আমস্টারডাম, রোটেনডাম ও আইন্দহোফেন – নেদারল্যান্ডের অন্যতম তিনটি শহর। এই তিনটি শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ফুটবল ইতিহাসের নন্দিত তিনটি ক্লাব – আয়াক্স, ফেইনুর্দ ও পিএসভি আইন্দহোফেন। গত কয়েক দশক ধরে ঘরোয়া লিগ দাপিয়ে বেড়ানো এই তিন ক্লাবেরই রয়েছে বিখ্যাত একাডেমি। ফুটবল তৈরি করার কারিগর হিসেবে এদের জুড়ি নেই। তবে এদের পাশাপাশি আরেক অখ্যাত গ্রোনিংগেন একাডেমি কিছুটা আড়ালে থাকলেও এই একাডেমি থেকেই উঠে এসেছেন রোবেন ও ভ্যান ডাইকের মতো ফুটবলাররা। তবে এদেরও আগে গ্রোনিংগেন থেকে এসেছিলেন এক কিংবদন্তি ডিফেন্ডার, রোনাল্ড ক্যোমান।
যানদামে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলারের জীবন শুরুই হয়েছে ফুটবলে লাথি মেরে। বাবা মার্টিন দুই ভাই এরউইন ও রোনাল্ডকে ছোটবেলা থেকেই ফুটবলে উৎসাহিত করে তোলেন। আর সেই উৎসাহে স্থানীয় ক্লাব ভিভি হেল্পমান ও গ্রোনিংগানে খেলা শুরু করেন তিনি। বল-প্লেয়িং হওয়ার সুবাদে রক্ষণ ও মাঝমাঠে দুই জায়গাতেই স্বচ্ছন্দ্যে খেলতে পারতেন রোনাল্ড। তবে মূলত বাবার প্রেরণায় বল নিয়ে পড়ে থাকতেন দুই ভাই। এমনকি নিজেদের ছোটবেলায় খাওয়ার জন্যও বাসায় যেতেন না দুই ভাই। বরং ব্যালকনি থেকে মা’র ছুড়ে দেওয়া খাবার খেলার মাঠেই খেতেন দুই ভাই। এই পরিশ্রম বিফলে যায়নি।
রোনাল্ড ক্যোমানের সিনিয়র দলে অভিষেক ঘটে ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে। সেই সময় তার বয়স হয়েছিল মোটে ১৭ বছর ৮৩ দিন। গ্রোনিংগানের তৃতীয় সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন সেদিন। ৬৬ মিনিটের খেলায় রোনাল্ড সেইদিন প্রতিভা ও ম্যাচিউরিটির ছাপ দেখিয়েছিলেন যথেষ্ট। নিজের প্রথম মৌসুমে ক্লাবের হয়ে ৬টি গোল করেন ক্যোমান। রক্ষণের খেলোয়াড় হয়ে এই সংখ্যাটি নেহায়েতই কম নয়। দূরপাল্লার শট ছাড়াও ফ্রি-কিক কিংবা পেনাল্টিতে ভয়ঙ্কর ছিলেন ক্যোমান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সেই মৌসুমে করা ছয় গোলই ক্যোমানের ক্যারিয়ারে এক মৌসুমে করা সবচেয়ে কম গোল!
পরের দুই মৌসুম মিলে করলেন ২৯ গোল। তখন এই ডিফেন্ডারের বয়স সবেমাত্র ১৯। তৎকালীন সময়ের প্রতিভাবান তরুণদের মধ্যে সবার সামনে ক্যোমান। নেদারল্যান্ড জাতীয় দলের ডাকও চলে আসে দ্রুতই। মাত্র ২০ বছর বয়সে ১৯৮৩ সালে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে তার। তবে সেই সময়টাতে পালাবদলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল নেদারল্যান্ড। ১৯৮৪ ইউরো ও ১৯৮৬ বিশ্বকাপও খেলতে পারেনি তারা। তবে ক্যোমানদের হাত ধরে আবার পুনর্জাগরণ হয় ডাচদের। ততদিনে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, গ্রোনিংগানে আর বেশিদিন থাকতে হবে না ক্যোমানকে। বেশিদিন অপেক্ষাও করতে হয়নি। ১৯৮৩ সালে আয়াক্স থেকে ডাক পান তিনি। আর তিনিও আয়াক্সের হয়ে খেলার সুযোগ লুফে নিতে দেরি করেননি। তার উপর আগের দুই মৌসুমেই ব্যাক টু ব্যাক লিগ জিতেছিল আয়াক্স। কিন্তু সেবারই কোচ ক্রুইফের বিদায়ে পিছিয়ে পড়ে আয়াক্স। শিরোপা জিতে নেয় ফেইনুর্দ। তবে নিজে ব্যক্তিগতভাবে দারুণ পারফর্ম করেন। নিজের গোল করার দক্ষতা টেনে আনেন আয়াক্সেও। তবে পরের মৌসুমেই শিরোপা জিতে নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম শিরোপার স্বাদ পান ক্যোমান।
সেই সময়ে আয়াক্স দলে ছিল তরুণ প্রতিভাবানদের ছড়াছড়ি। ফন বাস্তেন, রাইকার্ড, ক্যোমানরা ছিলেন একই টিমে। তারপরও পরবর্তী মৌসুমে সুপার কোপা জিতলেও লিগ শিরোপা ধরে রাখতে পারেনি তারা। কারণ, ততদিনে পিএসভি আইন্দহোভেনের নবজাগরণ শুরু হয়ে গেছে। ওই সময়টাতে ডাচ ফুটবল ছিল অদ্ভুতুড়ে। প্রতিটি ক্লাবেই তরুণ প্রতিভার ছড়াছড়ি থাকলেও জাতীয় দল ছিল রীতিমতো ধ্বংসস্তূপ। অবশ্য পরবর্তীতে রাইকার্ড, রুদ খুলিত, ফন বাস্তেন, ক্যোমানরা আবার স্বরূপে ফেরান ডাচদের।
১৯৮৬ সালে ক্যোমান বিতর্কিতভাবে আয়াক্স ছেড়ে পাড়ি জমান রাইভাল ক্লাব পিএসভিতে। সেজন্য চরম রোষানলে পড়লেও নিজের সিদ্ধান্তে অটুট ছিলেন তিনি। আগের দুই মৌসুমে ছড়ি ঘুরানো পিএসভি অবশ্য কোচ হ্যান্স ক্রে’র অধীনে পরের মৌসুমে খাবি খায়। তাতে অবশ্য ‘শাপে বর’ হয়েই এইবার ডাগআউটে আসেন গাস হিডিঙ্ক। হিডিঙ্ক আর রোনাল্ড ক্যোমান মিলে পিএসভিকে নিয়ে যান সর্বোচ্চ শিখরে। হিডিঙ্ক দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম মৌসুমেই লিগ জিতে পিএসভি। দলের পক্ষে ক্যোমান করেন ১৯ গোল, যা কি না ক্যোমানের এক মৌসুমে ঘরোয়া লিগে করা সবচেয়ে বেশি গোল। তবে সেরা সাফল্য আসতে তখনো বাকি।
১৯৮৭-৮৮ মৌসুম ক্যোমানের ক্যারিয়ারের সেরা মৌসুম হিসেবে বিবেচিত। এই মৌসুমে পিএসভি হয়ে ওঠে আরো দুর্বার। নিজেদের প্রথম তিন লিগ ম্যাচে পিএসভি করে ২২ গোল। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ফেইনুর্দকে ৩-১ ও আয়াক্সকে হারায় ৪-২ গোলে। টানা ১৭ ম্যাচ অপরাজিত থাকার পর পরের লেগের দেখায় ফেইনুর্দের কাছে হারে তারা। তবে তাতে এতটুকুও আঁচড় লাগেনি পিএসভির গায়ে। পুরো মৌসুমে মাত্র দুইটি ম্যাচ হেরে সর্বোচ্চ ১১৭ গোল করে লিগ চ্যাম্পিয়ন হয় পিএসভি, সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন রোনাল্ড ক্যোমান।
অন্যদিকে, ইউরোপিয়ান কাপে প্রথম ম্যাচেই গ্যালতাসারেইর বিপক্ষে ৩-০ জয় লাভ করে এই ডাচ ক্লাব। দলের হয়ে প্রথম গোলটি করেন ক্যোমান নিজেই। পরের রাউন্ডগুলোতে বোর্দো ও র্যাপিড ভিয়েনার সামনে পড়লেও ক্যোমানের রক্ষন দৃঢ়তায় সহজেই পার পেয়ে যায় পিএসভি। সেমিফাইনালে পিএসভি মুখোমুখি হয় রিয়াল মাদ্রিদের। আরো একবার ক্যোমান ত্রাতা হয়ে আসেন। তার গোলেই বার্ন্যাবুতে ১-১ ড্র এর ফলে নিজ মাঠে ০-০ তে মাদ্রিদকে রুখে দেয় তারা। যার ফলে পুরো ইউরোপিয়ান কাপজুড়ে ঘরের মাঠে কোনো গোল না খাওয়ার নজির গড়ে পিএসভির রক্ষণ, যার নেতৃত্বে ছিলেন রোনাল্ড ক্যোমান।
একই গল্প ঘরোয়া কাপেও। সহজেই ফাইনালে উঠে যায় পিএসভি। ফাইনালে ক্যোমান অবিশ্বাস্যভাবে পেনাল্টি মিস করলেও শিরোপা জিততে বেগ পোহাতে হয়নি তাদের। এই দুই শিরোপার পর সবার চোখ চলে যায় ইউরোপিয়ান কাপে। ফাইনালে পিএসভির প্রতিপক্ষ বেনফিকা। স্টুটগার্টে হওয়া ফাইনালে বেনফিকাকে গোল বঞ্চিত রাখে পিএসভি। টাইব্রেকারে গড়ানো খেলায় শেষমেষ ৬-৫ এ জিতে নিয়ে ট্রেবল জিতার ইতিহাস তৈরি করে এই ডাচ ক্লাব। পুরো মৌসুম মিলিয়ে ২৬ গোল করেন রক্ষণের মায়েস্ত্রো রোনাল্ড ক্যোমান।
দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ক্যোমান, ব্যালন ডি’অর জয়ী রুদ খুলিত, ফন বাস্তেন, রাইকার্ডসহ ১৯৮৮ ইউরো খেলতে আসে নেদারল্যান্ড। আগেরবার ইউরো খেলার যোগ্যতা অর্জন না করা ডাচরাই এইবার অন্যতম ফেভারিট ছিল। সব ঠিকঠাক মতো চললেও সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে পিছিয়ে পড়ে ডাচরা। আবারও রক্ষাকর্তার ভূমিকায় ক্যোমান, তার গোলেই সমতায় ফেরে দল। পরবর্তীতে বাস্তেনের গোলে ফাইনালে উঠে আসে তারা।
ফাইনালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ২-০ গোলের সহজ জয়ে নিজেদের ইতিহাসে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা জিতে নেয় নেদারল্যান্ড। তবে ক্যোমানের জন্য তা আরো মধুর, একই বছরে ইউরোপের সবচেয়ে মূল্যবান দুইটি শিরোপা ইউরোপিয়ান কাপ ও ইউরোও জিতেছিলেন যে তিনি!
পরের মৌসুমেও পিএসভির হয়ে ঘরোয়া লিগ জিতলেও ইউরোপিয়ান কাপের সাফল্যের পুনরাবৃত্তি করতে পারেনি পিএসভি। ১৯৮৯ সালে তৎকালীন বার্সা কোচ ক্রুইফ ক্যোমানকে বার্সেলোনায় নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গ্যারি লিনেকার, গুইলার্মো আমোর, জোসে ব্যাকেরো ও ক্যোমানদের নিয়ে স্বপ্নের একাদশ সাজান তিনি। প্রথম মৌসুমে শুধু কোপা দেল রে জিতেই শান্ত থাকতে হয় তাদের। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী, সর্বোচ্চ তিনজন বিদেশি খেলোয়াড় থাকার মারপ্যাঁচে ক্রুইফ শেষমেশ ক্যোমানের উপর বিশ্বাস রেখে ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার এলিসিওকে ছেড়ে দেন। তার জায়গায় আনেন ফরোয়ার্ড রিস্টো স্টইচকভকে। আর এই সিদ্ধান্তেই মোড় ঘুরে যায় বার্সেলোনার ইতিহাসের।
টোটাল ফুটবল আর পজেশিন ঘরানার ফুটবল খেলে ৫ বছর পর রিয়াল মাদ্রিদের দাপটের ইতি টেনে লা লিগা জিতে নেয় বার্সেলোনা। ৩-৪-৩ ফর্মেশনে খেলা ডিপ লায়িং মিডফিল্ডে ছিলেন ক্যোমান ও গার্দিওলা। এই দুইজনই ছিলেন ক্রুইফের মূল তুরুপের তাস। বল-প্লেয়িং ডিফেন্ডার হওয়াতে দলে সবার চেয়ে বেশি প্রাধান্য ছিল ক্যোমানের।
কিন্তু ক্রুইফের মূল লক্ষ্য ছিল ইউরোপিয়ান কাপ জয়। ১৯৯১-৯২ মৌসুমে ঘরোয়া লিগ জিতে সেবার ইউরোপিয়ান কাপেও ফাইনালে উঠে বার্সেলোনা। ফাইনালে তাদের প্রতিপক্ষ সাম্পদোরিয়া। ৯০ মিনিটশেষে গোলশূন্য থাকায় খেলা গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। আর এই সময়টাতেই নিজেকে ইতিহাসের পাতায় বন্দী করেন ক্যোমান। দুর্দান্ত এক ফ্রি-কিকে বার্সেলোনার ইতিহাসে প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের স্বাদ এনে দেন ক্যোমান। ক্যারিয়ারে ৬২ ফ্রি-কিক গোলের মধ্যে সবচেয়ে স্মরনীয় ছিল এই গোলটিই। পরের দুই মৌসু্মেও ক্রুইফের অধীনে লিগ জিতে নেন ক্যোমান। ১৯৯৪ ইউরোপিয়ান কাপে আবারও ফাইনালে উঠেছিলেন, কিন্তু সেবার এসি মিলানের কাছে হেরে যায় বার্সেলোনা।
সেই মৌসুমের পরই আবার নেদারল্যান্ডে ফিরে যান তিনি, ফেইনুর্দের হয়ে খেলেন দুই মৌসুম। তিন বিখ্যাত ডাচ ক্লাবের হয়ে খেলার নজির গড়েন তিনি। অবশেষে ক্যারিয়ারে ৬৮৫টি ম্যাচ খেলে ২৩৯ গোল করার পর বুটজোড়া তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এই কিংবদন্তি ডিফেন্ডার। এমন এক রক্ষণপ্রহরী, যার গোলসংখ্যা শুধুমাত্র রক্ষণভাগের খেলোয়াড় নয়, অনেক ফরোয়ার্ডদেরও ধরাছোঁয়ার বাইরে।
খেলাধুলার চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/
ফুটবল নিয়ে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ