নেপালের পশ্চিমে অবস্থিত পৃথিবীর সর্বোচ্চ দশম আঁট হাজারী পর্বতটির নাম অন্নপূর্ণা। সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে দুই ফ্রেঞ্চ পর্বতারোহী মরিস হার্জগ এবং লুইস লাচেনালের পর এখন পর্যন্ত দুই শ’য়ের কম পর্বতারোহী অন্নপূর্ণা শিখর ছুতে সচেষ্ট হয়, চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় প্রায় সত্তর জন। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক পর্বত হিসেবে পরিচিত এই অন্নপূর্ণা আরোহণের মধ্য দিয়েই শুরু হয় নেপালি পর্বতারোহী নির্মল পূর্জার ‘প্রজেক্ট পসিবল’, মাত্র সাত মাসে সবকটি আট-হাজারী পর্বত আরোহণের দুঃসাহসী অভিযান।
পর্বতারোহণের ইতিহাসে চাঁদে পা রাখার মতো অভিযানের গল্পটি আজ বলবো। গল্প করবো অভিযানের মানুষটিকে নিয়ে।
পূর্জা এবং পর্বত
নেপালের মায়াগদি জেলায় অবস্থিত ছোট গ্রাম ডানায় জন্ম নেওয়া নির্মল পূর্জা‘র বেড়ে উঠা বাগমাতি প্রদেশে, নেপালের সবচেয়ে সমতল এলাকা চিটওয়ানে। বাবা ও দুই ভাইয়ের মতো বড় হয়ে ব্রিটিশ মিলিটারিতে গোর্খা সৈনিক হিসেবে যোগ দেওয়াই ছিল তার স্বপ্ন।
২০০৩ সালে তার স্বপ্ন পূরণ হয়, মাত্র আঠারো বছর বয়সে যোগ দেয় গোর্খা রেজিমেন্টে। সেখানে ছয় বছর কাটিয়ে স্থানান্তরিত হয় ব্রিটিশ রয়াল নেভির বিশেষ বাহিনী স্পেশাল বোট সার্ভিসে। গোপন সব অভিযান পরিচালনায় পারদর্শী ব্রিটিশ নেভির এই এলিট ইউনিটটি প্রধানত রয়াল মেরিন কমান্ডোদের দ্বারা গঠিত। বর্তমানে নিমসদাই নামে দুনিয়া-ব্যাপী পরিচিত নির্মল পূর্জার মতো একজন ভিনদেশি যে এই এলিট ইউনিটটিতে এমনি এমনি স্থান পায়নি, তা তার সাম্প্রতিক বছরগুলোর কর্মযজ্ঞ দেখলেই উপলব্ধি করা যায়।
পর্বতের দেশে জন্ম নেওয়া এই সৈনিকের জীবনে পর্বত প্রেম আসে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে, এভারেস্ট বেস ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনার সময়। পূর্জার মতে, তিনি যতটা না পর্বতের অমসৃণ, কঠিন ট্রেইলের প্রেমে পড়েছিলেন, তার চাইতে বেশি উপভোগ করেছিলেন পর্বত চূড়ার চারপাশের দৃশ্য।
বেস ক্যাম্পে অভিযানের সময়ই তিনি তার গাইডকে বলে পর্বত আরোহণের প্রাথমিক পাঠ নেন এবং সে সময়ই ৬১১৯ মিটার উচ্চতার লবুচে ইস্ট সামিট করেন। এরপর যখনই স্পেশাল ফোর্স থেকে ছুটি পেতেন, তখনই নতুন প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো ছুটতেন কোনো পর্বতে।
নির্মল পূর্জার আট হাজারী পর্বত, অর্থাৎ আট হাজার মিটার অথবা তার বেশি উচ্চতার পর্বত শৃঙ্গে আরোহণের শুরুটা ২০১৪ সালে, ৮১৬৭ মিটারের ধাওলাগিরি দিয়ে। যেখানে এ ধরনের পর্বতগুলো আরোহণের জন্য পর্বতারোহীরা সাধারণত দুই মাসের মতো সময় নেন, সেখানে তিনি মাত্র ১৪ দিনের মাথায় ধাওলাগিরি আরোহণ করে ফিরে আসেন। কোনো ধরনের অ্যাক্লিমাটাইজেশন বা উচ্চতা এবং আবহাওয়ার সাথে অভ্যস্ত হওয়ার চেষ্টা ছাড়াই। সে সময়ই তিনি বুঝতে পারেন, হাই অল্টিটিউডের সাথে তার বেশ ভালো সখ্যতা রয়েছে।
সে বছরই তাকে স্পেশাল ফোর্সের পর্বতারোহী দলের এক্সট্রিম কোল্ড-ওয়েদার ওয়ারফেয়ারের প্রধান প্রশিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি হয়ে উঠেন গোর্খা রেজিমেন্টের নেতৃস্থানীয় প্রশিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম।
২০১৭ সালের মে মাসে নিজের গোর্খা দল নিয়ে তিনি এভারেস্ট আরোহণ করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পা রাখেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। তারও আগে, ২০১৬ সালের প্রায় একই সময়ে প্রথমবারের মতো এভারেস্ট আরোহণ করেছিলেন। যদিও তার গোর্খা দল সে ব্যাপারে জানত না।
পূর্জা এবং তার গোর্খা দল এভারেস্ট আরোহণ শেষে কাঠমুন্ডুতে ফিরে আসেন। সপ্তাহ খানেকের মতো আনন্দ ফুর্তি করে পুনরায় নিজের দল নিয়ে আবার এভারেস্টের শিখর ছুঁতে বের হন। আগের চেয়েও কঠিন আবহাওয়ায় পৃথিবীর সবচাইতে উঁচু শৃঙ্গে তৃতীয়বারের মতো পা রাখেন।
এর পরপরই এভারেস্টের ছায়ায় অবস্থিত পৃথিবীর চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্বত লোৎসে’তে আরোহণ করেন। নামচে বাজার নেমে দুই দিন অভিযানের সফলতা উদযাপন করে মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় পৃথিবীর পঞ্চম সর্বোচ্চ শৃঙ্গ ‘মাকালু’ আরোহণ করেন। তৈরি করেন নতুন বিশ্ব রেকর্ড।
এক সাক্ষাৎকারে পূর্জা দাবি করেছিলেন, নামচে বাজারে সময় না কাটালে পুরো অভিযানটি তিনি দিনে শেষ করতে পারতেন। আসলেই যে তিনি তা পারতেন, তার প্রমাণ পরবর্তীতে মাত্র সাত মাসে পৃথিবীর সবগুলো আট-হাজারী পর্বত আরোহণের স্পর্ধা দেখলেই বুঝা যায়।
প্রজেক্ট পসিবল
পর্বত পাড়ায় অল্প স্বল্প নাম ডাক থাকলেও যখন নির্মল পূর্জা মাত্র সাত মাসে ১৪টি আট-হাজারী পর্বত আরোহণের ঘোষণা দেন, কেউ তা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। বরং ধরেই নিয়েছিল জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভে উঠতি পর্বতারোহীর বেপরোয়া চেষ্টা। অধিকাংশ পর্বতারোহীই ‘চাঁদে সাতার কাটা’র মতো অসম্ভব উদ্ভট কল্পনার সাথে প্রস্তাবটিকে তুলনা করে হাসি-ঠাট্টা পর্যন্ত করেছিল। তার যথেষ্ট কারণও ছিল।
আলপাইন পর্বতারোহণের কিংবদন্তি রেইনহোল্ড মেসনার সবগুলো আট-হাজারী পর্বত আরোহণ করেন ১৯৮৬ সালে, যাত্রা শুরুর ১৬ বছর পর। পরবর্তী ৩৪ বছরে প্রায় চল্লিশ জন পর্বতারোহী তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় অনেকে। অধিকাংশ পর্বতারোহীদেরই লক্ষ্যে পৌঁছতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই দশক, বা তার বেশি।
কিংবদন্তি পোলিশ পর্বতারোহী জার্জি কুকোজকা নানান সব কঠিন রুটে, নানান প্রতিকূল আবহাওয়ায় আট-হাজারী পর্বতগুলো আরোহণ করেন সাত বছর এগারো মাস চৌদ্দ দিনে। পরবর্তীতে আট-হাজারী পর্বতগুলো আরোহণের সবচাইতে দ্রুততম রেকর্ডটি ছিল সাউথ কোরিয়ান পর্বতারোহী কিম চাং হো’র; সাত বছর দশ মাস ছয় দিন।
নানান সময় এক বছরে সবকটি আট-হাজারী পর্বত আরোহণের পরিকল্পনা, আরোহণ সম্ভব, কি সম্ভব না বিষয়ক তর্কবিতর্ক চললেও, গুরুত্বের সাথে তা কেউ নেয়নি। তাই বলা বাহুল্য কেন পূর্জার সাত মাসে সবকটি আট-হাজারী আরোহণের প্রস্তাবটি অধিকাংশদের কাছে উদ্ভট কল্পনা ছাড়া কিছুই মনে হয়নি। অন্তত ২০১৯ সালের ২৪শে মে’র আগ পর্যন্ত তো নয়ই।
বিসমিল্লাতেই উদ্ধার অভিযান
২০১৯ সালের বসন্ত। নির্মল পূর্জা এবং তার শেরপা দল অন্নপূর্ণা আরোহণ করেন এপ্রিলের ২৩ তারিখে। শুরু হয় পর্বতারোহণের ইতিহাসে রেকর্ড ব্রেকিং আরোহণ যজ্ঞের প্রথম পর্ব। সফল অভিযানের পর বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন। প্রায় তিনটা ত্রিশ নাগাদ কষ্টার্জিত কয়েকটি বিয়ার দিয়ে অভিযানের সফলতা উৎযাপন করেন।
ঠিক ঐ সময়টাতেই অন্নপূর্ণায় মালয়েশিয়ান পর্বতারোহী চিন উই কিন প্রায় ছত্রিশ ঘণ্টা ধরে নিখোঁজ। সবাই ভেবেই নিয়েছিল চিন মৃত। এত সময় ধরে এত বেশি উচ্চতায়, খারাপ আবহাওয়ায় কারো বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সকাল ছ’টা নাগাদ বেসক্যাম্পে একটি হেলিকপ্টার উড়ে আসে। এক শেরপা জানায়, প্রায় সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় চিন’কে দেখা গিয়েছে। তিনি জীবিত, হাত নাড়াচ্ছেন। সাথে সাথেই নিমস হেলিকপ্টারে চড়ে বসেন এবং যেখান থেকে চিনকে দেখা গিয়েছিল সেখানে পৌঁছান।
তিনি তখনো জীবিত, হাত নাড়াচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, হেলিকপ্টার সেখানে পৌঁছোতে অক্ষম। যেকোনো উদ্ধারের অভিযান শুরু করতে হলে আরো নিচ থেকে করতে হবে।
চিন উই কিন অন্নপূর্ণা সামিট করেন। ফেরার সময় ক্লান্তি, অবসন্নতায় ভেঙে পড়েন। তার শেরপা অল্প অক্সিজেনের সাথে আনুমানিক সাড়ে সাত হাজার মিটার উচ্চতায় তাকে রেখে চার নাম্বার ক্যাম্পে আসেন সাহায্যের জন্য। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ক্যাম্পে থাকা প্রায় ত্রিশ জন পর্বতারোহীর একজনও সহায়তা করতে রাজি হননি।
উই কিন চিনকে জীবিত দেখেই নিমসদাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তাকে কী করতে হবে। তিনি বেসক্যাম্পে ফিরে আসেন। দলের বিশ্বস্ত পর্বতারোহী মিংমা শেরপা, গেসমান টামাং এবং গালজেন শেরপাকে নিয়ে উদ্ধার অভিযানে বের হন। হেলিকপ্টার তাদেরকে ৬,৫০০ মিটারের ক্যাম্প-থ্রির নিচে নামিয়ে দেন।
যেখানে অন্নপূর্ণা আরোহণের দিন দলটির ষোল ঘণ্টার মতো লেগেছিল, সেখানে সেদিন দলটি মাত্র চার ঘণ্টায় পুরো দূরত্বটি অতিক্রম করে। পর্বতের কঠিন আবহাওয়ার মাঝেও এত উচ্চতায় দলটি যেন উসাইন বোল্টের মতো ছুটছিল।
আটচল্লিশ বছর বয়সী মালয়েশিয়ান ক্লাইম্বার চিন উই কিনকে উদ্ধার করে ক্যাম্প-থ্রিতে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে তাকে হেলিকপ্টার যোগে কাঠমুন্ডু পাঠানো হয়। জ্ঞান থাকলেও তিনি হাইপোথার্মিয়া এবং ফ্রস্টব্রাইটে ভুগছিলেন। প্রায় চল্লিশ ঘণ্টার মতো পানি, খাবার এবং অক্সিজেন ছাড়া এত উচ্চতায় দৈবক্রমে বেঁচে গেলেও মে মাসের দুই তারিখে তিনি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
ধাওলাগিরি এবং কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্ব
উই কিন চিনের উদ্ধার করতে গিয়ে অন্নপূর্ণাতে ব্যয় করা অতিরিক্ত সময় প্রজেক্ট পসিবলের পরবর্তী ৮১৬৭ মিটারের পর্বত ধাওলাগিরি আরোহণে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। দলটি আরোহণের জন্য ভালো আবহাওয়া হারায়। তারপরেও বেঁধে দেওয়া শক্ত সময়সূচীর জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই নিমসাদাই ও তার শেরপা দল ধাওলাগিরির দিকে রওনা দেয় পহেলা মে। আরোহণ করেন বারোই মে। প্রচণ্ড খারাপ আবহাওয়ার কারণে সে বছর বসন্তে নিমস এবং তার দল ছাড়া আর কোনো দল ধাওলাগিরি আরোহণ করতে পারেনি।
ধাওলাগিরি আরোহণ শেষে সারা রাত নিচের দিকে নেমে বেস ক্যাম্পে ফেরেন সকাল আটটায়। সবকিছু গুছিয়ে হেলিকপ্টার যোগে কাঠমুন্ডু ফিরে আসেন বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ। সেখানে আরোহণের সফলতা উৎযাপন করে দলটি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে রওনা দেয়।
১৫ মে, অর্থাৎ ধাওলাগিরি আরোহণের মাত্র তিন দিনের মধ্যে দলটি পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত, ৮৫৮৬ মিটারের কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করে। কিন্তু কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে নামার সময় দলটি আরেকটি উদ্ধার অভিযানের সম্মুখীন হয়। ৮৪৫০ মিটার উচ্চতায় তারা একজন ভারতীয় বাঙালি পর্বতারোহী বিপ্লব বৈদ্য এবং তার শেরপার খোঁজ পায়। দু’জনেরই অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরেই তারা একই দলের আরেক ভারতীয় বাঙালি পর্বতারোহী কুন্তল কাঁড়ারের সন্ধান পায়। যিনি হাই-অল্টিটিউড সেরিব্রাল এডিমা’তে ভুগছিলেন। সম্ভাব্য ঝুঁকির কথা জানা থাকা সত্ত্বেও নিমস এবং তার দল নিজেদের অক্সিজেন তাদেরকে দিয়ে দেন। এরপর ক্যাম্প-৪’য়ে রেডিও যোগে সাহায্যের জন্য আবেদন করতে থাকেন। কিন্তু সেদিন প্রায় ৫০ জন পর্বতারোহীর কেউ সাহস দেখিয়ে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি।
কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর গেসমান ফ্রস্টবাইটের কবলে পড়ে। অন্যদিকে প্রজেক্ট পসিবল দলের আরেক সদস্য মিংমা শেরপার হাই-অল্টিটিউড সেরিব্রাল এডিমার লক্ষণ দেখা দেয়। দুজনই নিচে নামতে বাধ্য হয়। এদিকে প্রায় দশ ঘণ্টা অপেক্ষার পর পূর্জা বুঝতে পারেন কোনো সাহায্য আসবে না। তারা তখন ক্যাম্প-৪ থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটের দূরত্বে। নতুন সাপ্লাই না থাকায় অক্সিজেনও শেষ হয়ে যায়। সেদিন নিমসাদাই এবং তার দলের অমানুষিক প্রচেষ্টার পরেও দুজন পর্বতারোহীই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এই প্রতিকূলতা, মৃত্যুর মাঝেই তাদের কাছে খবর আসে আরেকজন পর্বতারোহী সেদিন উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কবলে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘায় লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নির্মল পূর্জা এবং একজন শেরপা তাকে খুঁজে বের করে এবং ক্যাম্প-৪’য়ে নিয়ে আসে। শেষ হয় আরেকটি উদ্ধার অভিযান।
প্রতিবন্ধকতার মাঝেও নতুন বিশ্ব রেকর্ড
এবারের অভিযান পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত ৮,৮৪৮ মিটারের এভারেস্ট, চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্বত ৮,৫১৬ মিটারের লোৎসে এবং পঞ্চম সর্বোচ্চ পর্বত ৮,৪৮১ মিটারের মাকালুতে। পূর্বে, ২০১৬ সালে নিমসাদাই এবং তার দল এই তিনটি পর্বত মাত্র পাঁচ দিনে আরোহণ করেছিলেন। এবারের পরিকল্পনা ছিল পর্বতগুলোতে আরো দ্রুত আরোহণ করা। কিন্তু বাদ সাধে এভারেস্টের হিলারি স্টেপে পর্বতারোহীদের ট্র্যাফিক। যার ছবি পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়।
মানব ট্রাফিকের কারণে এভারেস্ট আরোহণে প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টার মতো অতিরিক্ত সময় লাগে। ২২শে মে দলটি এভারেস্ট আরোহণ করে। একই দিনে এভারেস্টের ছায়ায় অবস্থিত লোৎসেতে এবং ২৪শে মে মাকালু আরোহণের মাধ্যমে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায় তিনটি আট হাজারী পর্বত আরোহণের মাধ্যমে নিজের পূর্বের রেকর্ড ভাঙেন।
অক্সিজেন কথন
পরবর্তী আটহাজারী পর্বত পাণে ছোটার আগে পর্বতারোহণে অক্সিজেনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা যাক।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে উঠার সাথে সাথে বায়ুমণ্ডলে ব্যারোমেট্রিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে থাকে। ফলে বাতাসে অক্সিজেনের অণুগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যায়। উচ্চতা বাড়ার সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে প্রত্যেক শ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের পরিমাপও তাই কমতে থাকে। যেহেতু সুস্থ কোষগুলোই শরীর এবং মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখতে সচেষ্ট এবং কোষগুলোর সুস্থতা রক্তের মাধ্যমে প্রবেশ করা অক্সিজেনের সাহায্যেই ধরে রাখা সম্ভব, সেহেতু অক্সিজেন স্বল্পতার ফলে ক্লান্তি, অবসন্নতা থেকে শুরু করে শরীর এবং মস্তিষ্কে নানা রকম জটিল ও কঠিন সমস্যা তৈরি হয়। পর্বতারোহীদের যেহেতু শুধু উচ্চতাই না, বরং সেখানকার বরফ শীতল রুক্ষ আবহাওয়া, খাবার ও ঘুমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর অপর্যাপ্ততার সাথেও লড়তে হয়, সেহেতু উচ্চতাজনিত সমস্যাগুলো আরো বেশি দেখা দেয়। এসব কারণেই মূলত পর্বতে বোতলজাত অক্সিজেন বা সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেনের গুরুত্ব অপরিসীম।
পর্বতারোহণের বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে অনেক আলপাইন পর্বতারোহী মনে করেন পর্বতারোহণে সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেন ব্যবহার করাটা প্রতারণা। যদিও ১৯৫০ সাল, অর্থাৎ প্রথম আটহাজারী পর্বত আরোহণের পর থেকে এখন পর্যন্ত যতজন আটহাজারী পর্বত আরোহণ করেছেন তার মাত্র তিন, কি চার শতাংশ পর্বতারোহী সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেন ছাড়া আরোহণ করেছেন। এই দিকে প্রজেক্ট পসিবলের পুরো অভিযানটি নিমসাদাই এবং তার দল সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেনের সাহায্যে নিয়ে শেষ করেছেন। আর এই ব্যাপারটি নিয়েই পর্বত পাড়া থেকে কিছুটা হলেও কটু কথা শুনতে হবে, তা আর অপ্রত্যাশিত কী!
তবে এ নিয়ে নির্মল পূর্জার মধ্যে কোনো আফসোসও নেই। কেননা যেখানে অন্যান্য পর্বতারোহীরা অন্নপূর্ণা, ধাওলাগিরি সহ সবগুলো আটহাজারী পর্বত আরোহণ করার সময় প্রত্যেকটা ক্যাম্পে থামেন, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেন, প্রয়োজনে অ্যাক্লিমাটাইজ করেন, সেখানে বেঁধে দেওয়া শক্ত সময়সূচীর জন্য পূর্জাকে বেসক্যাম্প থেকেই সরাসরি সামিট পুশ করতে হতো।
একেতো প্রত্যেকেই পর্যাপ্ত ঘুম থেকে বঞ্চিত হতো, তার উপর ঠিকঠাক অ্যাক্লিমাটাইজ করার সুযোগ না থাকায় প্রত্যেককেই মাত্রারিক্ত ক্লান্তি, অবসন্নতা এবং পর্বতের উচ্চতাজনিত সমস্যাগুলোর সাথে লড়তে হতো। তাছাড়া একটি পর্বত আরোহণের পর, পরবর্তী পর্বতে আরোহণের জন্য ভালো আবহাওয়া ধরতে অধিকাংশ সময়ই পূর্জাকে স্পিড ক্লাইম্বিং করতে হয়েছে। অক্সিজেন ছাড়া এ ধরনের পর্বতারোহণ শুধু বিপদজনকই না, বরং এতে মৃত্যুর ঝুঁকিও রয়েছে।
প্রথমদিকে সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেন ছাড়া প্রজেক্ট পসিবল সম্পন্নের ইচ্ছা থাকলেও, ২০১৬ সালে এভারেস্টের একটি ঘটনা সেই ইচ্ছায় পানি ঢালে। সেবার তিনি একজন নারী ক্লাইম্বারকে উদ্ধার করেন। আর সেটা সম্ভব হয় সাথে পর্যাপ্ত অক্সিজেন থাকার কারণেই। যদি পর্যাপ্ত অক্সিজেন না থাকতো, তাহলে ঐ নারী পর্বতারোহীকে উদ্ধার করা সম্ভব হতো না। উদ্ধারের চেষ্টা করতে গেলে হয়তো নিজেকেও মৃত্যু ঝুঁকি নিতে হতো।
পরবর্তীতে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরোহণ করে নামার সময় যে উদ্ধার অভিযানগুলো চালিয়ে গিয়েছিলেন তাও সম্ভব হয়েছিল অক্সিজেন থাকার কারণেই। যদিও সে সময় নিজেদের অক্সিজেন বিসর্জন দিতে হয়েছিল, গেসমান ও মিংমা শেরপাকেও ভুগতে হয়েছিল। পূর্জা দাবি করেন, যদি সে সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করা যেত, তাহলে উদ্ধার অভিযানটা আরো দ্রুত হতো। হয়তো দুই ভারতীয় বাঙালি পর্বতারোহীকে বাঁচানো যেত। তাই সাপ্লিমেন্ট অক্সিজেন নিয়ে নেতিবাচক সকল মন্তব্য, প্রশ্নগুলো উনি বিরক্তির সাথেই উপেক্ষা করেন।
দ্বিতীয় পর্ব
২০১৯ সালের জুলাই মাসের তিন তারিখে পূর্জা এবং তার দল ‘কিলার মাউন্টেন’ খ্যাত ৮১২৬ মিটারের নাঙ্গা পর্বত সামিট করেন। পাকিস্তানের গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চলে অবস্থিত সর্বোচ্চ নবম আটহাজারী পর্বতটিকে স্থানীয় ভাষায় ‘ডায়ামির’ বা ‘বড় পর্বত’ ডাকা হয়। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে নাঙ্গা পর্বত আরোহণের পরপরেই ব্রিটিশ ঘড়ি নির্মাতা কোম্পানি ব্রেমন্ট ঘোষণা দেয় তারা প্রজেক্ট পসিবলের পরবর্তী আরোহণগুলোর জন্য ফান্ডিংয়ের বড় অংশের যোগান দেবে।
প্রজেক্ট পসিবলের শুরু থেকেই নির্মল পূর্জাকে ফান্ডিং নিয়ে বেশ বড় রকমের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। সাত মাসে সবকটি আটহাজারী পর্বত আরোহণ সম্ভব কি সম্ভব না দ্বন্দ্বে প্রায় কোনো ব্র্যান্ডই স্পন্সর করতে এগিয়ে আসেনি। তাই নির্মল পূর্জাকে নিজের বাড়ি বন্ধক থেকে শুরু করে স্পেশাল ফোর্সে থাকাকালীন জমানো প্রায় সব টাকা খরচ করতে হয়েছে। বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে ফান্ড রাইজিং সাইটগুলোর মাধ্যমে নানাজনের কাছে হাত পাততে হয়েছে। ব্রেমন্ট টাইটেল স্পন্সর হিসেবে আবির্ভাবের পর পরবর্তী আরোহণগুলোর জন্য ফান্ডিং নিয়ে দুশ্চিন্তা কমে যায়।
১৫ তারিখ দলটি কারাকোরাম রেঞ্জে অবস্থিত পৃথিবীর এগারোতম সর্বোচ্চ পর্বত ৮০৮০ মিটারের গাশের ব্রুম-১ এবং ১৮ তারিখে ৮০৩৫ মিটারের গাশের ব্রুম-২ সামিট করেন। সেখান থেকে দলটি পৌঁছায় পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বত ৮৬১১ মিটার উচ্চতার কে-টু’র বেসক্যাম্পে।
ঐ সিজনে মাত্রারিক্ত খারাপ আবহাওয়ার কারণে প্রায় সবকটি দলই সামিটের আশা বাদ দিয়ে ফেরার পথ ধরেছিল। কিন্তু নিমসাদাই এবং তার দল এর মধ্যেই সামিট করার সিদ্ধান্ত নেন। বেসক্যাম্পে যারা ছিল, তারাও নতুন আশা দেখতে পায়। যদি নিমস এবং তার দল রুট ফিক্স করতে সক্ষম হয়, তাহলে অনেকেই ঐ রুটে সামিট পুশের চেষ্টা করবেন বলে ঠিক করেন। নিমসাদাই নিজে ফিক্সিং টিম পরিচালনা করেন এবং সফলভাবে ২৪ তারিখ প্রজেক্ট পসিবলের চার সদস্য সহ কেটু’র শিখরে পা রাখেন।
সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ দলটি বেসক্যাম্পে ফেরে। পূর্ববর্তী সামিটের দশ ঘণ্টাও পার না হতে হতে তারা সর্বোচ্চ চতুর্থ পর্বত ৮০৫১ মিটারের ব্রড পিক পাণে ছোটেন। ২৬ তারিখ সকালে ব্রড পিক আরোহণের মাধ্যমে মাত্র ২৩ দিনে সম্পূর্ণ করেন দ্বিতীয় পর্বের আরোহণ; বেসক্যাম্প টুতে পৌঁছানোর জন্য কোনো ধরনের হেলিকপ্টারের সাহায্য না নিয়েই। সেদিনই সন্ধ্যা আটটা নাগাদ নিরাপদে কে-টু বেসক্যাম্পে ফেরেন নির্মল পূর্জা ও তার দল।
টিম প্রজেক্ট পসিবল ইতিহাস গড়ার, অসম্ভবকে সম্ভব করার খুব কাছে চলে এসেছে।
আর বাকি তিন
প্রায় দুই মাসের লম্বা বিরতির পর চায়না-নেপাল বর্ডারে অবস্থিত ষষ্ঠ সর্বোচ্চ পর্বত ৮২০১ মিটারের ‘চো ওয়ু’ আরোহণের মাধ্যমে শুরু হয় প্রজেক্ট পসিবলের তৃতীয় পর্ব। মাত্র চার দিনের মাথায় সেপ্টেম্বরের সাতাশ তারিখে আরোহণ করেন অষ্টম সর্বোচ্চ পর্বত ৮১৫৬ মিটারের মানাসলু। আর বাকি এক, তিব্বতে অবস্থিত চৌদ্দতম সর্বোচ্চ পর্বত ৮০১৩ মিটারের শিশামাঙপা। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় অনুমতি পাওয়া নিয়ে।
শিশামাঙপা হচ্ছে একমাত্র আটহাজারী পর্বত যা পুরোপুরি চীনে অবস্থিত। সে সিজনে সব পর্বতারোহীর জন্যই শিশামাঙপা আরোহণের অনুমতি বন্ধ করে দেয় চায়না-তিব্বত মাউন্টেইনারিং এসোসিয়েশন। অনুমতি পাওয়া নিয়ে চীন এবং নেপাল সরকারের মধ্যে কয়েক পর্যায়ে কূটনৈতিক আলোচনা-পর্যালোচনাও হয়। রাজনৈতিক এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে অনুমতি পাওয়া সম্ভব হবে কি হবে না দ্বন্দ্বের ঠিক মাঝামাঝি সময়ে নেপালে অবস্থিত চাইনিজ অ্যাম্বাসি থেকে মৌখিক অনুমতি প্রদান করা হয় এবং প্রজেক্ট পসিবল টিমকে সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দেয়।
লিখিত অনুমতি পাওয়ার পর, ২৯শে অক্টোবর, অর্থাৎ মানাসলু আরোহণের ঠিক এক মাস একদিন পর প্রচুর বাজে আবহাওয়ার মাঝে প্রায় পনেরো ঘণ্টা একটানা আরোহণ করে প্রজেক্ট পসিবল টিম পৌঁছায় শিশামাঙপার শিখরে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন সপ্তাহ আগে, মাত্র ছয় মাস ছয় দিনে আরোহণ করেন সবকটি আটহাজারী পর্বতের শেষ পর্বতটি। সাফল্যের সাথে শেষ হয় মিশন প্রজেক্ট পসিবল।
শেষ কথা
পূর্জা তার প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। সাত মাসেরও কম সময়ে সবকটি আটহাজারী পর্বতের সুউচ্চ শিখরে আরোহণ করে তৈরি করেছেন নতুন ইতিহাস। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন পুরো পৃথিবীকে। অধিকাংশদের কাছে যা ‘চাঁদে সাতার কাটার মতো’ অসম্ভব মনে হয়েছিল, যারা ভেবেছিলেন সাত মাসে সবকটি আটহাজারী পর্বত আরোহণ শুধু দিবা স্বপ্ন ছাড়া কিছুই না, পূর্জা এবং তার প্রজেক্ট পসিবল টিম তা করে দেখিয়েছেন। দলগত প্রচেষ্টা, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সাহসী পদক্ষেপ এবং দৃঢ়সংকল্পের মাধ্যমে যেকোনো কিছু অর্জন সম্ভব, চোখে আঙ্গুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছেন পুরো পৃথিবীকে।