এক মৌসুমে ‘অলৌকিক’ উত্থান, পরের মৌসুমেই পতন!

কোনো মৌসুমের প্রথম ম্যাচের কিকঅফ থেকেই দলের সমর্থকদের আশা থাকে, এ মৌসুমে পূর্বের সফলতাকে ছাড়িয়ে যাবার। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, মধ্যম সারির দলগুলো সবসময় তা করতে পারে না। কারণ সফলতার জন্য ধারাবাহিক ভালো খেলোয়াড়, আর্থিক সহায়তা বা ভালো কোচ মধ্যম মানের ক্লাবগুলো ধরে রাখতে পারে না।

এ মৌসুমে এমন কিছু ক্লাব রয়েছে, যারা মৌসুমের প্রথম ম্যাচ থেকেই ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরছে। পয়েন্ট টেবিলে তাদের অবস্থান অনেক নিচে, অথচ গত মৌসুমে তারাই সম্মানজনক স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করেছিলো। মৌসুমজুড়ে বড় দলকে হারিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছিলো এ দলগুলোই। তবে এবার তাদের অবনতি হলেও অনেকগুলো কারণে যেন তাদের সমর্থকদেরও ভ্রুক্ষেপ নেই।

মোনাকো

মোনাকো গত মৌসুম শেষ করেছিলো ফ্রেঞ্চ লিগে দ্বিতীয় হয়ে ; Image Credit : VALERY HACHE/AFP/Getty Images

প্রথমে আসা যাক ফ্রেঞ্চ লিগের শীর্ষস্থানীয় ক্লাব মোনাকোকে দিয়ে। তারা গত মৌসুম শেষ করেছিলো ফ্রেঞ্চ লিগে দ্বিতীয় হয়ে। পিএসজিকে বারবার খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলো মোনাকো। তবে ভাগ্য সহায় না হবার কারণে ফ্রেঞ্চ লিগ না জিততে পারলেও ক্লাবটি হয়েছিলো প্রশংসিত। কিন্তু সেই মোনাকোর কোনো সফলতা নেই চলতি মৌসুমে, তাদের নিয়ে শুধুই অবনতির সংবাদ ঘুরে চলছে ফরাসি পত্রিকাগুলোতে।

চলতি মৌসুমে বর্তমানে মোনাকো রয়েছে ফ্রেঞ্চ লিগের ১৭ নম্বরে। যদি মৌসুম শেষে ফ্যালকাওদের দল এ অবস্থানে থেকে শেষ করে, তাহলে তাদের নেমে যেতে হবে ফ্রেঞ্চ লিগের দ্বিতীয় বিভাগে। ৯ ম্যাচে তারা জয় পেয়েছে মাত্র একটি! থমাস লেমার আর ফ্যাবিনহোর চলে যাওয়ার শূন্যতা তাদের বেশ ভোগাচ্ছে। সম্প্রতি বোর্ড তাদের কোচ লিওনার্দো জারদিমকেও বরখাস্ত করেছে। তবে শুরুতেই মোনাকোর যে দশা, মৌসুম শেষে সেরা দশের মধ্যে থেকে লিগ শেষ করতে পারাটাই হবে ‘লেস মনেগাস্ক’দের সার্থকতা।

এফসি শালকে ০৪

গত বছরের অনবদ্য ‘এফসি শালকে’ এবার যেন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছে ; Image Credit : PATRIK STOLLARZ/AFP/Getty Images

বুন্দেসলিগায় বায়ার্ন মিউনিখের একতরফা আধিপত্যের কারণে বাকি সবার পারফরম্যান্স সবার নজরে সেভাবে আসে না। কিন্তু বায়ার্ন মিউনিখকে সরিয়ে রেখে বাকি দলগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যাবে ছোট দলের বড় লড়াইয়ের আমেজ। আর এখানেই শালকে ০৪ গত মৌসুমে ছিলো অনবদ্য। বরুসিয়া ডর্টমুন্ড বা বেয়ার লেভারকুসেনের মতো দলকে পেছনে ফেলে শালকে গত মৌসুম শেষ করেছিলো দ্বিতীয় হয়ে।

কিন্তু এই মৌসুমে তারা ফর্ম ধরে রেখে শুভসূচনা করতে পারেনি। দলের গুরুত্বপূর্ণ দুই ডিফেন্ডারকে বিক্রি করার প্রভাব একাদশের রক্ষণে লক্ষণীয়। আর সব থেকে বাজে বিষয় হলো, শালকে ফরোয়ার্ডদের গোল না পাওয়া। তবে গোল করার আত্মবিশ্বাস ফিরে আসলে হয়তো শালকে’র উন্নতি করারও সম্ভবনা থেকে যায়।

বেয়ার লেভারকুসেন

Caption

গত মৌসুমে বেয়ার লেভারকুসেন লিগ শেষ করেছিলো পঞ্চম স্থানে থেকে। গোল খাওয়ার প্রবণতা ছিল কম, গোল করার দিকে মনোযোগ ছিল তুলনামূলক বেশি। এজন্য অাক্রমণাত্মক ফুটবল খেলে গেছে তারা। তবে নতুন মৌসুমে ট্রান্সফারগুলোর কারণেই সম্ভবত সাফল্য তাদের থেকে বহু দূরে। দলের প্রধান গোলরক্ষক ব্রেনার্ড লেনো পাড়ি জমিয়েছেন আর্সেনালে, রক্ষণে অন্যতম মুখ বেনজামিন হেনরিচও নেই এখন। তাই দুর্বল রক্ষণের জন্য গোল হজম করার হার বেড়ে গেছে। এ মৌসুমে খেলা ম্যাচের ভেতর ৫০ শতাংশ ম্যাচেই অন্তত ৩ গোল হজম করেছে দলটি।

তবে লেভারকুসেনের ভবিষ্যৎ এখনই ভেবে নেওয়াটা ঠিক হবে না। তারা প্রথমেই পথ হারিয়েছে ঠিকই, তবে যেসব দলের কাছে হেরে পয়েন্ট হারিয়েছে সেগুলো ডর্টমুন্ড ও বায়ার্নের মতো বড় দল। তাই এখনও যথেষ্ট সুযোগ আছে তারুণ্যনির্ভর এ দলটির বুন্দেসলিগার তলানি থেকে উপরে উঠে আসার।

ভ্যালেন্সিয়া

এবার লা লিগা’তে শুরুতেই পথ হারিয়েছে ভ্যালেন্সিয়া ; Image Credit : JOSE JORDAN/AFP/Getty Images

ভ্যালেন্সিয়ার গত মৌসুমে সেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কথা মনে আছে? প্রায় ১০ গেম উইক পর্যন্ত তারা না হারার রের্কড ধরে রেখেছিলো। বার্সেলোনার সাথে তাল মিলিয়ে একই পথে হাঁটছিলো তারা। এ জয়ের ধারা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে হয়তো পারেনি, কিন্তু লিগে চতুর্থ হয়ে ঠিকই অর্জন করে নিয়েছিলো চ্যাম্পিয়নস লিগের মূল মঞ্চে খেলার সুযোগ।

কিন্তু এবার লা লিগা দৌড়ে শুরু থেকেই পথ হারিয়েছে ভ্যালেন্সিয়া। হয়তো তাদের গত মৌসুমের বেশ কিছু খেলোয়াড় নেই, কিন্তু প্রত্যাশা অনুযায়ী পারফরম্যান্সের জন্য দারুণ একটি তারুণ্যোদ্দীপ্ত দল তাদের আছে। কিন্তু শুরু থেকেই ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে যে কখন আত্মবিশ্বাসটাই খুইয়ে বসেছে, সেটাই চিন্তার।

আটলান্টা

কোনোরকমে টিকে আছে আটলান্টা ; Image Credit : Gabriele Maltinti

গত মৌসুমে সপ্তম স্থানে লিগ শেষ করলেও আটলান্টার জন্য তা ছিল রূপকথার গল্প লেখার মতো। দলের অবস্থা অনেক বছর ধরেই ঠিক সুবিধার নয়, ধুঁকে ধুঁকে চলার মতো কোনরকমে সিরি আ’তে টিকে আছে তারা। কিন্তু গত মৌসুমে যেন এক চমকের নাম ছিল ইতালির এ ক্লাবটি।

আটলান্টা যে গত মৌসুমের মতোই ধারাবাহিক ভালো খেলে যাবে, তা আশা করা বাস্তবসম্মত নয়। কিন্তু প্রথম ম্যাচে ৪ গোলের ব্যবধানে জয়ে তাদের শুরু যেন আরেক সফলতার মৌসুমের পথই দেখাচ্ছিলো। কিন্তু তারপরই পতন, বাকি ম্যাচগুলোতে একটিও জয় পায়নি তারা। যেখানে মোট ১৮ পয়েন্ট, তা থেকে মাত্র ৩ পয়েন্ট তুলতে পেরেছে আটলান্টা। গোল করার শক্তিও যেন তাদের কমে গেছে। রোমার সাথে ৩ গোল ও প্রথম ম্যাচে ফরসিনানকে ৪ গোলের পর বাকি ম্যাচে দু’টির বেশি গোল করতে পারেনি। তাদের সেরা খেলোয়াড় আলেহান্দ্রো গোমেজ ও নতুন সাইনিং এমিলিয়ানো রিগনি প্রথম ম্যাচের পর থেকেই ফ্লপ।

তাই আটলান্টার ভাগ্যে কি আছে বলা মুশকিল। গত মৌসুমে আকস্মিক উত্থানের পর এ মৌসুমে আকস্মিক পতনও যে ঘটতে পারে, বলাই বাহুল্য।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এ মৌসুমে ‘তথৈবচ’ অবস্থা ; Image Credit : Michael Regan

এতক্ষণ যেসব দল সম্পর্কে বলা হচ্ছিলো, সেগুলোর সবই মধ্যম মানের দল। আটলান্টা, লেভারকুসেন বা শালকে যে প্রতি মৌসুমে ভালো খেলবে, ব্যাপারটা তেমনও নয়। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড? প্রিমিয়ার লিগের অন্যতম বড় দলের পরিস্থিতি বর্তমানে এমন ছোট দলের মতই। লিগে ৮ ম্যাচের ভেতর ৪ ম্যাচ হেরে তালিকার ৮ নম্বরের আছে মরিনহোবাহিনী, যা কখনোই কাম্য নয়।

তবে এ হতাশার কারণ কী? ট্রান্সফার উইন্ডোতে সঠিক খেলোয়াড় কিনতে ব্যর্থ হওয়া? জোসে মরিনহো নাকি বোর্ডের কাছে খেলোয়াড়দের তালিকা করে দিয়েছিলেন, যদিও তারা মরিনহোকে নিরাশ করেছে। মিডফিল্ডে ফ্রেড আর রক্ষণে ডিয়েগো ডালৌ ছাড়া আর কোনো খেলোয়াড় পাননি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ। কিন্তু খেলোয়াড় কিনতে না পারলেও ‘রেড ডেভিল’দের ভালো একটি দল এখনও আছে, তা তো আর উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু দলটির সমস্যা কোথায়?

ইউনাইটেড এ পর্যন্ত ব্রাইটন, টটেনহাম হটস্পার, ওয়েস্টহামের কাছে হেরেছে, ড্র করেছে উলভারহ্যাম্পটনের সঙ্গে। লিগে হেরে যাওয়া প্রত্যেকটা ম্যাচে ম্যানইউ ডিফেন্স হজম করেছে অন্তত ৩ গোল। চ্যাম্পিয়নস লিগেও একই অবস্থা, ইয়ং বয়েজের মত ছোট দলের বিপক্ষে জিতলেও ঠিকই পয়েন্ট হারিয়েছে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে।

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়তো এই মুহূর্তে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। যেখানে স্পষ্ট কোচের একগুয়ে স্বভাব, পগবা থেকে শুরু করে লুকাকু’র ধারাবাহিক বাজে খেলা ও ডিফেন্সের প্রতিনিয়ত হতাশার ছাপ, সাফল্য আসবে কী করে?

স্টেড রেঁনে

রেঁনে গত মৌসুমে উপভোগ্য ফুটবলই উপহার দিয়েছিলো ; Image Credit : JEAN-FRANCOIS MONIER

সবসময় ফ্রেঞ্চ লিগের তালিকায় তলানিতে থাকা দল রেঁনে গত মৌসুমে তাদের দর্শকদের উপভোগ্য ফুটবল উপহার দিয়েছিলো, লিগ শেষ করেছিলো পঞ্চম হয়ে। কিন্তু গত সিজনের ফর্ম এ মৌসুমে সেভাবে নিয়ে আসতে পারেনি তারা, যদিও এর পেছনে যুক্তিগত কারণ আছে।

গত মৌসুমের ঝলক দেখে ক্লাব এবার বেশ অর্থ খরচ করেছে। মাত্র একজন খেলোয়াড়ের পেছনেই প্রায় ১১ মিলিয়ন খরচ করা তাদের জন্য বিশাল কিছুই বটে। কিন্তু তাদের এই বড় ট্রান্সফার করার সাহস একদম মাঠে মারা গেছে, জর্দান সিয়েবাতচেউ যে এখনও দলের হয়ে গোলের খাতাই খুলতে পারেননি!

তবে তরুণদের নিয়ে গড়া রেঁনে দলটার উপর কিছুটা আস্থা অবশ্য রাখাই যায়। টানা ৩ ম্যাচ হারের পর তারা ড্র করেছিলো তুলুজের বিপক্ষে, আর শেষ ম্যাচ তো মোনাকোর ঘরের মাঠে হারিয়েই দিয়েছে রেঁনে। হয়তো গত মৌসুমের সাফল্যকে ছোঁয়া কিছুটা হলেও কঠিন, কিন্তু স্কোয়াড অনুযায়ী ভালো খেলা তো সম্ভব। আপাতত নাহয় সেটাকেই ধ্রুবতারা ধরে নিক রেঁনে! 

Featured Image Source: The FA via Getty Images

Related Articles

Exit mobile version