বিশ্বকাপের পরই সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবল টুর্নামেন্টের কথা বললেই চলে আসে ইউরোর কথা। ২৪ দলের এই কুলীন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নেয় ১৬ দল। অর্থাৎ, ছয় গ্রুপের মধ্যে চারটি গ্রুপের তৃতীয় স্থানে থাকা দলের সামনে সুযোগ থাকে নকআউট রাউন্ডে উঠার। গতবারের চ্যাম্পিয়ন পর্তুগাল তো তৃতীয় হয়ে উঠেই বাজিমাত করেছিল।
এবারের ছয় গ্রুপের মধ্যে নি:সন্দেহে গ্রুপ-এফ’কেই বলা যায় ‘গ্রুপ অফ ডেথ ‘। তবে বাকি পাঁচ গ্রুপের মধ্যে সবচেয়ে ব্যালান্সড গ্রুপ বললে আসবে গ্রুপ-ই’র কথা। স্পেন, পোল্যান্ড, সুইডেন ও স্লোভাকিয়াকে নিয়ে এই গ্রুপে চমক দেখাতে পারে যেকোনো দলই। ফিফা র্যাংকিং দেখেই বোঝা যায়, দলগুলোর শক্তিমত্তা খুব কাছাকাছি। স্পেনের র্যাংকিং ৬ হলেও পোল্যান্ড (২১), সুইডেন (১৮) ও স্লোভাকিয়া (৩৬) কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না, সেটা বলাই বাহুল্য। চলুন দেখে আসা যাক এই চার দলের অবস্থা ও সম্ভাব্য নিয়তি।
স্পেন
জাভি, ইনিয়েস্তা, ক্যাসিয়াসদের সোনালী অতীত স্পেন পিছনে ফেলে এসেছে বেশ কয়েক বছর আগেই। এমনকি ইনজুরির কারণে ইউরোতে জায়গা হয়নি দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও দলনেতা সার্জিও রামোসেরও। তবে লুইস এনরিকে দায়িত্ব নিয়ে দলকে পরিবর্তন করতে চেয়েছেন আমূলে। তারুণ্যনির্ভর এক স্পেনকে দিয়ে ইউরো পুনরোদ্ধারের স্বপ্ন স্পেন দেখলেও তা মাঠে কতটুকু কার্যকর হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নামের ভারে গ্রুপের বাকি তিন প্রতিপক্ষ থেকে বেশ এগিয়েই আছে স্পেন। শুধু নামের ভারে বললে অবিচার হয়ে যায়, এনরিকের অধীনে বিগত ম্যাচগুলোর ফর্মও ইঙ্গিত দিচ্ছে গ্রুপে ফেভারিট স্পেনই। তবে বড় মঞ্চে অঘটন তো কম হয় না। কে-ই বা ভেবেছিল রাশিয়া বিশ্বকাপে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় ঘন্টা বাজবে স্পেনের!
দল নির্বাচন নিয়ে বেশ বিতর্কের সুযোগ করে দিয়েছেন এনরিকে। সার্জিও রামোস আর কারভাহাল ইনজুরির জন্য না থাকলেও দলে জায়গা হয়নি নাচো আর ইয়াগো আসপাসের। ইনজুরির কারণে তরুন তুর্কি আনসু ফাতিও নেই ইউরো দলে। তাই শুধু অনভিজ্ঞতাই নয়, গোলমুখে স্পেনের দুর্বলতাও ভোগাবে দলকে। এই যেমন, স্রেফ গোলস্কোরিংয়ে পিছিয়ে থাকার কারণেই গত ১০ ম্যাচে স্পেন ৪টি জয় এবং একটি পরাজয়ের পাশাপাশি ড্র করেছে পাঁচটি ম্যাচে! সেক্ষেত্রে সুইডেন কিংবা পোল্যান্ডের মতো দলগুলোর সাথে কঠিন পরীক্ষা দিতে হতে পারে এনরিকের শিষ্যদের।
তবে রামোস না থাকলেও শেষ মুহূর্তে আইমেরিক লাপোর্তের সংযোজন স্পেনের জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাই সাদা চোখে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ইঁদুর-দৌড়ে সবচেয়ে ফেভারিট স্পেনই। বরং গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন না হতে পারাটাই যোগ হবে ইউরোর চমকের খাতায়।
সুইডেন
ইব্রাহিমোভিচ ফিরেছিলেন, কিন্তু পারেননি। এসি মিলানের হয়ে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ইব্রা অবসর ভেঙে ইউরো খেলার জন্য আবার ফিরেছিলেন জাতীয় দলে। তবে ভাগ্যের শিঁকে ছেঁড়েনি। ইনজুরির কারণে দলে জায়গাই হলো না তার। তবে ইব্রাহিমোভিচ ছাড়াই যথেষ্ঠ সমীহ জাগানিয়া জেন অ্যান্ডারসনের দল।
সর্বশেষ বিশ্বকাপে নাম লেখাতে গিয়ে সুইডেন পিছনে ফেলেছিল ইতালি ও নেদারল্যান্ডের মতো দুই জায়ান্ট দলকে। এবারের ইউরো বাছাইপর্বেও তারা পিছনে ফেলেছে আর্লিং হালান্ডের নরওয়েকে। এই ইউরোতেও যে তারা ছেড়ে কথা বলবে না, সেটা বলাই বাহুল্য।
শক্তিমত্তার জায়গার কথা বলতে গেলে আসবে আক্রমণভাগের কথাই। ইব্রা নেই বটে, তবে কুলুসেভস্কি, আলেক্সান্ডার ইসাক কিংবা পোড় খাওয়া এমিল ফর্সবার্গরা নিজেদের দিনে কাঁপিয়ে দিতে পারেন যেকোনো রক্ষণভাগই। ইউরো কোয়ালিফাইংয়ে দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা মেইনজ স্ট্রাইকার রবিন কোয়াইসনও জ্বলে উঠতে পারেন এদের সাথে।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ডিফেন্ডার ভিক্টর লিন্ডেলফের দারুণ বল-প্লেয়িং অ্যাবিলিটি এবং ব্রেন্টফোর্ডের পন্টাস জ্যানসনের এরিয়েল ডুয়েলে শক্তিমত্তার পাশাপাশি অভিজ্ঞ গোলরক্ষক রবিন ওলসেন হতে পারেন রক্ষণভাগে তাদের শক্তির জায়গা। নিশ্চিতভাবেই দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন ভিক্টর; তার দুর্দান্ত পাসিং ক্ষমতা তাকে করেছে দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। সাথে নজর রাখতে পারেন ২১ বছর বয়সী দেজান কুলুসেভস্কির দিকেও, সম্ভবত তিনিই খেলতে যাচ্ছেন ট্র্যাডিশনাল নাম্বার টেন হিসেবে।
২০১৬ সাল থেকে কোচের দায়িত্বে থাকা জেন এন্ডারসন সুইডেনকে বেশ ভালোভাবেই গুছিয়ে এনেছেন। তাই স্পেনের পরে দ্বিতীয় হয়ে গ্রুপপর্ব পার হওয়ার লড়াইয়ে সুইডেনই বেশ এগিয়ে। তবে দুর্বলতার দিক যে নেই, তা কিন্তু নয়। মিডফিল্ডে সৃজনশীলতার অভাবটা দারুণভাবে লক্ষ্যনীয়। এছাড়া রক্ষণভাগও প্রায়ই নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার নজির রয়েছে অতীতে। উল্লেখ্য, বিশ্বকাপ বাছাই শুরুর আগে গত এক বছরে ৮ ম্যাচে ১৬ গোল হজম করেছে সুইডিশ বাহিনী। তবুও এই সুইডিশ বাহিনীর গ্রুপপর্ব পার হওয়াতে তেমন বেগ পোহানোর কথা নয়। বরং ২০১৮ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা সুইডেনের চোখটা থাকবে উপরের দিকেই।
পোল্যান্ড
বিশ্বকাপ ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছি্ল কোচ অ্যাডাম নাওয়ালকাকে। তার জায়গায় এসেছিলেন জার্জি ব্রিজেক। ইউরো ২০২০-এর আগে ন্যাশনস লিগে ভরাডুবিতে তিনিও টেকেননি, তবে যাওয়ার আগে কাজের কাজ করেছেন কিছু নতুন প্রতিভাবানদের জাতীয় দলে সুযোগ করে দিয়ে। তাদের উপরই ভিত্তি করে গড়া পাওলো সোসার টিম এবার চোখ রাঙাতে পারে সুইডেন এবং স্পেনকে। তবে তৃতীয় হলেও পোল্যান্ডের দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
দলে নাম নেওয়ার মতো বেশ তারকা খেলোয়াড় রয়েছেন। রবার্ট লেওয়ানডস্কির কথা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। এই গোলমেশিন ছাড়াও গোলমুখে জিয়েলিনস্কি, মিলিক, পিয়াতেকরা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেন। গোলবারেও বিশ্বস্ত হাত হিসেবে আছেন শেজনি কিংবা ফাবিয়ানস্কি। বেশ কিছুদিন ধরেই দুইজনের মধ্যে গ্লাভসজোড়া নিয়ে স্বাস্থ্যকর এক প্রতিযোগিতা চলে আসছে, আর এবার খুব সম্ভবত সেই প্রতিযোগিতায় জিততে চলেছেন জুভেন্টাস গোলি শেজনিই।
তবে পোল্যান্ডের দুশ্চিন্তা অন্য জায়গায়, বড় টুর্নামেন্টে খেই হারানো। সর্বশেষ বিশ্বকাপেও শীর্ষবাছাই হিসেবে জায়গা করে নেওয়া পোল্যান্ড পড়েছিল বেশ সহজ এক গ্রুপেই। অথচ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন দূরে থাক, গ্রুপে চতুর্থ হয়ে বিদায় নিতে হয়েছিল তাদের। শুধু পোল্যান্ডই নয়, ক্লাবে দুর্দান্ত খেলা লেওয়া্নডস্কি কেন যেন বড় টুর্নামেন্টে নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি কখনোই। পোল্যান্ডের হয়ে তিনটি বড় টুর্নামেন্টে খেলা লেওয়ানডস্কির গোলসংখ্যা মোটে দুইটি। নিজের শেষ ইউরোতে লেওয়ানডস্কি খুব করে চাইবেন এই বেমানান পরিসংখ্যান ঝেড়ে ফেলতে। এছাড়াও দলের অন্যতম ভরসা পিওতর জিয়েলিনস্কি জাতীয় দলের হয়ে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি এখনও।
নজরে রাখতে পারেন ৫৯ ম্যাচে ১৫ গোল করে ফেলা মিলিকের উপর। নাপোলির স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ার পর লোনে মার্শেইতে পারি জমানো এই স্ট্রাইকার এবার আছেন দারুণ ফর্মে, গত ১৬ ম্যাচে গোল করেছেন ১০টি।
স্লোভাকিয়া
শক্তিমত্তার বিচারে স্লোভাকিয়া কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও আন্ডারডগ হিসেবে একদমই ফেলে দেওয়ার মতো দল নয়। স্টেফান টারকোভিচের অধীনে এই বছরে দুর্দান্তভাবে বিশ্বকাপ বাছাই শুরু করা স্লোভাকিয়া চাইবে ইউরোতেও নিজেদের এই ফর্ম টেনে নিয়ে আসতে। শেষ ছয় ম্যাচে তাদের হার মাত্র একটিতে। প্লে-অফে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডকে হারিয়েই ইউরোতে আগমন স্লোভাকিয়ার।
দলে বলার মতো নাম নেওয়া যায় দুইজনেরই। একজন অনেকদিনের অভিজ্ঞ সেনানী মারেক হামসিক, আরেকজন এবার ইন্টার মিলানের হয়ে স্কুদেত্তো জেতা মিলান স্ক্রিনিয়ার। তবে সম্ভাব্য সত্যিটা হলো, এই গ্রুপ থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি স্লোভাকিয়ারই। তবে তাদের অনুপ্রেরণা হতে পারে গত বছরের ইউরো। গতবার গ্রুপে তৃতীয় হয়েও দ্বিতীয় রাউন্ডে জায়গা করে নিয়েছিল হামসিকের দল। এবারও হয়তো সেই লক্ষ্যেই মাঠে নামবে স্লোভাকিয়ানরা।
সাধারণত স্টেফান টারকোভিচ স্লোভাকিয়াকে ৪-৫-১ ফরমেশনে খেলিয়ে থাকেন। নিউ ক্যাসল ইউনাইটেডের গোলরক্ষক মার্টিন ডুব্রাভকার সামনে থাকা মিলান স্ক্রিনিয়ার ইউরোপেরই অন্যতম সেরা সেন্টারহাফ। এছাড়া মিডফিল্ডে হামসিক দারুণ টেকনিক্যাল ভারসাম্যের পাশাপাশি বল দখলেও বেশ পারদর্শী। তবে দলে মানসম্মত গোলস্কোরারের অভাব স্পষ্ট, এমনকি অন্দ্রে দুদা কিংবা হুরাই কুসকা’র মধ্যে একজনকে মেকশিফট স্ট্রাইকার হিসেবেও খেলানো হতে পারে।
শক্তিমত্তার দিক থেকে অনেকটাই কাছাকাছি থাকা তিন দলের সঙ্গে পরিষ্কার ব্যবধানে এগিয়ে থাকা স্পেনের লড়াই হতে চলেছে গ্রুপ-ই’তে। তবে অঘটনের জন্য তাকিয়ে থাকা স্লোভাকিয়া কিংবা হারানো গৌরব খুঁজে ফেরা সুইডেনের পাশাপাশি লেওয়ানডস্কির পোল্যান্ডের দ্বিতীয় স্থানের জন্য লড়াই হতে পারে দারুণ উপভোগ্য। এমনকি এদের মধ্যেই কোনো দল যদি স্পেনকে আটকে দিতে পারে, টুর্নামেন্টে সেটা দিতে পারে আলাদা এক মাত্রা। কারা যাচ্ছে এই গ্রুপ থেকে শেষ ষোলতে? দেখার জন্য অপেক্ষা আর কয়েকটা দিনেরই।