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আপনি যদি গল্প কিংবা উপন্যাস লিখে থাকেন, চরিত্রগুলো আর আপনার কথা শুনছে না। নতুন নতুন চরিত্র হানা দিচ্ছে আপনার মনে। কাকে রেখে কাকে ফেলবেন, কাকে কোথায় স্থান দেবেন এমন দ্বিধাদ্বন্দ্বে আপনি থেমে গেছেন হুট করেই। অথবা আপনি হয়তো একটি প্রবন্ধে হাত দিয়েছেন, কিন্তু মূল প্রশ্ন থেকে এতটাই সরে এসেছেন যে কবে কীভাবে তাতে ফেরা যায়, বোঝা দুঃসহ। আপনি পথ হারিয়ে তাই পথিমধ্যেই থমকে আছেন, মুখোমুখি হয়েছেন রাইটার’স ব্লকের।
মুক্তির উপায় কী?
- ঠিক কী কারণে আপনি আর লেখালেখিতেই আপনার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু স্থির রাখতে পারছেন না? কোন বিষয়গুলো আপনাকে লেখালেখি থেকে দূরে সরাচ্ছে? আপনি কি বারবার সমস্যাগুলো এড়িয়ে গিয়ে লেখায় মন দেবার ভান করছেন? এবার একটু চোখ ফেরান। সমস্যা থেকে পালিয়ে লাভ হবে না, চোরাকাঁটার মতো বেঁধবেই। প্রথমে মনোযোগ সরে যাবার কারণ দূর করুন এবং তারপর মনোযোগ দেবার চেষ্টা করুন।
- লিখতে হলে পড়ার চেয়ে ভালো পথ আর নেই। তাই পড়ুন, পড়ুন এবং আরো পড়ুন। এতে করে মনের খোরাক জুটবে ভালো ও নতুন নতুন বিষয়ে লেখার আগ্রহ সৃষ্টি হবে। নিজে থেকেই কিছুদিন লেখালেখির চেষ্টা বাদ দিন এবং পড়ার জন্য অধিক সময় ব্যয় করুন। কিছুদিন পর লেখক-মস্তিষ্ক নিজে নিজেই সক্রিয় হবে।
- কোথাও ঘুরে আসুন। আপনার মধ্যে, আপনার মস্তিষ্কে যে জট বেঁধেছে, তা দূর করতে মুক্ত বাতাসের অনেক প্রয়োজন। হতে পারে আশেপাশের একঘেয়ে জীবন ও ছকে আপনি তিক্ত হয়ে গেছেন। পরিবর্তন চাইছে আপনার লেখকমনটা। একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে চাইছে কর্পোরেট আবহাওয়া থেকে। প্রকৃতির কাছাকাছি সুনির্মল বায়ু সেবনে তাই বেরিয়ে পড়াই যাক!
- একটু নিয়মে বাঁধতে চেষ্টা করুন নিজেকে। প্রতিদিন অন্তত নির্দিষ্ট কিছুসময় বা নির্দিষ্ট সংখ্যক শব্দ লিখতে পণ করুন নিজের কাছেই। এতে করে লাগামহীন ঘোড়া অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে।
- মেডিটেশনের মাধ্যমে দেহে ও মনে প্রশান্তি আসে। এ থেকে মনোযোগ বাড়বারও প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রতিদিন নিয়ম করে মেডিটেট করতে পারেন।
পেশা হিসেবে যারা লেখালেখিকে বেছে নিয়েছেন, তাদের জন্য রাইটার’স ব্লক আদতেই সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। জীবনের প্রতিটি অংশেই এই দুর্যোগ বেশ গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতে হবে নইলে তা ক্রমশ হতাশা বাড়িয়ে দেবে। মস্তিষ্কের উর্বরতাই যাদের বেঁচে থাকার মাধ্যম, তাদের ক্ষেত্রে অনুর্বরতা অনেক দুঃসহ। আবার লেখালেখি যাদের শুধু পেশা নয়, নেশাও, এদের ক্ষেত্রে লিখতে না পারার দুঃখটা আত্মঘাতীও হয়ে উঠতে পারে। বহু বিখ্যাত লেখক রাইটার’স ব্লকের জন্য কলম থামিয়ে দিয়েছেন চিরতরে। এই শিল্পটিকে যান্ত্রিকতার মধ্যে ফেলা যেমন অসম্ভব, তেমনি একে পুরোটাই সময়ের মনমর্জির উপর ছেড়ে দেওয়াও মুশকিল। কারণ সময় ও সুযোগের দাবিমতো চলতে হয় একজন লেখককেও। তাই রাইটার’স ব্লক এর কারণ ও উপায় সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা জরুরি।
ফিচার ইমেজ- medium.com