১.
চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এক অর্থে আপনি বলতে পারেন বুর্জোয়াদের লিগ। কেননা ইউরোপের সব বুর্জোয়া ক্লাবরাই এখানে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে শামিল হয়। আর ইউরোপাকে বলতে পারেন প্রলেতারিয়েতদের লিগ। সেই হিসেবে উয়েফা সুপার কাপ হচ্ছে বুর্জোয়াদের বাদশাহর সাথে প্রলেতারিয়েতদের বাদশাহর লড়াই।
আবার আপনি যখন স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের দিকে তাকাবেন তখনও দেখবেন এই নগরী দু’ভাগে বিভক্ত। নগরের এক অংশে রয়েছে ইতিহাসের সফলতম ক্লাব, প্রতি বছর দলে গ্যালাকটিকো ভেড়ানো বুর্জোয়া অধিপতি রিয়াল মাদ্রিদ। নগরের অপর প্রান্তে রয়েছে একজন দক্ষ সেনাপতির অধীনে পরিশ্রম করে যাওয়া কিছু ক্ষুধার্ত সৈনিক, বুর্জোয়াদের দুর্গ ভাঙাই যাদের একমাত্র লক্ষ্য।
সেনাপতি সিমিওনের অধীনে ঘরের লীগে নগর প্রতিপক্ষদের বিপক্ষে অ্যাথলেটিকোর সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স দুর্দান্ত। লা লিগায় গত ১০ মাদ্রিদ ডার্বির মাত্র একটিতে জয় পেয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। কিন্তু ইউরোপীয় আসরে চিত্রটা উল্টো। ইউরোপীয় আসরে নকআউট রাউন্ডের কোনো ম্যাচ, কোনো ফাইনালেই জয় নিয়ে ফিরতে পারেনি লাল-সাদা দুর্গ। আজকের উয়েফা সুপার কাপ তাই তাদের জন্য শাপমুক্তির লড়াই, বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার লড়াই।
২.
জিদান ও রোনালদোত্তর যুগে নতুন রূপে রিয়াল মাদ্রিদ আজকেই প্রথম কোনো শিরোপা লড়াইয়ে নামছে। টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের পর মাদ্রিদের ইতিহাসের সফলতম কোচ ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দিলে বড়সড় ধাক্কা খায় রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই ক্লাব ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে বসেন রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই মূহুর্তে কিছুটা পরিচয় সংকটে ভুগছে রিয়াল মাদ্রিদ। গ্রীষ্মকালীন দলবদলের বাজারে বড় কোনো তারকেও দলে ভেড়ায়নি হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ীরা, যেটা দলের গভীরতাকেও সংশয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে।
কাগজে-কলমে রিয়ালের অবস্থা যতটা খারাপ শোনা যাচ্ছে, ততটা খারাপ হয়তো তাদের অবস্থা না। জিদান চলে গেলেও রিয়াল মাদ্রিদ নতুন কোচ হিসেবে যাকে পেয়েছে, তিনিও একজন টেকনিক্যাল মাস্টারমাইন্ড। স্পেনের সদ্য-বিগত কোচ লোপেতেগি স্পেনের হয়ে তার ২০ ম্যাচের কোচিং ক্যারিয়ারে হারের মুখ দেখেননি একবারও। বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে জাতীয় দলের দায়িত্বে থাকলে হয়তো স্প্যানিশদের এত তাড়াতাড়ি রাশিয়া থেকে বাড়ি ফিরতে হতো না।
আর রোনালদোর বিদায়কেও স্বাভাবিকভাবেই দেখতে চেষ্টা করছে দলের সদস্যরা। একজন তারকা খেলোয়াড়ের অনুপস্থিতিতে রিয়াল মাদ্রিদের মতো একটি শক্তিশালী দল ভেঙে পড়বে সেটা ভাবাটাও অমূলক। রোনালদোর কোনো সাহায্য ছাড়াই গত চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল ও ফাইনাল জিতেছে রোজি ব্ল্যাঙ্কসরা। তবে হ্যাঁ, বহু বছর ধরে দলের প্রাণ হয়ে থাকা এই নক্ষত্রকে ছাড়া যখন আজ টালিনে মাঠে নামবে, তখন স্নায়বিক একটা ছন্দপতন হতেই পারে। কিন্তু তা-ও যেন উড়িয়ে দিলেন রামোস। রোনালদোর প্রস্থান দলের উইনিং মেন্টালিটিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলেই বিশ্বাস রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়কের।
“রোনালদোর মতো একজন খেলোয়াড়কে হারানো দলের জন্য অবশ্যই নেতিবাচক, কিন্তু তার মানে এই না যে আমাদের জয়যাত্রা থেমে যাচ্ছে। রিয়াল মাদ্রিদের ইতিহাসে অনেকেই এসেছে গিয়েছে, এর মধ্যেই আমাদের জয়রথ অব্যাহত রয়েছে।
সবার উপরে রিয়াল মাদ্রিদ। চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তার, কিন্তু যা-ই ঘটুক না কেন, আমরা এগিয়ে চলবোই।”
শুধু কথা নয়, এখন মাঠের খেলা দিয়েও রোনালদোর শূন্যতাকে পূরণ করবে রামোসরা এটাই আশা করবে মাদ্রিদিস্তারা।
৩.
নগর প্রতিপক্ষরা যখন গত কয়েক বছরে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করছে, তখন সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েও তাদের ছায়া থেকে বের হতে পারেনি অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। তবে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে গত মৌসুমে অবশেষে ইউরোপীয় সাফল্যের মুখ দেখলো তারা। হোক ইউরোপা, উয়েফার টুর্নামেন্ট তো! আর এর চেয়ে বড় কথা, লীগে পিছনে ফেলেছে নগর প্রতিপক্ষদের। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম রিয়াল মাদ্রিদের সামনে থেকে লীগ শেষ করেছে রোজিব্ল্যাঙ্কসরা।
গত মৌসুমের চেয়ে আরও দুর্ধর্ষ রূপে ফিরবে সিমিওনের শীষ্যরা- এই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই তারা দিয়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে লাভজনক ট্রান্সফার উইন্ডো কাটাচ্ছে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ। দলের বয়স্ক তিন ফুটবলার বিদায় নিয়েছেন (গ্যাবি, তোরেস ও গ্যামেরো), যোগ দিয়েছেন কিছু উদীয়মান তরুণ তারকা। লেমার, গ্যালসন মার্টিনস, রদ্রি, আরিয়াসরা দলকে নিঃসন্দেহে আরও ভারসাম্য দেবেন, দেবেন ক্ষিপ্রতা।
এই মৌসুমে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের জন্য সবচেয়ে বড় সুসংবাদ সম্ভবত গ্রিজমানের থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা। অনেক জল্পনা কল্পনার পর ‘লা ডিসিশন’ নামে একটি ডকুমেন্টারি বানিয়ে ক্লাবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়াটা নিঃসন্দেহে ক্লাব ও ক্লাবের ফ্যানদের জন্য মৌসুমের সবচেয়ে বড় সুসংবাদ ছিল।
নিজের পছন্দমতো সব খেলোয়াড়কেই পেয়েছেন সিমিওনে। এখন তার পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হচ্ছে তাদের সবাইকে তার ধরনের সাথে মানিয়ে নেয়া। মৌসুমের শুরুটা তাই হয়তো মূল একাদশে কারা খেলবে সেটা নিয়ে পরীক্ষা করতেই যাবে। তবে সিমিওনের অ্যাথলেটিকোকে আমরা যতটুকু জেনেছি, তা থেকে অন্তত এই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন, দল যেমনই থাকুক, ম্যাচ যত কম গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে এক সেকেন্ডের জন্যও ছাড় দিয়ে খেলবে না প্রলেতারিয়েত মাদ্রিদ। আর উপলক্ষটা যখন উয়েফা সুপার কাপ, তখন আজ নিশ্চিতভাবেই সর্বস্ব দিয়ে খেলবে লাল-সাদা শিবির। সিমিওনের কণ্ঠেও তারই প্রতিধ্বনি,
“দলে ভালো খেলোয়াড়দের আগমন আপনাকে ভালো ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের গ্যারান্টি দেবে, দলীয় পারফর্মেন্স না। সুতরাং, দল হিসেবে ভালো করতে হলে একই পথে এগোতে হবে।
এটা সত্য যে আমাদের দুই দলের বাজেট সমান না। কিন্তু অন্তর্শক্তির দিক দিয়ে আমরা কখনোই নিজেদের কোনো দলের নিচে অনুভব করি না।
এই ম্যাচ থেকে আমরা যা আদায় করতে চাই তা আদায় করার জন্য যা দরকার সব করবো আমরা।”
৪.
লোপেতেগির হাত ধরে রিয়াল হয়তো তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টিকিটাকা ফুটবল খেলা শুরু করতে পারে। আরেকটি ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছিল, লোপেতেগির মাদ্রিদ হয়তো হতে যাচ্ছে ইস্কো কেন্দ্রিক। রোনালদো থাকাকালীন সময়ে দলের কিছুটা নিন্দিত চরিত্র ইস্কোর কাছেই বর্তাবে রিয়ালের আক্রমণভাগের দায়ভার। দলের আক্রমণে সবচেয়ে বড় শক্তি অবশ্য ওয়েলস তারকা গ্যারেথ বেল। রোনালদোর শূন্যতা পূরণের জন্য আপাতত তার দিকেই তাকিয়ে থাকবে মাদ্রিদ শিবির।
রোনালদোত্তর যুগের প্রথম প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলতে নামছে রিয়াল মাদ্রিদ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ৫ বার ব্যালন ডি’অর জয়ীর শূন্যতা ভালোভাবেই অনুভব করবে তারা। আজ দলে অভিষেক হতে পারে তরুণ স্ট্রাইকার ভিনিশাস জুনিয়রের।
অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের একাদশ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা করা যাচ্ছে না। লেমার, রদ্রি, আরিয়াস, গ্যালসন মার্টিনস, কালিনিচের যে কেউ জায়গা করে নিতে পারেন একাদশে। কোচ সিমিওনের কণ্ঠেও যেন তারই অনুরণন, “যারা এস্তোনিয়ায় এসেছে, কালকে (আজকে) বিকালের আগপর্যন্ত তাদের কেউই জানবে না শুরুর একাদশে কারা থাকছে।”
সম্ভাব্য একাদশ
রিয়াল মাদ্রিদ – নাভাস, কারভাহাল, রামোস, ভারান, ক্যাসেমিরো, ক্রুস, বেল, ইস্কো, অ্যাসেনসিও ও বেনজেমা।
অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ – ওবলাক, হুয়ানফ্রান, গডিন, হিমনেজ/স্যাভিচ, ফিলিপে লুইস/হার্নান্দেজ, লেমার, টমাস পার্টে, কোকে, সাউল, গ্রিজমান ও কস্তা।
৫.
- ৪৩ বছর পর উয়েফা সুপার কাপ খেলছে একই শহরের দুই দল।
- এবার সহ গত পাঁচ বছরে চারবারই উয়েফা সুপার ট্রফি ঘরে তুলতে যাচ্ছে স্প্যানিশ কোনো দল।
- রিয়াল মাদ্রিদ এর আগে উয়েফা সুপার কাপে অংশগ্রহণ করেছে ছয়বার, যার মধ্যে চারবারই জয়লাভ করেছে।
- আজকে জিতলে রিয়াল মাদ্রিদ ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে টানা তিনটি সুপার কাপ ঘরে তুলবে।
- অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ তাদের দুবারের সুপার কাপ মিশনে দুবারই জয়ী হয়েছে।
- আজকে জিতলে অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ ইতিহাসের প্রথম দল হিসেবে তিনবারের তিনবারই সুপার কাপ জেতার রেকর্ড করবে।