ফিরে দেখা রাশিয়া বিশ্বকাপ

দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো বিশ্বকাপ। তারপরও রয়ে গেলো কিছু স্মৃতি। সেই সব স্মৃতি থেকে কিছু টুকরো টুকরো মনে করার চেষ্টা আমাদের।

আর্জেন্টিনা

লিওনেল মেসি হয়তো টেনেটুনে আরেকটা বিশ্বকাপ খেলবে পারবেন। কিন্তু সেরা ফর্মে থাকা অবস্থায় বিশ্বকাপ জয়ের এটাই ছিলো শেষ সুযোগ। আগেরবার দলকে ফাইনালে তুলেছিলেন, এবার স্বপ্ন ছিলো বিশ্বকাপ ট্রফিটা স্পর্শ করার। কিন্তু টুর্নামেন্টের শুরু থেকে আর্জেন্টিনাকে দেখে কখনোই মনে হয়নি, তারা কিছু জিততে এসেছে। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ড্র ও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে পরাজয়ে প্রথম রাউন্ড থেকেই বাদ পড়তে গিয়েছিলো। পরে কষ্টে দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠলেও সেখান থেকে আর এগোতে পারেনি তারা। সেই সাথে কোচের সাথে বিবাদ, মেসির অতি কর্তৃত্ব, নানা ধরনের ঝামেলার খবরও ছিলো দলটিকে নিয়ে।

পড়ে গিয়ে কাতরাচ্ছেন নেইমার; Image Source: EPA

ব্রাজিল

ব্রাজিল এবার বিশ্বকাপে এসেছিলো ‘হেক্সা’ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে। তাদের সেরকম ভারসাম্যপূর্ণ একটা দলও ছিলো। কিন্তু সেভাবে জ্বলে উঠতে পারলো না ব্রাজিল। একটা ম্যাচে অন্তত ব্রাজিলকে সেই সাম্বার ছন্দে দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুন অধারাবাহিক ছিলো এই দলটা। সাথে ছিলো নেইমারকে নিয়ে সমালোচনা। মাত্রই ইনজুরি কাটিয়ে মাঠে ফেরা নেইমার শিকার হয়েছেন অনেক ফাউলের। সেই সাথে তাকে সামান্য ফাউল করা হলেও অতি নাটকীয় প্রতিক্রিয়া দেখানোতে সমালোচনা হয়েছে এই পিএসজি তারকার। তবে টুর্নামেন্টে নিজেকে দারুনভাবে মেলে ধরেছিলেন কৌতিনহো। ‍শেষাবধি কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামের বিপক্ষে হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে।  

বেলজিয়াম

এই নিয়ে টানা দ্বিতীয় বিশ্বকাপ খেললো বেলজিয়ামের সোনালী প্রজন্ম। ২০১৪ বিশ্বকাপে তাদের যাত্রা থেমে গিয়েছিলো কোয়ার্টার ফাইনালে। এবার স্বপ্নটা বড় ছিলো। সেই অনুযায়ী সেমিফাইনালেও উঠেছিলো। লোকেরা তখনই বেলজিয়ামের এই সোনালী দলটাকে ফাইনালে দেখতে পাচ্ছিলো। কিন্তু ফ্রান্সের বিশ্বজয়ী দলের সাথে তারা পেরে ওঠেনি। বিদায় নিতে হয়েছে সেরা চার থেকে। পরে অবশ্য ইংল্যান্ডকে হারিয়ে তৃতীয় হয়েছে তারা।

চ্যাম্পিয়নদের অভিশাপ

এই নিয়ে গত পাঁচ আসরে চারবার আগের আসরের চ্যাম্পিয়ন দল প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিলো। অথচ জার্মানি প্রথম পর্ব থেকে বিদায় নেওয়ার মতো দল ছিলো না। তারা বিশ্বকাপ ধরে রাখতেই গিয়েছিলো রাশিয়ায়। অনেকেরই ফেবারিটের তালিকায় ছিলো এই দলটি। কিন্তু প্রথম ম্যাচেই মেক্সিকোর বিপক্ষে হেরে বিপাকে পড়ে গেলো জার্মানরা। এরপর সুইডেনের বিপক্ষে জিতলেও শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে করুণভাবে বিদায় নিলো জার্মানরা।

দেশম

আট বছর আগে রেমন্ড ডমেনেখের অধীনে বিশ্বকাপে যাওয়া দল বিদ্রোহ করেছিলো। এবার দেশম শুরু থেকেই নিজের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছিলেন। তবে তার জন্য ট্রফি জেতার কোনো বিকল্প ছিলো না। দুই বছর আগে ইউরো ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে হারের অভিশাপ নিয়ে চলতে হচ্ছিলো দেশমকে। সেই অভিশাপকে পিছু ছাড়ালেন। বিশ্বের মাত্র তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে কোচ ও খেলোয়াড় দুই ভূমিকাতেই জিতলেন বিশ্বকাপ। অধিনায়ক ও খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপ জেতা মাত্র দ্বিতীয় মানুষ দিদিয়ের দেশম।

ইংল্যান্ড

ইংল্যান্ড দলকে নিয়ে এবার শুরুতে খুব একটা হাইপ ছিলো না। এই দলটাকে নিয়ে প্রত্যাশা কম ছিলো। কিন্তু টুর্নামেন্ট শুরু হলে অধিনায়ক হ্যারি কেইন ও তার দল জ্বলে উঠলো। তরতর করে চলে গেলো সেমিফাইনালে। ১৯৯০ সালের পর এটা ছিলো ইংল্যান্ডের প্রথম সেমিফাইনাল। সেমিফাইনালে ওঠা ইংল্যান্ডকে নিয়ে শুরু হলো দেশে মারাত্মক শোরগোল, ‘ইটস কামিং হোম‘। কিন্তু শেষাবধি ইংল্যান্ড ট্রফি ছাড়াই বাড়ি ফিরলো সেমিফাইনাল থেকে।

ফেয়ার প্লে নিয়ম

এবার বিশ্বকাপ দেখলো এই অভিনব আইন। গ্রুপপর্বে জাপান ও সেনেগালের পয়েন্ট ছিলো একই। কিন্তু দু’দলের যেকোনো এক দল যেতে পারবে পরের রাউন্ডে। এমন অবস্থায় দুই দলের গোল পার্থক্যও এক, এমনকি হেড টু হেড দিয়েও ফল আসছে না। তখন ফিফার ফেয়ার প্লে আইন প্রয়োগ করা হলো। যেহেতু সেনেগালের ৬টি হলুদ কার্ড ছিলো ও জাপানের ছিলো ৪টি। তাই এই আইনে জাপান এগিয়ে গেলো পরের রাউন্ডে।

গোল্ডেন বুট কেনের; Image Source: Getti

হ্যারি কেন

এবার বিশ্বকাপের গোল্ডেন বুট জিতলেন ইংল্যান্ডের এই অধিনায়ক। গোল সংখ্যা আটকে রইলো প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে পাওয়া সেই ৬ গোলেই। পরের পর্বগুলোতে আর গোলের দেখা পাননি ইংলিশ এই স্ট্রাইকার। তারপরও তাকে টপকে যেতে পারেননি অন্য কোনো তারকা।

কাজান

এবার বিশ্বকাপের বধ্যভূমি হয়ে উঠলো রাশিয়ার এই ক্রীড়া রাজধানী। এখানে এসেই একে একে পতন ঘটলো সব মহীরূহের। প্রথম এই কাজান থেকে বিদায় নিলো জার্মানি। এখানে তারা হেরেছিলো দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে। এরপর আর্জেন্টিনা এখানে দ্বিতীয় রাউন্ডে ফ্রান্সের বিপক্ষে ৪-৩ গোলে হেরে বিদায় নিলো। আর শেষ অবধি এখান থেকে বিদায় নিলো ব্রাজিলও। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা বেলজিয়ামের বিপক্ষে হারলো ২-১ গোলে।

বিশ্বকাপ হাতে এমবাপে; Image Source: Rueters

এমবাপে

বিশ্বকাপের সবচেয়ে আকর্ষণীয় খেলোয়াড় হতে পারতেন মেসি, রোনালদো বা নেইমার। কিন্তু এদের ছাপিয়ে গেলেন ১৯ বছর বয়সী কিলিয়ান এমবাপে। সদ্য কৈশোর পার হওয়া এই ফরাসি তারকা ফাইনালেও এক গোল করলেন। পাশাপাশি পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুন খেলার পুরষ্কার হিসেবে পেলেন সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের তকমা। এবারের আসরকে বলা হচ্ছে এমবাপের উঠে আসার আসর।

লোপেতেগে-কাণ্ড

স্পেন এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটালো। বিশ্বকাপ শুরুর একদিন আগে বরখাস্ত করে বসলো তাদের কোচ হুলিয়েন লোপেতেগেকে। ঘটনার শুরু করেছিলো রিয়াল মাদ্রিদ। বিশ্বকাপ শুরুর দুদিন আগে তারা লোপেতেগেকে নিজেদের নতুন কোচ হিসেবে ঘোষণা করে। তারা জানায় যে, বিশ্বকাপের পরে দায়িত্ব নেবেন তিনি। কিন্তু এই ঘটনাকে ফেডারেশনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে নেয় স্প্যানিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। তাদের সভাপতি রুবিয়েলেস পরদিনই সংবাদ সম্মেলন করে বরখাস্ত করেন লোপেতেগেকে। তার বদলে বিশ্বকাপে দায়িত্ব পালন করেন ফার্নান্দো হিয়েরো। তার অভিজ্ঞতাটাও সুখের হয়নি। রাশিয়ার বিপক্ষে পেনাল্টিতে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় তার দল স্পেন।

আত্মঘাতী গোল

এবার বিশ্বকাপে যেন আত্মঘাতী গোলের উৎসব হয়েছে। এর আগে কোনো বিশ্বকাপে এত বেশি আত্মঘাতী গোল দেখা যায়নি। এবার সব মিলিয়ে ১২টি আত্মঘাতী গোল হয়েছে। এর মধ্যে ফাইনালেও হয়েছে একটি। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এই প্রথম ফাইনালে আত্মঘাতী গোল হয়েছে।

রাশিয়া

রাশিয়ার জন্য এই টুর্নামেন্ট ছিলো মাঠে ও মাঠের বাইরে জবাব দেওয়ার এক টুর্নামেন্ট। মাঠে তাদের নিয়ে সমালোচনা ছিলো আয়োজক না হলে বিশ্বকাপই খেলতে পারতো না তারা। টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বেশি র‌্যাংকিংয়ে থাকা দল ছিলো রাশিয়া। মাঠে এই ব্যাপারটার জবাব দিলো তারা দারুনভাবে। তরতর করে দ্বিতীয় রাউন্ডে গেলো। সেখানে স্পেনকে হারিয়ে চলে গেলো কোয়ার্টার ফাইনালে। শেষ অবধি রাশিয়ার মাঠের অভিযান শেষ হলো কোয়ার্টার ফাইনালে পেনাল্টি শুটআউটে ক্রোয়েশিয়ার কাছে হেরে। আবার অন্যদিকে সমালোচনা ছিলো, আয়োজক হিসেবে রাশিয়া ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। বলা হচ্ছিলো, সন্ত্রাস ও সহিংসতার ব্যাপক সম্ভাবনা আছে বিশ্বকাপে। কিন্তু সব আশঙ্কা দূর করে অত্যন্ত সফলতার সাথে শেষ হয়েছে বিশ্বকাপ।

সেরা খেলোয়াড় মদ্রিচ; Image Source: FIFA

লুকা মদ্রিচ

মাথার ওপর এখনও তার শাস্তির হুমকি ঝুলছে। সাবেক ক্রোয়েশিয়ান ফুটবল কর্মকর্তা মামিচের হয়ে আদালতে মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার অপরাধে ফেঁসে যেতে পারেন তিনি। তারপরও কোনো উত্তেজনা নেই, কোনো মেজাজ হারিয়ে ফেলা নেই। তারপরও দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ফাইনালে নিয়ে এলেন এবং টুর্নামেন্ট জুড়ে অসাধারণ খেলার পুরস্কার হাতে তুলে নিলেন সেই লুকা মদ্রিচ। বিশ্বকাপে নিজে দুই গোল করার পাশাপাশি তিনবার ম্যাচসেরা হয়েছিলেন। আর তারই সম্মিলিত পুরস্কার হিসেবে টুর্নামেন্ট শেষে গোল্ডেন বল পেলেন ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক।

ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারি

ফিফা নতুন প্রযুক্তিকে সহজে আমলে নেয় না। অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর তারা গোললাইন টেকনোলজিকে নিজেদের করে নিয়েছে। সে তুলনায় ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কপাল ভালো। দ্রুত বিশ্বকাপে ঠাই পেয়ে গেছে এই প্রযুক্তি। এবার বিশ্বকাপেই প্রথম দেখা গেলো এই প্রযুক্তি। এর ফলে পেনাল্টি দেওয়ার হার অনেক বেড়েছে। আবার সমালোচনাও ছিলো অনেক। কোনো কোনো সমালোচক বলেছেন, এটা স্রেফ অনেক টাকা খরচ করে বিভ্রান্তি বাড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়। আবার ফিফা বলেছে, নব্বই শতাংশের ওপরে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভিএআর সঠিক ছিলো। তাই তারা সন্তুষ্ট এই ব্যবস্থা নিয়ে।

Related Articles

Exit mobile version