প্রাক্তন ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ যখন পাকিস্তানে গত ২৫ জুলাইয়ের নির্বাচনে ভালো ফল করে এবং দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার নাম উঠে আসে সামনের সারিতে, তিনি জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণে বলেন যে, ভারতের সঙ্গে তিনি সম্পর্ক ভালো করতে আগ্রহী এবং ভারত যদি এক পা এগোয়, পাকিস্তান দু’পা এগোবে। পঁয়ষট্টি বছর বয়সী ইমরান খানের কথা শুনে মনে হয়েছিল যে, তিনি বোধহয় সত্যিই পাকিস্তানের রাজনৈতিক গতিধারায় একটি পরিবর্তিত চিন্তাধারা আনতে চলেছেন।
কিন্তু সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রীদের প্রস্তাবিত বৈঠক বাতিল হওয়াকে কেন্দ্র করে যে ভাষায় খান সাহেব ভারতীয় শাসকদের আক্রমণ করলেন, তাতে মনে হল যেন তার জুলাইয়ের বচনে যথার্থতা কমই ছিল।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘কুমতলব’-এর অভিযোগ এনে ভারত বিদেশমন্ত্রীদের বৈঠকের প্রস্তাব গ্রহণ করেও তা বাতিল করলে চরম ক্ষুব্ধ হন ইমরান। সোশ্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো তেড়ে আসেন ভারতের দিকে, বলেন, “শান্তিপ্রক্রিয়া পুনরায় চালু করার যে প্রস্তাব রেখেছিলাম আমরা, তার প্রতি ভারতের উদ্ধত এবং নেতিবাচক সাড়া দেখে আমি হতাশ। তবে আমি সারাজীবন ধরেই বড় বড় পদে ক্ষুদ্র লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত হতেই দেখেছি। এই ক্ষুদ্র মানুষগুলির বড় দৃষ্টিভঙ্গির অভাব।”
শিশুসুলভ আচরণ করলেন ইমরান খান; অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ধাঁচে
ইমরান খানের এই মন্তব্য শিশুসুলভ মনে হয় তো বটেই, পাশাপাশি এটাও মনে হয় যে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্যে যে ধৈর্য এবং স্থিতিশীল মানসিকতার প্রয়োজন, তা তার নেই। অনেকটা মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের লাগামছাড়া মন্তব্যের মতোই তার কথাগুলি বললেন যা আদতে ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্ককে ভালোর বদলে আরও খারাপ করতে পারে।
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য ডন’-এর একটি সম্পাদকীয়তে ভারতকে তুলোধুনা করা হলেও তাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরানের মন্তব্য সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে যে শব্দচয়নে তিনি আরেকটু সচেতন হলেই ভালো করতেন। তবে তাতে এ-ও বলা হয়েছে যে ব্যক্তিগত হতাশা এবং শাসকের ভূমিকায় অনভিজ্ঞতার কারণেই তিনি হয়তো এরকম কথা বলেছেন।
হতাশা বা অনভিজ্ঞতার কারণগুলোকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কিন্তু ইমরানের এটুকু অবশ্যই মাথায় রাখা উচিত ছিল যে তিনি যেই বিষয়ে কথা বলছেন, গত সাত দশকে তার কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি; যা নিয়ে সর্বক্ষণ তেতে থাকে দুই প্রতিবেশী আর যেই সম্পর্কে রক্তক্ষরণের কোনো বিরাম নেই। সেখানে তাকে আরেকটু বিচক্ষণ হয়ে মন্তব্য করতে বলার মতো কি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কোনও নির্ভরযোগ্য উপদেষ্টামণ্ডলী নেই? যদি না থাকে আর যদি থাকলেও প্রধানমন্ত্রী তাদের কথা কানে তোলার প্রয়োজন মনে না করেন, তাহলে বলতেই হয় যে পাকিস্তানের সাম্প্রতিকতম রাজনৈতিক পালাবদলের বিশেষ সুবিধা আগামী দিনে দেখতে পাওয়া যাবে না।
ইমরান খানের মন্তব্যটি কাম্য ছিল না অনেকগুলো কারণেই।
ভারতের সাধারণ নির্বাচন আর বেশিদিন নেই
প্রথমত, পিটিআই সুপ্রিমোর বোঝা উচিত যে ভারতে পরবর্তী নির্বাচনের আর ছয় মাসের বেশি কিছু সময় বাকি রয়েছে। এই সময়ে ভারতের হিন্দুবাদী শাসকদল বিজেপির পক্ষে পাকিস্তানের দিকে নিঃস্বার্থভাবে মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াতে যে ঝুঁকি রয়েছে, তা একজন শিশুও বলতে পারে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পাকিস্তান নীতি নিয়ে একেই নানা মহলে নিন্দা শোনা যাচ্ছে; বলা হচ্ছে যে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি’ নিয়েও তিনি পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিতে পারেননি। তার উপর রয়েছে কাশ্মীর যেখানে সন্ত্রাসবাদ এবং সামাজিক অস্থিরতার সমস্যা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
পাকিস্তান উল্টো ভারতের দিকে কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তীব্র অভিযোগ তুলছে; আন্তর্জাতিক মহল থেকেও ভারতের দিকে ছুটে আসছে প্রতিক্রিয়া। এই অবস্থায় নয়াদিল্লির হিন্দুবাদী সরকারের পক্ষে সাদা কবুতর ওড়ানো এক কথায় বেশ কঠিন। তাতে চটে যেতে পারে বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদী সমর্থকরা; মোদী দুর্বল প্রতিপন্ন হতে পারেন ইমরানের প্রস্তাব গ্রহণ করলে। বলা হতে পারে যে, ভারত কম শান্তির উদ্যোগ নেয়নি প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে কিন্তু প্রতিবারই তা ফিরে এসেছে বুমেরাং হয়ে। ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ মোদী তাই সে পথে হাঁটবেন না তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। গত কয়েক বছরে পাকিস্তানের প্রসঙ্গে ভারত যে কট্টরপন্থা নিয়ে এগিয়েছে, তা নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ত্যাগ করে ফের সেই নিঃস্বার্থ মিত্রতার হাত এগিয়ে দেওয়ার অবস্থান যে মোদী নেবেন না তা বলাই বাহুল্য। জাতীয়তাবাদী আফিম আজ রাজ্যশাসনে এক পরম প্রয়োজনীয় বস্তু।
ইমরান খান এটাই বুঝতে চাইছেন না।
অথচ পাকিস্তানে যখন নির্বাচনী দামামা বেজে ওঠে, সেখানকার রাজনৈতিক এবং অন্যান্য শক্তিগুলো কিন্তু ভারত কার্ড খেলতে কখনই সংকোচ বোধ করে না। হয় ভারতের বিরুদ্ধে জিগির তুলে বা ভারতে ঘটিত সন্ত্রাসবাদী তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে ঘরোয়া দুশমনকে লক্ষ্য করা, কোনো কিছুতেই পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের পিছপা হতে দেখা যায় না। এই বছরের নির্বাচনের প্রাক্কালে যেমন ২০০৮ সালে মুম্বাইতে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসবাদী হামলার ইস্যুটিকে তুলে ঘরোয়া শত্রুদের লক্ষ্যমাত্রা করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ; আসল লক্ষ্য ছিল সামরিক শক্তিকে জনসমক্ষে ঠেস দেওয়া, যা পাকিস্তানের অসামরিক নেতৃত্ব করে উঠতে সফল হয়নি এ যাবৎ। কিন্তু সবমিলিয়ে, ভারতের প্রাসঙ্গিকতা পাকিস্তানি নির্বাচনী রাজনীতিতে বরাবরই থাকে আর যদি তা-ই থাকে, তবে ভারতের নির্বাচনী রাজনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব একইরকমভাবে থাকবে না কেন মনে করলেন ইমরান খান?
ইমরানের বোঝা উচিত ছিল যে, ২০১৪ সালে যখন মোদী তার শপথগ্রহন অনুষ্ঠানে শরিফকে ডাকেন, তখন শরিফেরও ক্ষমতায় আসার এক বছরও হয়নি। অর্থাৎ, দুই নেতাই তখন ক্ষমতায় নতুন আর তাই তাদের মধ্যে ভারত-পাক শান্তি মারফত রাষ্ট্রনেতা হয়ে ওঠার আকর্ষণ যথেষ্ঠ। কিন্তু এই মুহূর্তে মোদীর মেয়াদকাল শেষ হয়ে আসার মুখে ইমরান যদি মনে করেন তিনি ২০১৪-র মতো একই আগ্রহ নিয়ে ঝাঁপাবেন সম্পর্ক উন্নত করতে, তাহলে ভুলটা তারই। মোদী যে তার পাকিস্তান নীতিতে কোনো বদল ঘটাবেনই না তা বলা যায় না, কিন্তু এটুকু অন্তত বলা যায় যে ইমরান খানকে ভারতের পরবর্তী নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। যদি মোদী জিতে ক্ষমতায় ফের আসেন তো ভালো, আর যদি না আসেন তবে যেই আসুন তিনিও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার উপরে অন্তত প্রাথমিক গুরুত্ব দেবেন।
মোদীকে পরোক্ষে আক্রমণ করে ভারতের মানুষের চোখে নিজেকে ছোট করলেন পাক প্রধানমন্ত্রী
তবে এসব তো সম্ভাবনার কথা। প্রধানমন্ত্রী খান ভারতীয় নেতৃত্বকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করে নিজেকে ভারতের সাধারণ মানুষের চোখে ছোট করলেন যেটা তার নিজের পক্ষেও ভালো হলো না। বর্তমানে ভারতে নরেন্দ্র মোদী সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয় নেতা যাকে এদেশের মানুষ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় এনেছে। তাকে আক্রমণ করে খান ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক পছন্দের যে বার্তাটি দিলেন তা দু’দেশের মধ্যে এক শান্তিময় বাতাবরণ তৈরির পক্ষে মোটেই অনুকূল নয়। ইমরানের আক্রমণাত্মক টুইটটির পরে পরেই আমরা লক্ষ্য করলাম কীভাবে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নানা মঞ্চে পারস্পরিক দোষারোপ আরও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল যার অর্থ, নয়াদিল্লি এবং ইসলামাবাদের মধ্যে শান্তির সম্ভাবনা এখন প্রায় বিশ বাওঁ জলে।
ইমরান খান সেই অর্থে অভিজ্ঞ প্রশাসনিক রাজনীতিবিদ না হওয়ার দরুন হয়তো তার ধৈর্যের বাঁধ তাড়াতাড়ি ভেঙেছে। তিনি হয়তো রাতারাতি ভারত-পাক সম্পর্কে ইতিবাচক বদল চাইছেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় আর সেই সারসত্যটা প্রাক্তন এই ক্রিকেটারকে বুঝতে হবে। নিজের খেলোয়াড়ি পরিচয়ে অতীতে ভারতের মানুষের কাছেও ভালোবাসা, শ্রদ্ধা পেয়েছেন ইমরান খান। আনাড়ী রাজনৈতিক চালে তা নষ্ঠ করে আখেরে নিজের এবং পাকিস্তানের স্বার্থকে ব্যাহত যাতে তিনি না করেন, সেই পথটি বাতলে দেওয়ার মতো কি কোনো উপদেষ্টা পাকিস্তানে নেই?