কোনো মৌসুম শেষে স্বাভাবিকভাবেই খেলোয়াড় দল-বদলের সময় শুরু হয়। এবং খেলোয়াড় কেনাবেচার উপর ভিত্তি করে যদি কোনো পুরষ্কারের ব্যবস্থা থাকতো তবে তা এবার নিশ্চিত বার্সেলোনার প্রাপ্য। বার্সেলোনা সচারচর বাইরে থেকে এভাবে আকাশছোঁয়া দামে খেলোয়াড় কখনও কেনেনি। এমনকি এক মৌসুমে ৪ থেকে ৫টি সাইনিং কখনো হয়নি। তবে সময় এখন ভিন্ন। বার্সেলোনার অতি বিশ্বস্ত লা মাসিয়া তাদের সঠিক খেলোয়াড়ের যোগান দিতে ব্যর্থ। তাই বার্সেলোনা বেছে নিয়েছে সঠিক বিকল্প পথ।
তবে বার্সেলোনা এবার যেভাবে পরিকল্পনা করে মৌসুম শুরু করছে তাতে এমন গোটাচারেক চোখ ধাঁধানো সাইনিংয়ের প্রয়োজন ছিলো। নেইমারের বিদায়ের পর কোচ ভালভার্দের দল সাজাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো। উসমান দেমবেলেকে কিনে নেইমারের শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করা হলেও তা গতবার সম্ভব হয়নি। এবারও তাকে বেগ পেতে হবে। কারণ দীর্ঘ ১৬ বছর পর বার্সেলোনা খেলবে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাকে ছাড়া! ইনিয়েস্তার স্থানে বার্সেলোনা চেষ্টা করেছে উপযুক্ত খেলোয়াড় কেনার। আর্থার মেলো তার সেরা উদাহরণ। তাছাড়া ভালভার্দের হাতে থাকবে অদল বদল করে খেলানোর অস্ত্র, যাতে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে দলের মূল একাদশ সম্পূর্ণভাবে তৈরি থাকে।
ভালভার্দের কৌশল
আর্নেস্তো ভালভার্দের সবথেকে পছন্দের ফর্মেশন ৪-২-৩-১ হলেও গত মৌসুমে সবসময় তিনি তার পছন্দের ফর্মেশন ব্যবহার করতে পারেননি। নেইমারের চলে যাবার ফলে বার্সেলোনার বাম উইং ফাঁকা হয়ে গিয়েছিলো। সেখানে উসমান দেমবেলে আসলেও কাজে দেয়নি। কারণ ইনজুরির কারণে গত মৌসুমের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে তিনি মাঠের বাইরে ছিলেন। তাই ভালভার্দে গত মৌসুমের অধিকাংশ ম্যাচে ব্যবহার করেছিলেন ৪-৪-২ ফর্মেশন। যেখানে মেসি ও সুয়ারেজ আক্রমণাত্মক পজিশনে থাকলেও মেসিকে দেখা যেত মধ্যমাঠে নেমে এসে আক্রমণ তৈরি করতে। আর মধ্যমাঠে বুসকেটস, ইনিয়েস্তা ও রাকিটিচের সাথে প্রথমদিকে দেখা যেত পাউলিনহো বা আন্দ্রে গোমেজকে।
মৌসুমের মাঝে দলের সাথে যুক্ত হন ফিলিপ কৌতিনহো। তাই পর্যাপ্ত খেলোয়াড় না থাকার কারণে ভালভার্দেকে খেলাতে হয়েছিলো সবসময় একরকম খেলোয়াড় দিয়ে একই ফর্মেশনের ফুটবল, যার মারাত্মক প্রভাব পড়েছে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচগুলোতে।
এবার ভালভার্দের এ সীমাবদ্ধতা থাকবে না। আক্রমণে দেমবেলেকে এখন নিয়মিত পাওয়া যাবে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ম্যালকম অলিভিয়েরা। মিডফিল্ডে নতুন মুখ আর্থার মেলো ও অার্তুরো ভিদাল। এছাড়াও ধারণা করা হচ্ছে রাফিনহা এবার বার্সেলোনার সাথেই থাকবেন। একাধিক অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ থাকার কারণে ভালভার্দে ফিরে যেতে পারেন তার চিরচেনা ফর্মেশন ৪-২-৩-১ এ। যেখানে বুসকেটস ও আর্থার থাকবেন ডাবল পিভট রোলে। স্ট্রাইকার সুয়ারেজকে রেখে এবং মেসিকে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে ব্যবহার করে একপাশে কৌতিনহো ও অন্যপাশে রাকিটিচকে ব্যবহার করে তৈরি হতে পারে এ ফর্মেশন।
তবে প্রাক-মৌসুমের খেলা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, ভালভার্দে এবার তার স্কোয়াডে দেমবেলেকে ব্যবহার করতে আগ্রহী। তাই ৪-৪-২ এবং পরিবর্তিত রূপ ৪-৩-৩ এই বার্সেলোনাকে বেশি খেলাবেন। যেখানে মধ্যমাঠে বুসকেটস, রাকিটিচের পাশাপাশি দুই উইংয়ে আক্রমণে থাকবেন কৌতিনহো ও দেমবেলে। যদিও কৌতিনহো মিডফিল্ড সামলে রাখলেও দেমবেলে আক্রমণে যাবেন রাইট উইং দিয়ে। তখন বার্সেলোনার ফর্মেশন রূপ নেবে ৪-৩-৩ এ।
রোটেশন সুবিধা
স্কোয়াড বা ভালভার্দের পরিকল্পনা যেমনই হোক, একজন খেলোয়াড় কখনোই টানা সম্পূর্ণ মৌসুম খেলতে পারেন না। তার উপর ইনজুরির সমস্যা তো থাকেই। আর টানা খেলার ধকল যে প্রত্যেক ম্যাচে বোঝা যায় তা গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগে বার্সেলোনা বনাম রোমা ম্যাচে বার্সেলোনার খেলা দেখলেই বোঝা সম্ভব। তাই বার্সেলোনা এবার পজিশন অনুযায়ী খেলোয়াড় কিনেছে। দলে টের স্টেগেন থেকে মেসির সাবস্টিটিউট লক্ষ্যণীয়।
ভালভার্দে যদি ৪-৩-৩ ফর্মেশন ব্যবহার করেন তাহলে নতুন কেনা খেলোয়াড়দের স্কোয়াডে সুযোগ পাবার সম্ভবনা কম। তাই আগের একাদশ নামলেও ভালভার্দে অদল বদল করে খেলানোর সুযোগটা নিতে পারেন। দলে এখন চারজন সেন্ট্রাল-ব্যাক ডিফেন্ডার। পিকে, উমতিতিকে প্রতি ম্যাচে এখন না নামলেও চলবে। কারণ বেঞ্চে লেংগ্লেত ও ভারমায়লেন তো থাকছেনই। আর্তুরো ভিদাল একজন অলরাউন্ডার খেলোয়াড়। তিনি বুসকেটসের পজিশনেও খেলতে পারবেন, পারবেন রাকিটিচের পরিবর্তেও নামতে। আর আর্থারকে কেনা হয়েছে ভবিষ্যত পরিকল্পনা হিসেবেই।
তবে সবথেকে প্রয়োজন মেসির বিশ্রাম। তাকে সবসময় দরকার বড় দলের বিপক্ষে বা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে। কিন্ত গত মৌসুমে ভালভার্দেকে বাধ্য হয়ে লিগের প্রায় সব ম্যাচে মেসিকে ব্যবহার করতে হয়েছে। সে কারণেই হয়ত রোমার কাছ থেকে প্রায় ছিনিয়ে এনেছেন ম্যালকমকে, যিনি মেসির অবর্তমানে খেলতে পারেন। এছাড়াও দেমবেলে ও রাফিনহা একই পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত।
তাই, এটা পরিষ্কার যে ফর্মেশন বা খেলোয়াড়দের টানা খেলার ধকল নিয়ে ভালভার্দে না চিন্তা করে ম্যাচগুলো নিয়ে সর্বোচ্চ চিন্তাভাবনা করার সময় পাবেন।
ইনিয়েস্তার শূন্যতা ও কৌতিনহো
জাভির বিদায়ের পর তার রেখে যাওয়া শূন্যতা বার্সাকে প্রতি মুহুর্তে ভাবিয়ে তুলেছে। এ মৌসুম থেকে সবকিছু ভালোর দিকে এগিয়ে গেলেও ইনিয়েস্তার শূন্যতা বার্সাকে ভোগাতে পারে। যে বার্সেলোনা ইনিয়েস্তার শৈল্পিক ফুটবল ও তার পায়ের কারুকাজের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, সেখান থেকে বের হয়ে এসে প্রথমেই সামলে নেওয়া সহজ কিন্তু নয়। বার্সেলোনায় ইনিয়েস্তার মতো বাম উইং কেউ আর রঙিন করে তুলতে পারবে না, কিন্তু কৌতিনহোর উপর ভরসা রাখা যায়।
ইনিয়েস্তার বিদায়ের আগেই বার্সেলোনা বিশাল অর্থ খরচ করে তার স্থানে কৌতিনহোকে নিয়ে এসেছিলো। কৌতিনহোও হতাশ করেননি। গত মৌসুমের অর্ধেক সময় খেলেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন ইনিয়েস্তার স্থানে খেলার যোগ্য তিনি। বার্সেলোনার আক্রমণের সাথে কৌতিনহোর টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ লক্ষ্য করা গেছে, যা ইনিয়েস্তার সাথে ছিলো। এছাড়াও ডি-বক্সের বাইরে থেকে বুলেট গতিতে শট, ড্রিবল, নিখুঁত পাস ও দুর্দান্ত গতির মতো সক্ষমতা আছে কৌতিনহোর। তাই কৌতিনহো বার্সেলোনার মিডফিল্ডের অন্যতম ভরসা হতেই পারেন।
বার্সেলোনার নতুন সাইনিং আর্থারের সাথেও কৌতিনহোর মিল লক্ষ্য করা যেতে পারে। যেহেতু বার্সেলোনাকে ভালভার্দে এবার ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলাবেন ও কৌতিনহো লেফট-মিড ও লেফট-উইং উভয় পজিশনে সাবলীল, তাই তাকে হয়তো নেইমারের সেই পুরনো পজিশনে দেখা যেতে পারে ও আর্থার নামবেন ইনিয়েস্তার পজিশনে।
দেমবেলে: দ্য ট্রাম্পকার্ড
নতুন মৌসুমে উসমান দেমবেলে কতটুকু উন্নতি করতে পারে, তা দেখার জন্য স্বয়ং বার্সেলোনা বোর্ডই উদগ্রীব হয়ে আছে। তরুণ এ খেলোয়াড়কে কিনতে বার্সেলোনা মোটা অঙ্ক খরচ করেছিলো গতবার। কিন্ত দেমবেলের জন্য গত মৌসুম সহজ ছিলো না। যদি দেমবেলে এবার বার্সেলোনা দলে জায়গা করে নিতে পারেন, তাহলে ভালভার্দের ৪-৩-৩ ফর্মেশনে অন্যতম মুখ হতে পারেন এই ফরাসি ইয়াংস্টার। প্রাক-মৌসুমে নজর কেড়েছেন, উয়েফা সুপার কাপে দারুণ একটি গোলের পাশাপাশি তার পারফর্মেন্সও ছিলো দুর্দান্ত। ইনজুরি সমস্যা আবার প্রকটরূপ ধারণ না করলে এবার হয়তো ভালভার্দের সিস্টেমে দেমবেলে নিয়মিত হবেন।
একটি মৌসুমের পুরোটা সময়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে যেকোনো দলের প্রয়োজন হয় একটি পূর্ণাঙ্গ দলের। আর্নেস্তো ভালভার্দে সেই স্কোয়াডটি এবার পেয়ে গেছেন। তাছাড়া দলে তারকা ফুটবলারের তো অভাব নেই। তাই ইনিয়েস্তার শূন্যতা পূরণ করে ভালভার্দে কতটুকু সফল হতে পারেন, সেটিই এখন দেখবার বিষয়।
Feature Image: Deviantart