২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হবার পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিতর্ক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। অভিবাসনবিরোধী মনোভাবের জন্য অভিবাসী ও অমার্কিনীদের কাছে তিনি বিশেষভাবে আলোচিত-সমালোচিত। মেক্সিকানদের খুনী ও ধর্ষক বলে ডাকা, মুসলমানদের জন্য আলাদা পরিচয়পত্র চালুর প্রস্তাব, কয়েকটি মুসলিম দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আগমন নিষিদ্ধ করা, অবৈধ অভিবাসী বাবা-মায়ের কাছ থেকে পৃথক করে শিশুদেরকে খাঁচায় বন্ধী করে রাখা ও যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণের প্রস্তাব এসবের মধ্যে অন্যতম। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সব বিতর্ককে ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ট্রাম্পের বর্ডার ওয়াল নিয়ে।
২০১৫ সালে ট্রাম্প যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করার ঘোষণা দেন, সে সময়ই তিনি যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরির আহ্বান ও প্রতিশ্রুতি জানান। পাশাপাশি তিনি দাবি করেন, দেয়াল তৈরির খরচ মেক্সিকো বহন করবে। পরের একটি বছর প্রতিদিন প্রতিটি নির্বাচনী সভায় তিনি দাবি করেন, সীমানা দেয়াল তৈরির খরচ মেক্সিকো বহন করবে। তার প্রতিটি সভা শুরুই হতো “বিল্ড দ্যাট ওয়াল” স্লোগান দিয়ে। সভা শেষও হতো এই স্লোগান দিয়ে। সভার মাঝখানেও চলতো এই স্লোগান।
প্রচারণা সভাগুলোতে তিনি অজস্রবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে-মেক্সিকো সীমান্তে একটি ‘বিউটিফুল কংক্রিট ওয়াল’ নির্মাণ করবেন। সেই দেয়ালের মাঝখানে সুন্দর একটি দরজা থাকবে। সেই দরজা দিয়ে অভিবাসীরা বৈধভাবে আসা-যাওয়া করতে পারবে। শুরুর দিকে অবশ্য তিনি দেয়ালে কোনো দরজা রাখার কোনো কথা বলেননি। প্রতিপক্ষের সমালোচনার মুখে পরের দিকে তিনি বক্তব্যে এই অংশ যুক্ত করেন। প্রায় প্রতিটি নির্বাচনী সভায় তিনি দর্শকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতেন, “দেয়াল তৈরির খরচ কে দেবে?” ট্রাম্প সমর্থকরা চিৎকার করে বলতো, “মেক্সিকো!” শত শত টিভি ক্যামেরা সেসব বক্তব্য রেকর্ড করেছে। যদিও ট্রাম্প এখন সবকিছু অস্বীকার করছেন। তিনি দাবি করছেন, দেয়াল তৈরির খরচ মেক্সিকো বহন করবে এমন দাবি তিনি কখনো করেননি।
ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর তার মেয়াদকালের প্রথম দুই বছর রিপাবলিকানরা কংগ্রেসে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো। তখন চাইলে ট্রাম্প সহজেই দেয়াল তৈরির বিল পাশ করিয়ে নিতে পারতেন। কিন্তু তখন তিনি সীমানা দেয়ালের বরাদ্দ নিয়ে কথা তোলেননি। মিডটার্মের পর ডেমোক্র্যাটরা কংগ্রেসের দখল নেয়ার পর পর তিনি সীমানা দেয়ালের জন্য বিল পাশ করতে উঠেপড়ে লাগেন। ডেমোক্র্যাটরা সীমানা দেয়ালের জন্য বরাদ্দ দিতে রাজি হবে না তা সবারই জানা ছিলো। তাই রিপাবলিকানদের হাতে কংগ্রেস থাকাকালে দেয়াল বরাদ্দের জন্য বিল উত্থাপন না করে ডেমোক্র্যাটদের সাথে সীমানা দেয়াল নিয়ে ট্রাম্পের এ লড়াইকে অনেকে রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে জয়লাভের ক্ষেত্রে সীমানা দেয়ালের জন্য ট্রাম্পের এ লড়াই ভোটারদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বাড়াবে বলে ট্রাম্প দেয়াল নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অবশ্যম্ভাবীভাবে সীমানা দেয়ালের জন্য ৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিতে বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অস্বীকৃতি জানায়। এর প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর ট্রাম্প সকল ধরনের স্পেন্ডিং বিলে স্বাক্ষর করা বন্ধ করে দেন। স্পেন্ডিং বিলে স্বাক্ষর না করার ফলে লক্ষ লক্ষ সরকারি কর্মকর্তা কাজের জন্য বেতন পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন ও সরকারি বিভিন্ন খাতের খরচ বন্ধ হয়ে যায়। এ ধরনের পরিস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে গভর্নমেন্ট শাটডাউন বলে।
এ সময় কাজের জন্য বেতন পাননি বিধায় অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কর্মস্থলে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন। ফলশ্রুতিতে, স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, বিমানবন্দর থেকে শুরু করে বিভিন্ন জরুরি স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়, সরকারি অফিসে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়, ফুড ইন্সপেকশন বন্ধ হয়ে পড়ে, এমনকি ন্যাশনাল পার্কগুলোও পরিষ্কার করার কেউ থাকে না। কার্যত, গভর্নমেন্ট শাটডাউনের এ সময়ে যুক্তরাষ্টের চিত্র অনেকটাই তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মতো হয়ে পড়ে। সীমানা দেয়ালের বরাদ্দ নিয়ে ট্রাম্প ও বিরোধীদলের টানাপোড়েনের ফলাফল এ শাটডাউনটি আমেরিকান ইতিহাসের দীর্ঘতম শাটডাউনের রেকর্ড গড়ে, যার দৈর্ঘ্য ছিলো ৩৫ দিন!
নির্বাচনের আগে ট্রাম্প যখন “কংক্রিটের তৈরি” সীমানা দেয়াল করার ঘোষণা দেন, তখন অনেকেই তাকে জানিয়েছিলো, উচ্চ খরচের কারণে কংক্রিট দেয়াল তৈরি করা সম্ভব হবে না। তার চেয়ে বেড়া দেয়া অধিকতর বাস্তবিক সমাধান। কিন্তু ট্রাম্প দেয়ালের বদলে বেড়া তৈরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তার দাবি, কংক্রিট দেয়ালই হতে হবে; “অ্যা বিউটিফুল কংক্রিট ওয়াল!”
পরবর্তীতে অবশ্য ডেমোক্রেটরা দেয়ালের জন্য বরাদ্দ দিতে অস্বীকৃতি জানালে ট্রাম্প কংক্রিট দেয়াল তৈরির অতীত দাবি থেকে সরে আসেন। যখন তিনি বুঝতে পারলেন ৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কংক্রিট দেয়ালের সামান্য অংশও সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না, তখন তিনি কংক্রিট ওয়ালের বদলে স্টিল ফেন্স তৈরির ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। অথচ একসময় তিনি স্টিল ফেন্স করার ডেমোক্র্যাটদের প্রস্তাব জোরালোভাবে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সেই ব্যাপারও তিনি বেমালুম অস্বীকার করেন!
সীমানা দেয়ালের ৫ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের ব্যাপারে বিরোধী দলকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে ট্রাম্প হুমকি দেন, তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে জরুরি খাত থেকে দেয়াল তৈরির জন্য অর্থ নেবেন। দক্ষিণ সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে ট্রাম্প এটা করতে পারেন। সে সময় বিভিন্ন দেশ থেকে শরণার্থীরা আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য দক্ষিণ সীমান্তে ভিড় জমিয়েছেলো। জরুরি অবস্থার সমর্থনে ট্রাম্প দাবি করেন, এই শরণার্থীদের কাছে নানা ধরনের অস্ত্রশস্ত্র, বড় বড়, লম্বা-চওড়া, দ্রুতগতির গাড়ি রয়েছে। সেসব গাড়ি দিয়ে তারা সাঁই সাঁই করে সীমানা পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে যায়। এসব গাড়ি অত্যাধুনিক হওয়ায় সীমান্তের সিকিউরিটি তাদের সাথে কুলিয়ে উঠতে পারে না। যদিও সবাই জানে, ট্রাম্পের এসব দাবি সত্য নয় ও দক্ষিণ সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণার জন্যই তিনি এসব বলছেন।
ট্রাম্পের একগুঁয়েমীর মুখে শেষপর্যন্ত বিরোধী দল তাকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বদলে ১.৩ বিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়। কিন্তু ট্রাম্প সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পরদিন তিনি দক্ষিণ সীমান্তে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। যদিও বিশেষজ্ঞদের মত, ট্রাম্প চাইলেই কৃত্রিমভাবে জরুরি অবস্থা তৈরি করতে পারেন না ও এক খাতের বরাদ্দ অন্য খাতে ব্যয় করতে পারেন না। এ প্রেক্ষিতে বিরোধীদলের সমর্থকরা ট্রাম্পের জরুরি অবস্থা ঘোষণার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে মামলা করে। পাশাপাশি, সীমানা দেয়াল তৈরির জন্য যেসব অধিবাসীর জমি অধিগ্রহণ করা হবে তারাও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। দেখার বিষয় হচ্ছে, আদালতের রায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে গেলে তিনি সেটা মেনে নেন, নাকি দেয়াল তৈরির জন্য নতুন কোনো উপায় বের করেন!