জর্জ উইয়াহ: ইতিহাসের একমাত্র ব্যালন ডি অর জয়ী প্রেসিডেন্ট

আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগের কথা, ফুটবলে শেষবারের মতো ব্যালন ডি অর হাতে তুলেছিলেন রিকার্ডো কাকা। অবশ্য পরের ১০ বছরের ব্যালন ডি অর জয়ীদের কথা সবারই জানা। মেসি আর রোনালদো যেন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন সেগুলো। একটু ফিরে যাওয়া যাক ১৯৯৫ সালে। সে বছর ফুটবলের সেরা পুরস্কারগুলো ঘরে তুলেছিলেন আফ্রিকার যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ লাইবেরিয়ার এক ফুটবলার। অবশ্য তখন কে-ই বা জানতো এই ছেলেই একদিন বনে যাবে লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট!

জর্জ উইয়াহ; Source: Lagos Television

শুরুটা করা যাক শেষ দিয়ে। লাইবেরিয়াতে চলছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপ। পদপ্রার্থী সাবেক এক ফুটবলার অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ ১২ বছর ধরে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে থাকা জোসেফ বোয়াকাই। প্রথম ধাপে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় নির্বাচন গড়ায় দ্বিতীয় ধাপে। গত ২৮ ডিসেম্বরে দ্বিতীয় দফার ফলাফলে যখন তার নাম আসে, রাজধানী মনরোবিয়ার রাস্তায় রাস্তায় তখন চলছিল বিজয়ের উল্লাস। ৯৮.১ শতাংশ ভোট গণনায় উইয়াহর পক্ষে পড়ে ৬১.৫% ভোট। সাথে সাথেই রচিত হলো এক অন্য রকমের ইতিহাস। জর্জ উইয়াহ বনে গেলেন ইতিহাসের একমাত্র ব্যালন ডি অর জয়ী প্রেসিডেন্ট। লাইবেরিয়ার প্রধান নির্বাচন কমিশনার জানান, ১৯৪৪ সালের পর এটিই গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের প্রথম ধাপ। গত ২২ জানুয়ারি তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি লাইবেরিয়ার ২৫তম প্রেসিডেন্ট।

শৈশব

লাইবেরিয়ার রাজধানী মনরোবিয়ার ক্লারা টাউনের এক বস্তিতে জন্ম নেন উইয়াহ। জাতিতে তারা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব লাইবেরিয়ার ক্রু নামক এক অতি দরিদ্র নৃ-গোষ্ঠী। বাবা উইলিয়াম টি উইয়াহ সিনিয়র ছিলেন খ্রিস্টান, পেশায় একজন মেকানিক। তবে তার মা আন্না কোয়াই উইয়াহ ছিলেন মুসলমান, কাজ করতেন বিক্রয়কর্মী হিসেবে। উইয়াহরা ছিলেন চার ভাই। অনেক ছোটবেলাতেই বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে তার ঠাঁই হয় দাদীর কাছে। তার দাদীই তাকে এক স্থানীয় বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেন। কিন্তু এতেই ঘটে যত বিপত্তি। ছেলের মন যে পড়ে আছে অন্যকিছুতে। সেই মনে পড়াশোনার আর জায়গা কোথায়? বস্তির অলিগলিতে অন্য ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলাটাই যেন ছিল তার মূল নেশা।

ফুটবলে আনুষ্ঠানিক হাতেখড়ি

খেলোয়াড় হিসেবে তার যাত্রা শুরু হয় ইয়ং সারভাইভার ক্লাবে। উইয়াহ খেলতেন স্ট্রাইকার হিসেবে। সেসময় লাইবেরিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট ছিল লাইবেরিয়া প্রিমিয়ার লিগ। ফুটবলে তার সুনিপুণ দক্ষতা, অসাধারণ সব স্কিল, গতি আর ড্রিবলিং মুগ্ধ করে ক্লডি লোহুয়াকে। লোহুয়া ছিলেন ক্যামেরুন জাতীয় ফুটবল দলের কোচ। তৎকালীন মোনাকো কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গারকে তিনি উইয়াহর কথা জানালেন। সব শুনে ওয়েঙ্গারও তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন। তিনিও মুগ্ধ হলেন উইয়াহর ফুটবলীয় গুণ এবং দক্ষতাতে। তিনি উইয়াহকে বললেন, লাইবেরিয়াতে থাকলে তোমার উন্নতি হবে না, ক্যারিয়ার গড়তে হলে তোমাকে অবশ্যই ইউরোপে আসতে হবে। ওয়েঙ্গারের হাত ধরেই তার প্রথম ইউরোপ যাত্রা হলো। তাকে দেখে ওয়েঙ্গার বলেছিলেন, “উইয়াহ এক সত্যিকারের বিস্ময়। এত কম বয়সে কোনো ছেলেকে আমি এতটা বিষ্ফোরক হতে দেখিনি।

ফুটবলে তার ছিল সুনিপুণ দক্ষতা, অসাধারণ সব স্কিল, গতি আর ড্রিবলিং; Source: AFP PHOTO / STAFF

১৯৮৮ সালে উইয়াহ যোগ দেন ইতালিয়ান ক্লাব মোনাকোতে। পরের বছরই আফ্রিকার সেরা ফুটবলার হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮৮-৯২ সময়টুকুতে তিনি ছিলেন মোনাকোর নিয়মিত খেলোয়াড়। ১৯৯২ সালে ইউরোপিয়ান উইনার্স কাপের ফাইনালে পৌঁছায় মোনাকো। মোনাকোর জার্সি গায়ে ১০৩ ম্যাচে করেন ৪৭ গোল।

ক্লাব পরিবর্তন

১৯৯২ সালে উইয়াহ যোগ দেন ফ্রেঞ্চ ফুটবল জায়ান্ট প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে। পরের বছর পিএসজি জেতে কোপ ডি ফ্রান্স। ১৯৯৪ সালে তারা জেতে ফ্রেঞ্চ লিগ। সেবছরই দ্বিতীয়বারের মতো আফ্রিকার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন উইয়াহ। ১৯৯৪-৯৫ মৌসুমে তিনিই ছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। অবশ্য সে টুর্নামেন্টে পিএসজি সেমিফাইনাল থেকেই বাদ পড়ে যায়।

পিএসজির জার্সি গায়ে জর্জ উইয়াহ; Source: Goal.com

চ্যাম্পিয়ন লিগ শেষ করে সে বছরই উইয়াহ যোগ দেন ইতালিয়ান আরেক জায়ান্ট এসি মিলানে। পিএসজির হয়ে ইউসিএলে এবং এসি মিলানের হয়ে ভালো করার সুবাদে বছর শেষে তার হাতে ওঠে ফিফা ব্যালন ডি অর, ওজেন ডি অর, ফিফা বর্ষ সেরার পুরস্কার। অবশ্য এতে বিন্দুমাত্র অহংকার জন্মায়নি তার মনে, ভুলে যাননি আর্সেন ওয়েঙ্গারের কথা। বর্ষসেরার পুরস্কার তিনি ওয়েঙ্গারকে উৎসর্গ করেন, যার হাত ধরেই তার ইউরোপে আসা। সে বছরটি ছিল উইয়াহরই জয়জয়কার। ক্যারিয়ারে তৃতীয়বারের মতো জেতেন আফ্রিকা সেরার পুরস্কার।

ব্যালন ডি অর হাতে জর্জ উইয়াহ; Source: edition.cnn.com

১৯৯৬ সালে উইয়াহ ভূষিত হন শতাব্দীর সেরা আফ্রিকান খেলোয়াড়ের খেতাবে। এসি মিলানে তিনি খেলেন ২০০০ সাল পর্যন্ত। সে বছরই ধারে যোগ দেন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল চেলসিতে।

ম্যানচেস্টার সিটির হয়েও প্রিমিয়ার লিগ মাতিয়েছেন তিনি। শেষবারের মতো উইয়াহ যোগ দেন কাতারের ক্লাব আল-জাজিরাতে, সেখান থেকে ২০০৩ সালে ফুটবলকে বিদায় জানান। গোটা ক্লাব ক্যারিয়ারে ৪১১টি ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ছিল ১৯৩।

চেলসির জার্সিতে; Source: the guardian.com

অবশ্য ক্লাব ক্যারিয়ারে যতটা সফল, লাইবেরিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ফুটবলে তিনি ততটাই ম্লান। ২০ বছরের ক্যারিয়ারে লাইবেরিয়ার জার্সি গায়ে ৬০ ম্যাচে তার গোল সংখ্যা ছিল ২২টি। দেশকে কখনো বিশ্বকাপে তুলতে পারেননি। ১৯৯৬ এবং ২০০২ এর আফ্রিকান কাপ অফ নেশনসের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে হয়েছিল লাইবেরিয়াকে।

ক্যারিয়ারে সমালোচনা

১৯৯৬ সালে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের এক ম্যাচে পর্তুগীজ ক্লাব পোর্তোর ডিফেন্ডার জর্জ কোস্তাকে নাক ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ইউরোপে ছয় ম্যাচ নিষিদ্ধ ছিলেন তিনি। উইয়াহ বলেছিলেন, তিনি নাকি তার কাছে বর্ণবাদের শিকার হয়েছিলেন। অবশ্য অভিযোগটাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন জর্জ কস্তা। পরবর্তীতে ফিফা এ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে। যেহেতু বর্ণবাদের অভিযোগ নিয়ে তেমন একটা সাক্ষী বা প্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি, তার পরিপেক্ষিতে জর্জ কস্তাকে এ অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। তবে বিভিন্ন ম্যাচে খেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্যে সে বছরই তিনি ফিফা ফেয়ার প্লে অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে উইয়াহ তিন সন্তানের জনক। তার স্ত্রী ক্লারা উইয়াহ জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত। জর্জ- ক্লারা দম্পতির ঘরে তিন সন্তান রয়েছে। বড় ছেলে জর্জ উইয়াহ জুনিয়র এবং ছোট ছেলে ত্রিমোতি খেলছেন আমেরিকার ইয়ুথ লেভেলের হয়ে। একজন মানবদরদী হিসেবেও উইয়াহ সমাদৃত। ক্যারিয়ারের বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন জাতিসংঘের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে। পেয়েছেন কারেজ অ্যাওয়ার্ড, অ্যান্থার অ্যাওয়ার্ড সহ বিভিন্ন পুরস্কার।

উইয়াহ পরিবার; Source: blakkpepper.com

রাজনীতিতে পদার্পণ

ক্যারিয়ার শেষে তিনি হতে পারতেন কোনো নামকরা দলের ম্যানেজার। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ লাইবেরিয়ার সাধারণ মানুষের কষ্ট তাকে নাড়া দেয়। লক্ষ্য স্থির করলেন, দেশের মানুষের জন্য কাজ করবেন। সে লক্ষ্যেই ফুটবল মাঠ ছেড়ে নামলেন রাজনীতির মাঠে। ২০০৫ সালে তিনি তৈরি করলেন ‘কংগ্রেস ফর ডেমোক্রেটিক চেঞ্জেস’ নামে এক রাজনৈতিক দল, সে বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেন। কিন্তু বিরোধী দল কি আর তাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবে? তারা প্রশ্ন তুলল উইয়াহর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে। অবশ্য আদালত তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বৈধতা দেয়। তবে সেবার তিনি হেরে যান জনসন শিরলিফ এর কাছে। বিপক্ষ দল সবসময় তার শিক্ষা নিয়ে তাকে কথা শোনাচ্ছিল। তিনিও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নন। নতুন উদ্যোমে পড়াশোনা শুরু করলেন। লন্ডনের পাকউড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্পোর্টস ম্যানেজমেন্টের ওপর বিএ ডিগ্রি অর্জন করলেন, মায়ামির দেভরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন বিবিএ ডিগ্রি। ২০১৪ সালে সিনেট নির্বাচনে তার কাছে হেরে যায় প্রেসিডেন্ট পুত্র রবার্ট শিরলিফ। ২০১৬-তে আবার লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট পদপার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে লাইবেরিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট এর দায়িত্বে থাকা জোসেফ বোয়াকাইকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।

লাইবেরিয়ার ঐতিহ্যবাহী পোশাকে জর্জ উইয়াহ; Source: enca.com

নিঃসন্দেহে তিনি লাইবেরিয়ার সর্বকালের সেরা এক খেলোয়াড়। তাই বলে দেশ চালানো কি এতই সহজ? একজন ফুটবলার হিসেবে তিনি যতটা সফল, এখন দেখার বিষয়, একজন দেশনায়ক হিসেবে তিনি ততটাই সফল হন কিনা? অপেক্ষাটুকু শুধু সময়ের।

ফিচার ইমেজ: Quartz

Related Articles

Exit mobile version