কানাডার মুক্ত গণতন্ত্র
উত্তর আমেরিকায় মানুষের প্রথম পদচিহ্ন পড়ে প্রায় চৌদ্দ হাজার বছর আগে, সাইবেরিয়ানদের মাধ্যমে। নগররাষ্ট্রের যুগ পেরিয়ে উত্তর আমেরিকায় আবার মানুষের পদচিহ্ন পড়ে সাম্রাজ্যবাদের যুগে। তখনকার সর্বজয়ী ব্রিটিশরা প্রথম উত্তর আমেরিকায় আসে ১৪৯৭ সালে, ফরাসিরা আসে ১৫৩৪ সালে। আটলান্টিক উপকূল জুড়ে মৎস্যসম্পদ আহরণের জন্য এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতে থাকে ব্রিটিশ আর ফরাসিদের মধ্যে, বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় হয় একের পর এক যুদ্ধ।
ফলে, প্রথমদিকের নিয়ন্ত্রণ পায় ফরাসিরা, কলোনি প্রতিষ্ঠা করে ১৫৩৪ সালে। একটা সময় নিয়ন্ত্রণ চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে, সাত বছর স্থায়ী যুদ্ধে ফরাসিরা পরাজিত হয়ে মোটামুটি মুছে যায় তখনকার দৃশ্যপট থেকে, প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ উপনিবেশ। এই ইউরোপীয়ানদের আগমনের প্রভাব পড়ে আদিবাসীদের ওপর, তাদের সাথে করে নিয়ে আসা বিভিন্ন রোগে মারা যায় ৪০ থেকে ৮০ শতাংশ আদিবাসী।
উত্তর আমেরিকানরা ব্রিটিশ শাসকদের কাছে দাবি জানাতে থাকে ‘দায়িত্বশীল সরকার’ এর জন্য, যার প্রকাশ ঘটে ১৮৩৭ সালের বিদ্রোহে।
কানাডার গণতন্ত্র
কানাডার গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৭ সালে, ব্রিটিশ নর্থ আমেরিকা অ্যাক্টের মাধ্যমে অন্টারিও, কিউবেক, নোভা স্কটিয়া আর নিউ ব্রুনসইকের কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে। কানাডা নামে এই কনফেডারেশনে চার বছর পর যুক্ত হয় ব্রিটিশ কলম্বিয়া ও ভ্যানকুভার, আরো দু বছর পর যুক্ত হয় প্রিন্স অ্যাডওয়ার্ড প্রদেশ।
বিভিন্ন ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ ওয়েস্ট মিনিস্টার থেকে কনফেডারেশনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কানাডিয়ানদের কাছে আসে আসে ১৯৮২ সালে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। বর্তমানে ফেডারেল সরকার ব্যবস্থায় দশটি প্রদেশ আর তিনটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত কানাডা। সাংবিধানিকভাবে এখনো প্রতীকী রাজতন্ত্র আছে কানাডায়, সরকারের নেতৃত্ব দেন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী।
কানাডার গণতন্ত্র কেন প্রশংসনীয়?
কনফেডারেশনের যাত্রা শুরুর সাথে সাথেই কানাডার গণতান্ত্রিক কাঠামোর যাত্রা শুরু হয়। এই দীর্ঘ সময়ে শাসনব্যবস্থায় একবারও অনির্বাচিত সরকার আসেনি, সহিংসতায় জড়ায়নি রাজনৈতিক দলগুলো, প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ব জুড়ে।
প্রথমত, কানাডাতে ভারসাম্যপূর্ণ বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামো রয়েছে। লিবারেল আর কনজারভেটিভদের পাশাপাশি রাজনৈতিক কাঠামোতে প্রভাবশালী দল হিসেবে আছে নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি, গ্রিন পার্টি। মোটামুটিভাবে, দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা রয়েছে, পার্লামেন্টে রয়েছে মুক্ত বিতর্কের সুযোগ।
দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক কাঠামো সুষ্ঠুভাবে কাজ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে সুশীল সমাজের, সম্পর্ক তৈরি করে জনগণ আর সরকারের মধ্যে। কানাডায় সুশীল সমাজের অংশ হিসেবে আছে ইউরোপীয়রা, আছে এশিয়ান, ক্যারিবিয়ানদের সাথে আদিবাসীরাও। এই বৈচিত্র্যের মধ্যেও সরকারের জবাবদিহিতা আর দক্ষতা নিশ্চিতে কাজ করছে এই সুশীল সমাজ, ফেডারেল নির্বাচনগুলোতে গড়ে ৭০.৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি যার প্রমাণ।
তৃতীয়ত, বিশ্বের যেসব দেশে গণমাধ্যম পুরোপুরি মুক্ত এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কাজ করতে পারে, কানাডা তাদের একটি। আরএসএফ-এর প্রতিবেদনে কানাডার অবস্থান ১৮তম, ডেমোক্রেসি ইনডেক্সে অবস্থান ৭ম। বর্তমান সময়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কানাডিয়ানদের রয়েছে সক্রিয় উপস্থিতি ।
চতুর্থত, কানাডার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব শক্তিশালী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ছাড়া নির্বাচিত সরকার একদিনও বেশি ক্ষমতায় থাকেনি, শোনা যায়নি নির্বাচনে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপের কথা। পলিসি মেকিংয়ে পার্লামেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, পার্লামেন্টরি কমিটিগুলোও রাখছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা, মুক্ত মতপ্রকাশের সুযোগ আছে ক্যাবিনেটেও।
পঞ্চমত, কানাডিয়ানরা কখনোই কোনো নেতাকে অবতারের স্থানে নিয়ে যায়নি, কারো চিন্তা-কাজকে অভ্রান্ত মনে করে সবকিছুতে সমর্থন যোগায়নি, শক্তিশালী হয়েছে গণতন্ত্র।
ষষ্ঠত, কানাডার রাজনীতিতে ক্রিয়াশীল প্রত্যেকটা দলই গণতন্ত্রের চর্চা করে দলের অভ্যন্তরেও, পার্টি লিডাররা নির্বাচিত হন দলের সদস্যদের সরাসরি ভোটে। রাজনীতিতে যথেষ্ট সুযোগ আছে যুবকদের জন্যও, প্রধান তিনটি দলের সবগুলোরই দলীয় প্রধানের বয়স পঞ্চাশের নিচে।
সপ্তমত, একটি গণতান্ত্রিক কাঠামো জনগণের কতটা উপকারে আসতে পারবে, তা নির্ভর করে দুর্নীতি কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে, তার ওপর। কানাডা বিশ্বের সবচে কম দুর্নীতি হওয়া ১২টি দেশের একটি, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা দেখাচ্ছে কানাডা।
জাস্টিন ট্রুডো
কানাডার ২৩তম প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭১ সালে, বাবা পিয়েরে ট্রুডো তখন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠা ট্রুডো সাহিত্যে ব্যাচেলর ডিগ্রি করেছেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, শিক্ষানীতির উপর পড়াশোনা করেছেন ব্রিটিশ কলম্বিয়ায়।
রাজনীতি সরাসরি প্রবেশ ঘটে একবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই, পার্লামেন্টের সদস্য হন ২০০৮ সালে। প্রথমবার পার্লামেন্ট মেম্বার হয়েই মনোযোগ কাড়েন সকলের। সেইসাথে ভূমিকা পালন করেন নাগরিকত্ব, অভিবাসন, শিক্ষানীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোর দক্ষ সমালোচক হিসেবে। জয় পান ২০১১ সালের ফেডারেল নির্বাচনেও, ৩৮.৪১ শতাংশ ভোট পেয়ে, পার্লামেন্টে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য পান রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ডায়মন্ড জুবিলি পদক।
ট্রুডোর জীবনে মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা ২০১৩ সালের লিবারেল পার্টি প্রধান নির্বাচন। প্রথমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত নিলেও সমর্থকদের দাবিতে অংশগ্রহণ করেন নির্বাচনে, ৭৯.৭৬ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন লিবারেল পার্টি প্রধান। ধারাবাহিকতায় জয় পান ২০১৫ এর ফেডারেল নির্বাচনেও, ২০১১ এর নির্বাচনে ৩৪টি আসন পাওয়া লিবারেলরা পায় ১৮৪টি আসন। নভেম্বরে ট্রুডো দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ট্রুডো
প্রধানমন্ত্রী হয়েই ট্রুডো কল্যাণমূলক অর্থনীতির দিকে ঝোঁকেন, কর কমিয়ে দেন মধ্যবিত্তদের। জেরেমি করবিন যা যুক্তরাজ্যে করতে চেয়েছিলেন, ট্রুডো সেটি বাস্তবায়ন করেছেন কানাডায়, কর বাড়িয়েছেন অতিধনী ১ শতাংশের ওপর।
প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর কাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে ছিলো অবকাঠামোগত উন্নয়ন। নির্বাচনকালীন ক্যাম্পেইনে ৪২ বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা দিলেও প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেটিকে বাড়িয়ে করেছেন ১৪৩ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পে। উন্নয়ন ঘটেছে গণপরিবহন, রাস্তা আর সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর।
স্বৈরশাসনে থাকা দেশের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক দেশগুলোও যেখানে ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে, ট্রুডো বরাবর অবস্থান নিয়েছেন ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে। গর্ভপাতের বিষয়টি পুরো ছেড়ে দিয়েছেন ব্যক্তির ইচ্ছার উপর, সমর্থন দেননি কিউবেক চার্টার অভ ভ্যালুসেও। বরাবর অবস্থান নিয়েছেন ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে, ধর্মীয় পোশাক পরিধান বা প্রতীক ধারণকেও বারবার তুলে ধরেছেন ইতিবাচক হিসেবে ।
যৌন নিপীড়ন বিরোধী ‘মি টু’ আন্দোলন শুরু হলে তিনি সমর্থন প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারীদের প্রতি, নিজেকে দাবি করেছেন নারীবাদী হিসেবে। নারীদের হেনস্তা বা যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে গেছেন জিরো টলারেন্স নীতিতে। এছাড়াও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন কানাডার পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের কাঠামোগত সংস্কার করে, দলীয় অবস্থান থেকে সিনেটকে নিয়ে গেছেন নির্দলীয় অবস্থানে।
পররাষ্ট্রনীতি
কানাডা সবসময়ই মানবাধিকার আর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে উচ্চকণ্ঠ ছিল, সেটি বজায় আছে ট্রুডোর আমলেও। তিনি বিরোধিতা করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাতটি দেশের শরণার্থীদের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার, যার মধ্যে ছ’টিই ছিলো মুসলিমপ্রধান। বিরোধিতা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে বিমান হামলার, অস্ত্রচুক্তি বাতিল করেছেন সৌদি আরবের সাথে। আশ্রয় দিয়েছেন ২৫ হাজার সিরিয়ান শরণার্থীকে, সম্প্রসারণ করেছেন নতুন অভিবাসী সংখ্যাও। কানাডাকে তিনি তুলে ধরেছেন মুক্ত আর স্থিতিশীল দেশ হিসেবে, যেখানে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুস্থ পরিবেশ খুঁজে পাবে অভিবাসীরা।
ট্রুডো উচ্চকণ্ঠ ছিলেন মিয়ানমারের দমন-পীড়নের মুখে বাস্তুচ্যুত হওয়া এগারো লাখ রোহিঙ্গার পক্ষেও, বরাদ্দ দিয়েছেন ত্রাণ কার্যক্রমে, আওয়াজ তুলেছেন শান্তিপূর্ণভাবে মিয়ানমারে পুনর্বাসনের ব্যাপারেও।
কেন সফল ট্রুডো?
প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বেশ কয়েকটি বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেও নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে জাস্টিন ট্রুডো যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিলেন, বাস্তবায়ন করেছেন তার ৯২ শতাংশ। সরকার পরিচালনায় মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ইতিবাচক অবস্থান তাকে এনে দিয়েছে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা।
একজন নেতা প্রকৃত অর্থে দেশকে মহান করতে পারেন না, দেশকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরার কারিগর নাগরিকেরা, সুশীল সমাজের রাজনৈতিক পরিপক্বতা। ট্রুডোও ক্ষমতায় এসে কানাডাকে খোলনলচে বদলে দেননি, বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুসরণ করেছেন পূর্বসূরীদের পদাঙ্ক। বিশ্বব্যাপী ট্রুডোর জনপ্রিয়তার মূল কারণ কানাডার মুক্ত গণতন্ত্র, দীর্ঘদিন ধরেই যা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে কানাডায় অভিবাসী হতে, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ আবাস গড়তে।