চীনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ আর কাঠামো নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অনেকের উৎসাহ তৈরি করে, অনেককে আবার ফেলে দেয় ধাঁধার মধ্যে। স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারে বলা হয়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি চিরস্থায়ী না হলেও, রাষ্ট্রক্ষমতায় দীর্ঘদিন বহাল থাকার মতো ক্ষমতা এই রাজনৈতিক দলের আছে। অবশ্য, রাজনৈতিক একত্ববাদ রক্ষার জন্য সবকিছুই করছে কমিউনিস্ট পার্টি। বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ মতবাদ হচ্ছে, চীনে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কর্তৃত্বের সময়টা ফুরিয়ে আসছে, আগামী দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যেই ঘটতে পারে রাজনৈতিক পরিবর্তন। গত চল্লিশ বছরে আশিরও বেশি দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে বেরিয়ে গেছে, দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন মাত্রা আর ধরনের গণতন্ত্র। আঞ্চলিক আর আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই অভিজ্ঞতা থেকে চীনের কর্তৃত্ববাদের ক্ষয়ের ব্যাপারে ধারণা পাওয়া যায়, ধারণা পাওয়া যায় সম্ভাব্য গণতান্ত্রিক পটপরিবর্তনের ব্যাপারেও।
চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন টিকে থাকার ব্যাপারেও বুদ্ধিবৃত্তিক ঘরানা থেকে মতবাদ রয়েছে। তাদের মতে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি রাজনৈতিক নিপীড়নের মাধ্যমে ভিন্নমত দমনে সাফল্য দেখিয়েছে, আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কমিউনিস্ট পার্টির শাসনেই চীনের হয়েছে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক উন্নয়ন।
কমিউনিস্ট পার্টির শাসন কেন টিকে থাকবে, এই যুক্তির বিপরীতে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের আলোকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ববাদের কেন সমাপ্তি আসছে, সেই যুক্তিও দেওয়া যায়। অনেকগুলো যুক্তির মধ্যে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্ষয় আর পতনের ব্যাপারে দুটি যুক্তি তুলে ধরা যায়।
প্রথমত, যৌক্তিক কারণেই সময়ের সাথে কর্তৃত্ববাদের ক্ষয় ঘটে। একদলীয় শাসনের ক্ষেত্রেও ঘটে একই ঘটনা, সময়ের সাথে কাঠামোগত ক্ষয় হয়, অভিজাতশ্রেণির কাঠামোগত সম্পর্কগুলোতে আসে বিভাজন। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মদক্ষতায় ঘাটতি আসতে শুরু করে, উত্থান ঘটতে থাকে ক্যারিয়ারপন্থী সুবিধাবাদীদের। অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাবাদী শ্রেণি শাসনকাঠামোতে বিনিয়োগ করে, বিনিয়োগ করে শাসকের টিকে থাকার উপরও। আবার, বিনিয়োগ থেকে এরা পেতে চায় সর্বোচ্চ ফলাফল। এর ফলে, দুর্নীতি খুব দ্রুত বেড়ে যায়, গভর্নেন্সের মানে পতন ঘটে, পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে নাগরিক ক্ষোভ। সময়ের সাথে একদলীয় কাঠামোগুলোর ক্ষয়ের ব্যাপারটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে তুলে ধরা যায়।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী একদলীয় শাসনের রেকর্ডটি ৭৪ বছরের, যেটি রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি অব সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। মেক্সিকোতে একদলীয় শাসন টিকে ছিল ৭১ বছর, তাইওয়ানে টিকে ছিল ৭৩ বছর। এই একদলীয় কাঠামোগুলো তাদের পতনের এক দশক আগে থেকে কাঠামোগত ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শুরু করে, জনগনের ক্ষোভের প্রকাশের শুরুও হয় সেই সময়ে। কমিউনিস্ট পার্টি ইতোমধ্যেই ৬৩ বছর চীনকে শাসন করেছে। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা যদি চীনের ক্ষেত্রেও একইরকম হয়, তাহলে আগামী দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে চীন টিকে থাকার সর্বোচ্চ সময়সীমায় পৌঁছাবে।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বেড়ে যাওয়া, নগরায়নের উচ্চ হার আর যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি সামষ্টিক কার্যক্রমের খরচ কমিয়ে দেয়, কর্তৃত্ববাদী শাসনকে নৈতিকতার সংকটে ফেলে, জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে গণতন্ত্রের চাহিদা। ফলে, দরিদ্র আর কৃষিভিত্তিক সমাজকে কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা যতটা সহজে শাসন করতে পারেন, আর্থ-সামাজিক উন্নতির সাথে সাথে সেই প্রক্রিয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হতে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, জনগণের গড় মাথাপিছু আয় ১,০০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে কর্তৃত্ববাদী শাসন ভঙ্গুর হতে শুরু করে। গড় মাথাপিছু আয় ৪,০০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে গণতন্ত্রায়নের চাপ বাড়ে দ্রুত।
তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর বাইরে, খুব কম দেশেই গড় মাথাপিছু আয় ৬,০০০ হওয়ার পর স্বৈরশাসন টিকে থাকে। বর্তমানে, চীনের গড় মাথাপিছু আয় ৯,১০০ ডলার। গত শতাব্দীতে দক্ষিণ কোরিয়ায় গড় মাথাপিছু আয় এর কাছাকাছি থাকা অবস্থাতেই গণতন্ত্রের পথচলা শুরু হয়, গড় মাথাপিছু আয় দশ হাজার ডলারের কাছাকাছি থাকা অবস্থাতেই একইধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে তাইওয়ানেও।
আগামী দশ থেকে পনেরো বছরের মধ্যে চীনের গড় মাথাপিছু আয় পনেরো হাজার ডলার ছাড়িয়ে যাবে, নগরায়নের হার হবে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ। কর্মী আর সম্পদের ব্যবস্থাপনায় ইতোমধ্যেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি একটি কঠিন সময়ে পার করছে, মাথাপিছু আয় বাড়ার সাথে সাথে এই সংকট আরো দীর্ঘায়িত হবে।
এই দুটি ব্যাখ্যা যদি চীনে সম্ভাব্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের ব্যাপারে যুক্তি তুলে ধরতে পারে, তাহলে পরবর্তী প্রশ্নটি আসে, কঠোর কর্তৃত্ববাদী চীনে এই ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কীভাবে হবে?
সত্তরের দশক থেকে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বিদায় হয়েছে, এসেছে গণতান্ত্রিক শাসন। এই দেশগুলোর ক্ষমতার পটপরিবর্তনের রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে চীনের সম্ভাব্য ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পাঁচটি উপায় তুলে ধরা যায়।
মসৃণ সমাপ্তি
সংঘাতহীন পরিবেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটলে, সেই রাজনৈতিক পরিবর্তন তুলনামূলকভাবে বেশিদিন টিকে থাকে। চীনের ক্ষেত্রেও, সম্ভাব্য যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের জন্য সংঘাতহীন পথই হবে সর্বোত্তম পন্থা। সাধারণত, এই ধরনের শান্তিপূর্ণ ক্ষমতার পালাবদলের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধাপ থাকে, গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হয় অভিজাত শ্রেণিকে। এর শুরুটা হয় শাসকের বৈধতার সংকট থেকে। শাসকের বৈধতার সংকট অর্থনৈতিক দূরাবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়, সামরিক ব্যর্থতার দ্বারা প্রভাবিত হয়, গণপ্রতিরোধের উত্থানের ফলেও তৈরি হয় বৈধতার সংকট। আবার, রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণেও বৈধতার সংকট তৈরি হতে পারে, হতে পারে সীমাহীন দুর্নীতির কারণেও। শাসকদের এই ধরনের বৈধতার সংকট শুরু হলে সাধারণত শাসকদের মধ্যে থেকে একটা অংশ বেরিয়ে আসে, তৈরি করে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ। আবার, শাসকদের অনেকেই আশু পতন দেখতে পান, তারাও ক্ষমতা থেকে শান্তিপূর্ণ প্রস্থানের উপায় তৈরি করার চেষ্টা করেন।
এই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি দলীয় কাঠামোর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, তাহলে তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার মাধ্যমে গণতন্ত্রায়নের সুযোগ করে দেন, নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনেন সিভিল সোসাইটির উপরও। এরপর তারা বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সংলাপে বসেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে, পরিবর্তন পরবর্তী রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে। সাধারণত, এই ধরনের সংলাপে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়মুক্তি চাওয়া হয়, যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, রাজনৈতিক অধিকার হরণ করেছে, রাজনৈতিক নিপীড়ন চালিয়েছে। ক্ষমতাসীনদের সাথে যুক্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়মুক্তির ব্যাপারগুলোও থাকে আলোচনায়, আলোচনায় থাকে এদের বহাল রাখার বিষয়টিও। এই ধরনের সমঝোতা একবার তৈরি হয়ে গেলে, ক্ষমতাসীন কাঠামো সাধারণত নির্বাচন আয়োজন করে। নির্বাচনে কারচুপির ঘটনা না ঘটলে, সাধারণত ক্ষমতাসীনরা নির্বাচনে হেরে যায়, উন্মুক্ত হয় গণতন্ত্রায়নের পথ।
কিন্তু, চীনের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সংঘাতহীন রাজনৈতিক পরিবর্তন নির্ভর করবে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটদের উপর, বৈধতার সংকট কোন মাত্রায় থাকা অবস্থাতে তারা পরিবর্তনের সাথে মানিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তার উপর। সংঘাতহীন রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছে তাইওয়ান, ম্যাক্সিকো আর ব্রাজিলের মতো দেশে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটরা অনেক বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছিল। এসব দেশে আবার বৈধতার সংকটে থাকা রাজনৈতিক কাঠামোগুলোর জনসমর্থনের কিছু ভিত্তি ছিল, এরা রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে ক্ষমতাসীনদের সাহায্য করেছে। অর্থাৎ, বৈধতার সংকটে থাকা একটি শাসকদল যত তাড়াতাড়ি ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়া শুরু করবে, ততটাই সংঘাতহীন হবে হস্তান্তর প্রক্রিয়া, উপকারী হবে শাসক আর নাগরিকদের জন্য। রাজনৈতিক ভিন্নমতকে দমন করার মতো একটি শক্তিশালী কাঠামো সাধারণত সংস্কার মেনে নেওয়ার মতো সক্ষমতা দেখাতে পারে না। চীনের ক্ষেত্রে, চীনাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে আগামী পাঁচ বছরে শাসকদের কর্মকান্ডের উপর ভিত্তি করে।
ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক বলয়ে সংস্থারপন্থীদের উত্থান
এটি সংঘাতহীন রাজনৈতিক পালাবদলের একটি বিকল্প ধারা। এই দৃশ্যকল্পে আগামী দশকগুলোতে নাগরিকদের বয়স বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমবে, উচ্চ নগরায়নের ফলে সামাজিক কাঠামোর অবক্ষয় ঘটবে, বিদ্যমান দুর্নীতি হয়তো আকাশছোঁয়া আকার ধারণ করবে, বাড়বে সামাজিক আর অর্থনৈতিক বৈষম্য। এইধরনের সামাজিক পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যেই সংস্কারপন্থীদের উত্থান ঘটতে পারে, কোণঠাসা হয়ে যেতে পারে কট্টরপন্থীরা। কট্টরপন্থীদের ক্ষমতার বলয় থেকে সরিয়ে হয়তো গর্ভাচেভের মতো কারো উত্থান ঘটবে, যিনি নাগরিকদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেবেন, নিশ্চিত করতে চাইবেন সরকারের জবাবদিহিতা। এই ধরনের সংস্থারপন্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে সাধারণত কট্টর গণতন্ত্রকামীদের উত্থান ঘটে, মডারেট সংস্কারপন্থীদের সরিয়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যে প্রক্রিয়া ঘটিয়েছিলেন বরিস ইয়েৎসেলিন, মিখাইল গর্ভাচেভকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে।
চূড়ান্ত পর্যায়ে সাধারণত গণতন্ত্রপন্থীরা বিপুল জনসমর্থন আদায় করে নেন, ক্ষমতাসীন বলয়ের অনেক রাজনীতিবিদ বিভিন্ন ধাপে যোগ দেন বিরোধী রাজনৈতিক কাঠামোতে। অনেক সময় ক্ষমতার রাজনৈতিক বলয়ের সাথে সংলাপে বসে না বিরোধী রাজনৈতিক বলয়ের নেতারা, জনসমর্থনহীন দলের জন্য দ্রুত এক্সিট পয়েন্টের ব্যবস্থা করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন আনেন তারা।
চীনের ক্ষেত্রে যদি এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটি বিস্ময়করই হবে। গত দুই দশক ধরে তারা সচেতনভাবে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ভুলগুলো এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, শিক্ষা নিতে চেয়েছে ভুলগুলো থেকে।
তিয়েন-আনমেন রিডাক্স
এটি চীনের গণতন্ত্রায়নের তৃতীয় সম্ভাব্য পদ্ধতি। এই ধরনের দৃশ্যকল্পে জনগণের রাজনৈতিক আদর্শে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, তীব্র হতে থাকে রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে মতামত। আর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক কাঠামো ক্রমাগতভাবে সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে থাকে, আটকে দিতে থাকে গর্ভাচেভের মতো বলয়ের ভেতরকার সংস্কারপন্থীদের। এরকম পরিস্থিতিতে সাধারণত দেশব্যাপী রাজনৈতিক পরিবর্তনের পক্ষে সামাজিক সমর্থন গড়ে উঠে।
চীনে একইধরনের একটি পরিস্থিতির সূচনা হয়েছিলো ১৯৮৯ সালে, যা তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ঘটনার দিকে ধাবিত করে চীনাদের। সেই সময়ে, চীনের সামরিক বাহিনী হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বেঁচে যায় কমিউনিস্ট পার্টি, টিকে থাকে ক্ষমতার মসনদে। প্রসঙ্গত, সত্তরের দশক থেকে যেসব দেশে এই ধারার সফল রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, সবগুলো ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী রেখেছে সংস্কারপন্থীদের পক্ষে ভূমিকা।
অর্থনৈতিক মন্দা
১৯৯৭-৯৮ সাল। এশিয়াতে তখন চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। এই মন্দার প্রভাব পড়ে দ্বীপরাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ার রাজনৈতিক কাঠামোতে, পতন ঘটে দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা সুহার্তোর। ইন্দোনেশিয়ার ব্যাংকিং কাঠামোর মতো চীনের ব্যাংকিং কাঠামোও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত, দুর্বল ব্যবস্থাপনার সাথে আছে দুর্নীতির ঘটনা। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রেও অকার্যকর খাতে ঋণ দিয়েছে চীনের ব্যাংকগুলো, যেগুলোতে ঘটতে পারে ঋণ খেলাপের ঘটনা। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীনের ব্যাংকগুলোতে অপ্রথাগত ব্যাংকিংয়ের ঘটনা বাড়ছে, যা অস্থিতিশীল করে দিতে পারে অর্থনৈতিক কাঠামোকে।
চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্থের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করে, নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনৈতিক আদান-প্রদানও। মুদ্রার বিনিময় হারও নির্ধারিত হয় রাষ্ট্রীয়ভাবেই, অর্থনৈতিক কাঠামোর উপরও রয়েছে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ। এই ধরনের একটি নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক কাঠামো মন্দার মুখোমুখি হলে, তার পুরো দায় গিয়ে পড়বে নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্রের উপর। রাষ্ট্র এইরকম অবস্থাতে অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক করতে না পারলে, দ্রুত দেশকে মন্দা থেকে বের করে আনতে না পারলে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে, জনসমর্থন কমবে ক্ষমতাসীনদের। কেবলমাত্র অর্থনৈতিক মন্দার কারণে অবশ্য রাজনৈতিক বলয়ের পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেশ কম। তবে, চীনের ক্ষেত্রে একটি অর্থনৈতিক মন্দা কমিউনিস্ট পার্টি পার করতে পারলেও, মন্দা পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ শাসকদের বৈধতার সংকট তৈরি করতে পারে।
পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে রাজনৈতিক পরিবর্তন
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে ক্ষমতার পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে, ঘটেছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিবর্তনের ঘটনা। কিন্তু, পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে এই ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা সবসময়ই কম থাকে। পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারা বদলে যায়, শারীরিক সুস্থতার হার কমে, কর্মদক্ষমতার হ্রাস ঘটে, ঘটে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি। চীনের মতো একদলীয় রাষ্ট্রকাঠামোতে সরকার পরিবেশ সংক্রান্ত নীতি নির্ধারণে মনোপলি উপভোগ করে, আবার খরা, মরুকরণের মতো ঘটনার দায়ও এসে পড়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ঘাড়ে। উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক এক্টিভিজিম শুরু করতে পারে, যা পরবর্তীতে বৃহৎ পরিসরে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির জন্য এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিষয়াবলিতে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অপ্রয়োজনীয় মনে হতে পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও খুব বেশি উৎসাহ দেখানোর কথা না। এখন পর্যন্ত খুব অল্প মানুষই চীনে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ব্যাপারে গুরুত্ব সহকারে ভেবেছে, তুলে এনেছে সম্ভাবনাগুলো। এই প্রবন্ধ এই ধরনের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সম্ভাব্যতা তুলে ধরেছে, কল্পনার বাইরে রাজনৈতিক পরিবর্তনুগুলো নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে।
*এই আর্টিকেলটি ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘দ্য ডিপ্লোম্যাটে’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ 5 Ways China Could Become a Democracy‘ শিরোনামে। কর্তৃত্ববাদের ধরন, সামগ্রিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিত চিত্র তুলে ধরা এই আর্টিকেলটি রোর বাংলার পাঠকদের জন্য বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।