নোয়াখালীর ছেলে ইয়াসিন আরাফাত মিশু।
চব্বিশ ঘণ্টা আগেও ক্রিকেটে ছিলেন অপরিচিত এক নাম। কিন্তু মঙ্গলবার ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আবাহনীর বিপক্ষে ৮ উইকেট নিয়ে এক পলকে আলোচনায় চলে এসেছেন গাজী ক্রিকেটার্সের এই ফাস্ট বোলার।
বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে লিস্ট-এ ক্রিকেটে ৮ উইকেট নিয়েছেন মিশু। বিশ্বের ১১তম ক্রিকেটার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন তিনি। সেই সাথে এখন তিনি বিশ্বের অষ্টম সেরা বোলিং ফিগারের মালিক।
বাংলাদেশ অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় শেষ হয়ে যায় তার বিশ্বকাপ স্বপ্ন। সেই ধাক্কার গল্প বলেছেন মিশু।
ছয় ফুটেরও বেশি দীর্ঘ এই ফাস্ট বোলারের স্বপ্ন বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলা। তার আগে বেশ কিছু প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির গল্প আছে। আছে মিশুর ভালোবাসার গল্প। তার ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণা মাশরাফি। সেই সাথে আছে নোয়াখালী থেকে মিশুর ক্রিকেটে উঠে আসার গল্পও।
আর এসব গল্প করেছেন মিশু রোর বাংলার সাথে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে।
অভিনন্দন! স্বপ্নের মতো একটা বোলিং করলেন। একটু রহস্যটা বলবেন?
অনেক ধন্যবাদ। রহস্য তেমন কিছুই না ভাইয়া। আজকে উইকেট পেস বোলিং সহায়ক ছিল। আমরা টসে জিতে বোলিং নিয়েছিলাম। স্যার (কোচ সালাউদ্দিন) আমাকে বলেছিলেন, আমাদের শুরুতেই উইকেট তুলে নিতে হবে। আমাকে কোচ বলেছিলেন, জায়গামতো বল করতে এবং ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা বুঝে বল করতে। আমি সেটাই করেছি। আমি উল্টা-পাল্টা কিছু ট্রাই করিনি। ফলে ভালো রেজাল্ট পেয়েছি।
৮ উইকেট পাওয়ার পর কি মনে হচ্ছিল যে, বাকি দুটোও পেলে ভালো হতো!
হা হা হা… সেটা হলে তো খুব ভালো হতো। একদিনের ম্যাচে মনে হয় পৃথিবীর কারোরই ১০ উইকেট নেই। তবে কী আর করা। আগেই তো টিপু সুলতান ২ উইকেট নিয়ে ফেলেছিল। হা হা হা…। না, সত্যি বলি, যা হয়েছে, তাতে আমি অনেক খুশি। এই তো কখনো ভাবিনি। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে, আটটা উইকেট নিতে পেরেছি। আট উইকেট শুধু ভালো বল করলে পাওয়া যায় না। ভাগ্য সাথে থাকতে হয়। সেটা পেরেছি।
আপনি জানতেন যে, এটা বাংলাদেশের রেকর্ড হয়ে গেছে?
না, খেলার সময় জানতাম না। পরে মাঠ থেকে বের হওয়ার পর স্যার বললেন, তোর এটা বাংলাদেশের রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশে আগে নাকি কারো ৮ উইকেট ছিল না।
লিগে তো এটা আপনার মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ। মাঠের বাইরে বসে বাকি ম্যাচগুলো দেখার সময় কি একটা জিদ তৈরি হয়েছিল?
আসলে আমি আরেকটা ম্যাচের জন্য ওয়েট করছিলাম। আমি নিজেকে বলছিলাম যে, সুযোগ পেলে ভালো করতে হবে। সুযোগ যদি আসে, তার মানে কোচ আর ম্যানেজমেন্ট আমার ওপর একটা আস্থা রাখছেন। সেই আস্থার প্রতিদান দিতে হবে, এটাই ভাবতাম। আর এই সময়ে আমি কঠোর ট্রেনিং করেছি। নিজেকে তৈরি করেছি আরও ভালো খেলার জন্য।
বাইরে বসে থাকার অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিল?
এই সময়ে আমি অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। আমি দেখেছি যে, ফাস্ট বোলাররা কী ধরনের অবস্থা ফেস করছে। আমাদের সিনিয়র বোলারদের কাছ থেকে অনেক টিপস পেয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি এই সময়টা কাজে লাগানোর জন্য। কষ্ট না পেয়ে শেখার সুযোগ হিসেবে নিয়েছি আমি এটাকে।
একটু আপনার গল্প শোনা যাক। ক্রিকেটে কীভাবে আসলেন?
আমি তো বিকেএসপির স্টুডেন্ট। আমি ২০১১ সালে বিকেএসপিতে ভর্তি হই। তারপর যা শিখেছি ওখানকার স্যারদের কাছ থেকে শিখেছি। আমি যে আজ এখানে আসতে পেরেছি, ক্রিকেট খেলতে পারছি; এই সবকিছুই বিকেএসপির জন্য হয়েছে। ওখান থেকেই আমি শিখেছি।
আপনি তো নোয়াখালীর ছেলে। নোয়াখালী থেকে আমাদের ক্রিকেটে খুব বেশি ক্রিকেটার আসেন না। আপনি বিকেএসপি পর্যন্ত কীভাবে এলেন?
আসলে আমি ছোটবেলায় খুব দুষ্টু ছিলাম। সারা দিন ক্রিকেট খেলতাম। পড়ায় খুব একটা মন ছিল না। ওই সময় অনেক ক্রিকেট খেলে বেড়াতাম। স্কুল ফাঁকি দিয়ে, পড়া ফাঁকি দিয়ে অনেক ক্রিকেট খেলতাম। তখন আমার একজন প্রাইভেট স্যার ছিলেন, ওনার বাসা ছিল সাভারে। উনি একদিন আব্বু-আম্মুকে বললেন, আমাকে বিকেএসপিতে ভর্তি করে দেওয়ার জন্য। উনিই আমার জন্য ফর্ম তুলে নিয়ে গেছেন। উনিই ভর্তির জন্য ব্যবস্থা করেছেন।
এরপর তো বয়সভিত্তিক ক্রিকেট খেললেন?
হ্যাঁ, সবগুলো এজ লেভেল দলে খেলেছি। অনূর্ধ্ব-১৩, অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৬, অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৯। শুধু বিশ্বকাপটা মিস করলাম ইনজুরির জন্য।
বিশ্বকাপ মিস করাটা তো খুব আফসোসের ব্যাপার ছিল?
খুব। আমার সবসময়ের স্বপ্ন ছিল যে, এরকম একটা বিগ স্টেজে পারফরম করব। বিশ্বকাপ নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ইনজুরিতে পড়ে সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।
এই লিগ দিয়েই তো ফিরলেন ইনজুরির পর?
হ্যাঁ। প্রথমে মনটা খুব খারাপ ছিল। পরে ভাবলাম, এটাই আমার জন্য ভালো সুযোগ। এখানে ভালো পারফর্ম করলেও চোখে পড়ব। সেটাই করার চেষ্টা করছি।
এই এক ম্যাচে তাহলে ইনজুরির দুঃখ ঘোচানো গেল?
মনে হয়। বিশ্বকাপে ভালো কিছু করলে যেরকম আলোচনা হতো, এই পারফর্মেন্স নিয়ে মনে হয় সেরকম আলোচনা হচ্ছে। ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছে, কিছু হারালে কিছু পাওয়া যায়।
এবার একটু পছন্দের কথা বলেন? বাংলাদেশে প্রিয় ক্রিকেটার কে?
অবশ্যই মাশরাফি ভাই। এমনিতেই বোলার হিসেবে উনি আমার খুব পছন্দের। উনার সবকিছুই আমার ভালো লাগে। ক্রিকেটার হিসেবে তো অসাধারণ। আরেকটা কারণ আছে। উনি আসলে আমার এখন ক্রিকেট খেলার অনুপ্রেরণা।
সেটা কেমন?
ইনজুরিতে পড়ার পর মনটা খুব খারাপ লাগতো। তারপর মাশরাফি ভাইয়ের কথা ভাবতাম। উনার দুই পায়ে সাতটা সার্জারি। তারপরও উনি কী দারুণ বল করে যাচ্ছেন। সে তুলনায় আমার ইনজুরি তো কিচ্ছু না। উনি যদি পারেন, তাহলে আমি পারব না কেন; এই চিন্তা থেকেই আমি অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মাশরাফি ভাইকে আমি তাই মনে মনে আইডল মনে করি।
সেই মাশরাফিকে তো আউট করলেন আজ।
হ্যাঁ, এটা খুব ভালো লেগেছে। উনাকে আউট করতে পেরেছি। সবগুলো উইকেটের মধ্যে এটা আলাদা করে মনে থাকবে।
দেশের বাইরে কাকে পছন্দ?
ডেল স্টেইনকে খুব ফলো করতাম একসময়। ওর বোলিং স্টাইল, ওর মাঠে চলাফেরা; সবই ভালো লাগতো। এখন উমেশ যাদবকে দেখি। ও অসাধারণ বোলার। ওর বোলিং থেকে অনেক কিছু শেখার চেষ্টা করি।
এখন লক্ষ্য কী?
এখন লক্ষ্য হচ্ছে, যেখানে সুযোগ পাব, সেখানে ভালো করা। বিপিএল, ঢাকা লিগ, বিসিএল, এনসিএল; যেখানে খেলার সুযোগ পাব, সেখানে ভালো করতে হবে। আমাকে নজরে পড়তে হবে। বিশ্বকাপটা মিস করায় আমি অনেকটাই নজরের বাইরে চলে গেছি। আমাকে এখন নজরে পড়ার মতো পারফর্ম করতে হবে।
জাতীয় দলের স্বপ্ন আছে না?
তা তো অবশ্যই আছে। তবে এখনই সেরকম টার্গেট করে থাকা ঠিক হবে না। এখন যেটা বললাম, নিজের ক্রিকেটটা খেলতে হবে। তারপর ভালো করলে সুযোগ তো একসময় আসবেই।
ফিচার ইমেজ: Collected by Interviewer