জুন, ২০১১।
আমেরিকার ইউটাহ প্রদেশের ফার্মিংটন শহরের মাঠে জড়ো হয়েছে বহু লোক। অনুষ্ঠিত হচ্ছে রোডিও (ঘোড়ার খেলার প্রদর্শনীমূলক প্রতিযোগিতা)। এখন হবে ব্যারেল রেস।
ব্যারেল রেস আর কিছুই নয়, নির্দিষ্ট নিয়মানুযায়ী বেশ কয়েকটি ব্যারেল বা পিপা মাঠে সাজিয়ে দেয়া হয়। ঘোড়সওয়ারের কাজ হলো প্রত্যেকটি ব্যারেল প্রদক্ষিণ করে পুরো দূরত্ব পাড়ি দিয়ে আসা। যে সবচেয়ে তাড়াতাড়ি এই কাজ সম্পন্ন করতে পারবে সেই হবে বিজয়ী। কেউ যদি মনে করে থাকেন, “আরেহ, এ আর এমনকি কঠিন কাজ। ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে দিলে তো আমিই করে ফেলতে পারব!” তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, শুনতে যতটা সহজ কাজটা তার থেকেও কঠিন। একাগ্র মনোসংযোগ, ক্ষিপ্রতা আর নিজের বাহনের উপর গভীর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন এই খেলায় সফল হতে গেলে। যারা ব্যারেল রেসার হিসেবে পারদর্শী তাদের খেলা দেখলে মানুষ আর ঘোড়াকে একই অস্তিত্ব মনে হয়।
আজকের খেলায় প্রায় সত্তরজন মেয়ে অংশ নিচ্ছে। তাদের মধ্যে এক কিশোরী মাঠে প্রবেশ করতেই জনতার মধ্যে থেকে তার পরিবার আর বন্ধুরা তুমুল হর্ষধ্বনি করে উঠল। কিশোরী আসীন এক বিরাট ঘোড়ার পিঠে, যার নাম পাওয়ার।অন্য প্রতিযোগীদের থেকে তাকে কিছুটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। একটু ভালো করে দেখলেই কারণটা বোঝা যাবে। তার স্যাডল, বা ঘোড়ার জিনে সিটবেল্ট লাগানো, আর রেকাবের সাথে কয়েকটি স্ট্র্যাপ দিয়ে তার পা বেঁধে রাখা হয়েছে।
সংকেত দিতেই আরোহীকে পিঠে নিয়ে পাওয়ার বিদ্যুৎবেগে ছুটতে শুরু করল। তার ঘোড়া সামলানোর কৌশলও অন্যদের থেকে আলাদা মনে হচ্ছে। অন্য ঘোড়সওয়ারেরা যেখানে পায়ের সাহায্যে ঘোড়াকে বিভিন্ন নির্দেশ দেয় এই কিশোরী তার কিছুই করছে না। সে তার হাত দিয়েই পাওয়ারকে পরিচালনা করছে। ওদিকে দর্শক সারিতে তার বাবা-মায়ের বুক দুরু-দুরু করে কাঁপছে, কী জানি হয়! তবে শেষ পর্যন্ত সব ভালোয় ভালোয় শেষ হলো। ১৮ সেকেন্ডে নিজের খেলা শেষ করে কিশোরী বিরক্তমুখে ফিরে এলো। তার সেরা সময়ের থেকে মাত্র ১ সেকেন্ড বেশি নিয়েছে সে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তার এই টাইমিং অনন্য হলেও কিশোরীর চাওয়া আরো দ্রুত হবার। ঘোড়া থামালে তার পরিবার দ্রুত তার দিকে এগিয়ে গেল, তাদের সাথে একটি হুইলচেয়ার।
জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এক দুর্ঘটনা
এল্ক রিজ শহর, ইউটাহ। জানুয়ারি ১০, ২০১০ সাল।
স্বর্ণকেশী অ্যাম্বার্লি স্নাইডার ভোর ৪.৩০ মিনিটে তার নীল রঙের ফোর্ড F-150 পিকআপ ট্রাকে উঠে বসল। তার গন্তব্য ডেনভার। সেখানে হচ্ছে পশুপাখির বিশাল মেলা। অ্যাম্বার্লি আড়াই সপ্তাহের জন্য মেলাতে কাজ করবে।
আঠার বছর বয়স্ক আঠার অ্যাম্বার্লি ঘোড়ার নানা খেলাতে বিশেষ পারদর্শী। প্রদর্শনীমূলক রোডিওতে সে বেশ নাম করেছে। এর মধ্যেই প্রায় তেরটি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী অ্যাম্বার্লির স্বপ্ন পেশাদার হওয়া। পেশাদার লাইসেন্সের জন্য টাকার দরকার। অ্যাম্বার্লি তাই এখন থেকেই সঞ্চয় করছে। শুধু তা-ই নয়, অ্যাম্বার্লি ইউটাহর এফএফএ (Future Farmers of America) এর বর্তমান প্রেসিডেন্টও। আসছে মার্চে সংগঠনের সম্মেলনে তার বক্তব্য পাঠ করার কথা রয়েছে। সেই বক্তব্য নিয়েও তাকে অনেক কাজ করতে হবে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অ্যাম্বার্লির গাড়ি রাস্তায় উঠল। তাকে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৪৮০ মাইল লম্বা পথ। সকাল দশটার দিকে ওয়াইয়োমিংয়ের রলিন্সে এসে তার গাড়ি তেল নেয়। এরপর আবার গাড়ি স্টার্ট করে অ্যাম্বার্লি ইন্টারস্টেট-৮০ হাইওয়ে ধরে পূর্বদিকে রওনা হলো, তবে পেটে কিছুটা ব্যথা অনুভব হওয়ায় কিছু সময়ের জন্য সিটবেল্ট খুলে রাখল সে। তার মা তাকে এসময় ফোনে বার্তা পাঠালেও অ্যাম্বার্লি খেয়াল করেনি।
রলিন্স থেকে আরো দশ মাইল ভ্রমণ করে অ্যাম্বার্লি ক্ষণিকের জন্য রাস্তা থেকে চোখ নামিয়ে ম্যাপ দেখলো। গাড়ি তখন চলছে সত্তর মাইল বেগে। চোখ তুলতেই আঁতকে উঠল সে। এ কী! মুহূর্তের অমনোযোগিতায় তার গাড়ি ভুল লেনে ঢুকে পড়েছে। বিপদজনকভাবে তা এখন এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার পাশে পুঁতে রাখা দূরত্ব নির্দেশক খুঁটির দিকে। দ্রুত অ্যাম্বার্লি স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে তার ট্রাক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করল। কিন্তু তখন শীতকাল। রাস্তার অনেক জায়গাতেই বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কাজেই তার গাড়ি প্রয়োজনের থেকে অতিরিক্ত সরে গেল। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অ্যাম্বার্লির ট্রাক নেমে পড়ল রাস্তার পাশের মাটিতে, গোত্তা খেতে শুরু করল ভয়ঙ্করভাবে। প্রায় সাতবার গোত্তা খাবার পর দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া গাড়ি স্থির হলো।
এদিকে সিটবেল্ট না থাকার কারণে এর মাঝেই অ্যাম্বার্লি চালকের পাশের জানালা দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে গেছে। জানালার সাথে লেগে ছিল তার লম্বা সোনালি চুলের এক গোছা। উড়ে গিয়ে অ্যাম্বার্লির পিঠ সজোরে আঘাত করে কাঁটাতারের বেড়ার এক খুঁটিকে। খুটি আর কাঁটাতার উপড়ে নিয়ে আরো বিশ ফুট দূরে গিয়ে থামল তার দেহ। এর মধ্যে তার নিজের হাঁটুর আঘাতে কপালে তৈরি হয়েছে বিশ্রী এক ক্ষত।
পুরো সময় অ্যাম্বার্লি ছিল সম্পূর্ণ সজাগ। ধাতস্থ হয়ে সে প্রথমে নিজের অবস্থান বিচার করে বুঝল কোনো সাহায্য ছাড়া তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। সে প্রথমে তার হাতের আঙ্গুল নাড়াল। নাহ, ঠিক আছে। কিন্তু পায়ের আঙ্গুল নাড়াতে গিয়ে অ্যাম্বার্লি আবিষ্কার করল সে পায়ে কোনো সাড়া পাচ্ছে না। একজন ঘোড়সওয়ারের কাছে পায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। অ্যাম্বার্লি শঙ্কিত হয়ে পড়ল।
দশ মিনিটের মধ্যে আরেকটি গাড়ি ঘটনাস্থলে এসে থামল। এর চালক দ্রুত জরুরি নাম্বারে ফোন করলে পুলিশ এসে হাজির হলো। এদিকে আরো লোকজন অ্যাম্বার্লির কাছে এসে পৌঁছে। একজন তার ফোন উদ্ধার করে আনল। অ্যাম্বার্লি তার বাবা, করি স্নাইডারকে ফোন দিল, যিনি তখন কাজের তাগিদে হাওয়াইতে অবস্থান করছিলেন। তাকে সব জানিয়ে অ্যাম্বার্লি তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে মেসেজ পাঠাল। নিজের অবস্থা জানানোর পাশাপাশি তার বার্তার মধ্যে আরো একটি আবেদন ছিল-
“আমার পা যাতে ভাল হয় সেজন্য সবাই প্রার্থনা কর”।
প্যারামেডিকরা অ্যাম্বার্লিকে স্ট্রেচারে তোলার আগপর্যন্ত সে কোনো ব্যথা অনুভব করেনি। তারা দ্রুত তাকে রলিন্সের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়। এদিকে অ্যাম্বার্লির বাবা স্ত্রী টিনাকে ফোন দিলেন। মেয়ের দুর্ঘটনার খবরে টিনা ভেঙে পড়লেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে রলিন্সের পথে রওনা হন। হাসপাতাল থেকে দুই ঘণ্টার মতো দূরে থাকতেই তিনি অ্যাম্বার্লির ভাঙা গাড়ি পড়ে থাকতে দেখেন, মেয়ের সোনালি চুলের অংশ তখনও ট্রাকের জানালা থেকে ঝুলছিল।
অ্যাম্বার্লি স্নাইডার
অ্যাম্বার্লির জন্ম ২৯ জানুয়ারি, ১৯৯১ সালে, ক্যালিফোর্নিয়াতে। তার বাবা ছিলেন পেশাদার বেসবল খেলোয়াড়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে অ্যাম্বার্লি দ্বিতীয়। বাকিরা হলো অ্যাশলি, জেসি,টেইলর, অব্রে আর সর্বকনিষ্ঠ অটাম। তিন বছর বয়সেই অ্যাম্বার্লি ঘোড়ায় ওঠা শুরু করে দেয়। তার বয়স যখন সাত, তখন তার বাবা অবসর নিয়ে ইউটাহতে চলে যাবার পরিকল্পনা করলেন। এক শর্তে অ্যাম্বার্লি রাজি হলো, তাকে নিজের একটা ঘোড়া কিনে দিতে হবে। বাবা সেই শর্ত মেনে নিলেন।
লেসি নামের সেই ঘোড়া হয়ে উঠল অ্যাম্বার্লির নিত্যসঙ্গী। প্রতিটি সপ্তাহান্ত আর ছুটির দিন অ্যাম্বার্লি মেতে থাকল লেসিকে নিয়ে। তার বাবা-মা সবসময়ই তাকে বলত কঠোর পরিশ্রম ছাড়া প্রতিভার কোনো মূল্য নেই। কাজেই অ্যাম্বার্লি তার অবসর সময়ের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করত ঘোড়ার পিঠে। ঘোড়ার বিভিন্ন খেলাতে তার দক্ষতা দেখে তার মা-বাবা তাকে নানা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দেন। অ্যাম্বার্লি অনেকগুলোতে প্রথম পুরস্কার ছিনিয়ে আনে। বিভিন্ন খেলার মধ্যে ব্যারেল রেস ছিল তার কাছে বিশেষভাবে প্রিয়।
চিকিৎসা
রলিন্সের চিকিৎসকেরা অ্যাম্বার্লিকে জানান, তার শিরদাঁড়া ভেঙে যাবার ফলে শরীরের নিচের অংশ চিরতরে পুরোপুরিভাবে অবশ হয়ে গেছে। এখান থেকে আকাশপথে অ্যাম্বার্লিকে নিয়ে যাওয়া হলো ক্যাস্পার, ওয়াইয়োমিং মেডিক্যাল সেন্টারে। পাঁচ ঘণ্টা দীর্ঘ চেষ্টার পর সার্জনেরা তার শিরদাঁড়া জোড়া দিলেন। এরপর তাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হলো। প্রায় দশ দিন ওষুধের প্রভাবে অ্যাম্বার্লি আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। একটু সেরে উঠলে তার মা-বাবা তাকে সরিয়ে নেন তাদের বাড়ির কাছাকাছি আরেকটি হাসপাতালে। এখানে শুরু হলো অ্যাম্বার্লির পাঁচ সপ্তাহব্যাপী কঠিন পুনর্বাসন।
চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, শরীরের নিচের অংশে অ্যাম্বার্লি আর কখনোই সাড়া ফিরে পাবে না। তারা একবাক্যে তার পুনরায় ঘোড়ায় চড়ার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। কিন্তু তারা অ্যাম্বার্লিকে চিনতেন না। টিনা জানতেন তার মেয়ে কোন ধাতুতে গড়া, ঘোড়ায় চড়তে না পারা তার কাছে মৃত্যুর থেকেও খারাপ। তাই হাসপাতালে অ্যাম্বার্লি যখন তার মাকে বলল যে করেই হোক তাকে আবার ঘোড়ায় উঠতে হবে, টিনা প্রতিজ্ঞা করলেন প্রয়োজনে বেঁধে হলেও তিনি অ্যাম্বার্লিকে ঘোড়ার পিঠে তুলবেন।
পুনর্বাসন
বাড়ির কাছে শুরু হলো অ্যাম্বার্লির পুনর্বাসন প্রক্রিয়া। তাকে শিখতে হবে কীভাবে হাত আর শরীরের অন্যান্য অংশ ব্যবহার করে পায়ের অভাব যতটা সম্ভব পুষিয়ে নিতে হয়। পা ব্যবহার করে ভারসাম্য রাখা যেহেতু সম্ভব হবে না, তাই তার নতুন করে ভারসাম্য ঠিক রাখা শিখতে হবে, অনেকটা ছোটবেলায় প্রথম হাঁটতে শেখার মতোই।
পুনর্বাসন প্রক্রিয়া আরম্ভ করার আগেই রীতি অনুযায়ী নার্স অ্যাম্বার্লিকে জিজ্ঞেস করল তার নিজের জন্য পুনর্বাসনের কী লক্ষ্য সে ঠিক করেছে । ঘোড়ায় চড়ার ব্যাপারে অ্যাম্বার্লি ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কাজেই উত্তর দিতে তার দেরি হলো না,
সহজ, ওয়াক, রাইড, রোডিও।
পুনর্বাসনের দিনগুলো অ্যাম্বার্লির ভাবনার থেকেও বেশি কঠিন ছিল। তবে তার চিকিৎসকেরা দ্রুতই অনুধাবন করলেন অ্যাম্বার্লিকে প্রথাগতভাবে প্রশিক্ষিত করার থেকে উত্তম হলো তাকে কোনো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া। সেভাবেই তারা এই অভিনব কিশোরীর জন্য প্রতিদিনই নতুন নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে থাকেন। অ্যাম্বার্লির সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছিল ভারসাম্য বজায় রাখতে। তার মনে পড়ল, হাঁটতে পারার আগেই সে ঘোড়ার পিঠে উঠেছিল, সেখানেই তার ভারসাম্য সবথেকে ভাল থাকে। সে চিকিৎসকদের পরামর্শ দিল তার জন্য স্যাডলের ব্যবস্থা করতে। তারা প্রথমে তার কথা আমলে নিতে না চাইলে অ্যাম্বার্লি তার বাবাকে বলল বাড়ি থেকে তার নিজের স্যাডল নিয়ে আসতে। শেষ পর্যন্ত তার জোরাজুরিতে চিকিৎসকেরা রাজি হলো। বিস্ময়করভাবে স্যাডলে বসিয়ে দেবার পর ভারসাম্যের সমস্যা অ্যাম্বার্লি খুব দ্রুত কাটিয়ে উঠল। পুনর্বাসন শেষ, এবার বাড়ি ফেরার পালা।
নতুন করে স্বপ্ন দেখা
মে মাসে অ্যাম্বার্লি বাড়ি ফিরে এলো। তার প্রথম কাজ ছিল আবার ঘোড়ায় ওঠা। সবার সহযোগিতায় স্যাডলে বসতে পারলেও পুরোনো সেই অনুভূতি আর অ্যাম্বার্লি ফিরে পেল না। তার পা অসাড় হয়ে দুই পাশে ঝুলে ছিল, নিজের ভেতর থেকে উদ্যম হারিয়ে ফেলছিল অ্যাম্বার্লি। সেরে উঠার সময় সে কতবার ভেবেছে পাওয়ারের পিঠে বসলেই সে আবার পুরোনো অ্যাম্বার্লিকে ফিরে পাবে। আজ মনে হচ্ছে তা হয়তো আর কোনোদিনই সম্ভব না।
প্রায় বিশ মিনিট এলোমেলোভাবে ঘুরে অ্যাম্বার্লি নেমে পড়ল। তার ঘোড়া চালানো সহজ করতে স্যাডলে সিটবেল্ট লাগানো হলো, তার এক বন্ধু শুনে এসেছিল অ্যারিজোনাতে এক অশ্বারোহী নিজের দুর্বল পা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরকম সিটবেল্ট ব্যবহার করেন। এছাড়াও রেকাবে স্ট্র্যাপ যুক্ত করা হলো যাতে অ্যাম্বার্লি শক্ত করে পা বেঁধে নিতে পারে। তার ঘোড়ারা পায়ের ইশারা পেতে অভ্যস্ত, কাজেই অনিয়ন্ত্রিতভাবে তার পা নড়াচড়া করলে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।
এতকিছু সত্ত্বেও অ্যাম্বার্লির আগ্রহ কেন জানি মরে গিয়েছিল। নিজের কুকুর এলি মে-কে নিয়েই তার বেশিরভাগ সময় কাটতে থাকে। প্রাণের প্রিয় ঘোড়াগুলোর কাছে কেন যেন আর যেতে ইচ্ছে করত না। আগস্ট মাসে মা আর ছোট বোন অটামের সাথে ঘুরে বেড়ানোর সময় টিনার ঘোড়া বেয়াড়া আচরণ শুরু করে। অন্য সময় হলে অ্যাম্বার্লিই এটা সামলাত। কিন্তু সে উপলব্ধি করল এই অবস্থায় তার পক্ষে এ কাজ অসম্ভব। কলেজে চলে যাবার আগে অ্যাম্বার্লি তার মাকে বলল ঘোড়াগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারবে এমন কারো কাছে বিক্রি করে দিতে। টিনা মেয়েকে বললেন, ঘোড়ারা যখন অসুস্থ ছিল অ্যাম্বার্লি তাদের সেরে ওঠার জন্য অপেক্ষা করেছে, এখন তারাও তার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে।
প্রায় ন’মাস অ্যাম্বার্লি তার প্রিয় ঘোড়া থেকে দূরে ছিল। ২০১১ সালের এপ্রিলে বাড়ি ফিরে আসলে এক সাংবাদিক তার সাথে যোগাযোগ করেন। তার সাক্ষাৎকার নেবার পর সাংবাদিকের অনুরোধে ছবি তোলার জন্য অ্যাম্বার্লি অনেকদিন পর আবার পাওয়ারের পিঠে উঠে বসল। পাওয়ার যখন তাকে নিয়ে ছুটতে শুরু করল অ্যাম্বার্লি বুকে কাঁপন অনুভব করে। বহুদিন পর নিজের ভেতর পুরোনো উদ্দীপনা সে আবার খুঁজে পায়।
অ্যাম্বার্লি কঠিন অনুশীলনে নেমে পড়ে। মাস দুয়েকের মাথায় ফার্মিংটনে প্রদর্শনীতে অংশ নেয় সে, এরপর নিয়মিতভাবে অনেক প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। নিজেকে ধীরে ধীরে ফিরে পেতে থাকে সে। অনেক জায়গাতে বিজয়ীও হয়।
ইউটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অ্যাম্বার্লি রোডিও টিমের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হয়। ব্যারেল রেসিংয়ে রকি পর্বতের এলাকায় প্রথম দশজনের মধ্যে থেকে ২০১৫ সালে সে ক্যাস্পারে জাতীয় কলেজ রোডিওর ফাইনালে ওঠার আশা করছিল, কিন্তু তার ঘোড়া অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। সেবছরই অ্যাম্বার্লি কৃষিবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন করে বের হয়। পরে সে মাস্টার্স করে স্কুল কাউন্সেলিংয়ে।
অ্যাম্বার্লি এখন তার স্যাডলে কুশন ব্যবহার করলেও প্রথমদিকে তা ছিল না। ফলে বার বার ঘোড়ায় ওঠা-নামা করতে করতে ২০১১ এর সেপ্টেম্বর থেকে তার শরীরে ক্ষত তৈরি হয়। প্রথমদিকে চিকিৎসকেরা একে মারাত্মক না মনে করলেও ডিসেম্বরে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে তার বাবা-মা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করেন। ডাক্তারেরা দেখতে পেলেন তার ক্ষতস্থানে ভয়াবহ রকম ইনফেকশান হয়ে গেছে। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে অ্যাম্বার্লি সেই যাত্রায় রক্ষা পেল। সুস্থ হয়ে ওঠামাত্র সে আবার স্যাডলে ফিরে যায়।
দ্য আমেরিকান রোডিও
রোডিওর অন্যতম নামকরা আর সবচেয়ে অর্থকরী পেশাদার প্রতিযোগিতা হলো আমেরিকান রোডিও। প্রতিবছর টেক্সাসের আরলিংটনে অনুষ্ঠিত এই আসরে ঘোড়ার বিভিন্ন খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন নামজাদা সব পেশাদার প্রতিযোগী। এই প্রতিযোগিতায় মানুষের ভোটে একজনকে অংশগ্রহণের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
আন্দ্রিয়া বাসবি নামে এক মহিলা অ্যাম্বার্লির কথা পড়ে মুগ্ধ হন। তিনি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে এরকম কাউকেই আমেরিকান রোডিওতে ভোটে পাঠানো উচিত বলে লিখে দেন। প্রচুর মানুষ এরপর অ্যাম্বার্লিকে ভোট দিতে আরম্ভ করে। ৩৭,০০০ ভোটের মধ্যে অ্যাম্বার্লি পায় সর্বোচ্চ ৮,০০০। এরপর আমেরিকান রোডিও কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বার্লিকে মনোনীত করে।
২০১৫ সালের মার্চে আমেরিকান রোডিওর মতো সম্মানজনক প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার সুযোগ পেয়ে অ্যাম্বার্লি খুবই উত্তেজিত ছিল। যে চারদিন টেক্সাসে ছিল, এর মাঝে সে মাত্র বার ঘণ্টা ঘুমিয়েছে। পাওয়ারকে নিয়ে ব্যারেল রেসে তার টাইমিং ছিল ১৫.৩ সেকেন্ড, যা প্রথম স্থান অধিকারির থেকে মাত্র ০.৬ সেকেন্ড কম। মাঠের ৪০,০০০ দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানায়। পরের বছরই অ্যাম্বার্লি পেশাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নেবার লাইসেন্স পেয়ে যায়। তার পেশাদার হবার স্বপ্ন পূরণ হলো।
মানুষের প্রেরণা অ্যাম্বার্লি
অধ্যবসায় আর নিরলস পরিশ্রমে নিজের স্বপ্ন সত্যি করেছে অ্যাম্বার্লি। যে দুর্ঘটনা জীবনকে থামিয়ে দিতে পারত, সেই দুর্ঘটনাই আজ তার শক্তির জায়গা। ২০১০ সালের পর থেকে অ্যাম্বার্লির পথচলা সহজ ছিল না, এখনও সহজ নয়। যে কাজ প্রতিদিন আমরা অবলীলায় করতে পারি, তার জন্য অ্যাম্বার্লিকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু সে কখনোই হাল ছাড়েনি। তাই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রায়ই ডাক আসত সবার সামনে কিছু বলার জন্য। শুধু অ্যাম্বার্লির কথা শোনার জন্যই এরপর থেকে বিভিন্ন জায়গাতে আয়োজন করা হতে থাকে। অ্যাম্বার্লিও ছুটে যেতে থাকে আমেরিকার আনাচে কানাচে। এরই মধ্যে এই কাজে ৩৬টি প্রদেশ তার সফর করা হয়ে গেছে, ইচ্ছা আছে সবগুলো প্রদেশে যাবার। দ্য টুডে শো, এনবিসি নাইট নিউজ সহ অনেক টেলিভিশন প্রোগ্রামেও অ্যাম্বার্লি আমন্ত্রিত হয়েছে। ভাই-বোনদের নিয়ে এফএফএ-র সম্মেলনে কোস্টারিকাতে ১৩,০০০ শিশুর সামনেও সে বক্তব্য রেখেছে।
নিজের প্রতিদিনের জীবনযাত্রায় কী কী সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় তা অ্যাম্বার্লি নিয়মিত “হুইলচেয়ার ওয়েনেসডে” নামে ফেসবুকে পোস্ট করে। ইউটিউবেও এই ভিডিও দেখা যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতে তার দুই লাখের বেশি অনুসারি। নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে অ্যাম্বার্লির লেখা বই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে “ওয়াক, রাইড, রোডিও” নামে। আর এফ ডি টেলিভিশন, যারা আমেরিকান রোডিওর স্পন্সর, তারা জাতীয় এফএফএ-কে এক লাখ ডলার দিয়েছে যা দিয়ে চালু হয়েছে অ্যাম্বার্লি স্নাইডার স্কলারশিপ।
বর্তমানে অ্যাম্বার্লি
আমেরিকান রোডিওতে অ্যাম্বার্লির অংশগ্রহণের পর ব্যারেল রেসের তৎকালীন চ্যাম্পিয়ন ফ্যালন টেইলরের সরাসরি সহায়তায় অ্যাকশন ট্র্যাকস্ট্যান্ডার বিশেষ ধরনের হুইলচেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। এর মাধ্যমে বিশেষ ব্যবস্থায় অ্যাম্বার্লি দাঁড়াতে পারে। ইউটাহ স্টেট ইউনিভার্সিটির ছাত্ররাও তার জন্য এমন এক হুইলচেয়ার বানিয়েছে যা লিফটের মতো উঠতে পারবে, যাতে অ্যাম্বার্লি কোনো সমস্যা ছাড়াই ঘোড়া সাজাতে এবং ঘোড়ার পিঠে উঠতে-নামতে পারে।
অ্যাম্বার্লি এখন ব্যারেল রেসিং ছাড়া অন্যান্য খেলাও আবার শুরু করেছে। এখন সে খেলায় নতুন একটি ঘোড়া ব্যবহার করে, যার নাম লেগাসি। সংক্ষেপে অ্যাম্বার্লি তাকে লেগ বলে ডাকে। এছাড়াও সে নতুন একটি ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। তার পায়ের অবস্থারও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। পায়ের পেছনের অংশে অ্যাম্বার্লি এখন অল্প করে সাড়া ফিরে পাচ্ছে। সে আশাবাদী- একসময় হয়তো আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।
ওয়াক, রাইড, রোডিও
২০১৮ সালে নেটফ্লিক্স অ্যাম্বার্লির সাথে যোগাযোগ করে। তারা অ্যাম্বার্লির কাহিনী নিয়ে ছবি করতে চায়। প্রথমে অ্যাম্বার্লি না করে দেয়। কিন্তু পরে মা-বাবার পরামর্শে সে রাজি হয়। শর্ত ছিল ছবিতে ঘোড়া নিয়ে সমস্ত স্টান্ট অ্যাম্বার্লি নিজেই করবে। এর কারণ পায়ের সাহায্য ছাড়া ঘোড়া চালাতে হয় বলে অ্যাম্বার্লির কায়দা একেবারেই আলাদা, যা অন্য কারো পক্ষে অনুকরণ করা সম্ভব নয়। নেটফ্লিক্স রাজি হয়। দুর্ঘটনার আগে অ্যাম্বার্লির স্টান্ট করার দায়িত্ব নেয় তারই ছোট বোন অটাম। নিউ মেক্সিকোতে চার সপ্তাহের শুটিং শেষে ২০১৯ এর মার্চে নেটফ্লিক্স প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পায় ‘ওয়াক, রাইড, রোডিও’। ছবির শেষের দিকের কথা ছিল অ্যাম্বার্লির অন্যতম প্রিয় উক্তি, এবং তার জীবনের মূলমন্ত্র
“Attitude is a little thing that makes a big difference.”