“পৃথিবী একটি বই, আর যারা ভ্রমণ করে না তারা বইটি পড়তে পারে না”– হিপোদের বিশপ খ্যাত সেইন্ট অগাস্টিন এখানে যে বইয়ের কথা বলছেন, মহামারির এই সময়ে সেই বইয়ের পাঠ মোটামুটি বন্ধই রয়েছে বলা চলে। এমন কোনো শিল্প নেই কিংবা অর্থনীতির এমন কোনো শাখা নেই যেখানে মহামারির আঁচড় বসেনি। আর যে শিল্প গড়ে উঠেছে ঘরছাড়া মানুষের অজানাকে দেখার আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করে, কিংবা প্রয়োজনের খাতিরে ভীনদেশে পাড়ি জমানোকে পুঁজি করে, সেই শাখার ওপর করোনার আগ্রাসন কোনো অংশেই কম হওয়ার কথা নয়।
‘ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিল’-এর মতে, হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন ব্যবস্থা- সব কিছু মিলিয়ে ভ্রমণ খাতের অন্তত প্রায় একশ মিলিয়ন কর্মসংস্থান করোনার দাবানলে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বা যাবে। নভেম্বর-ডিসেম্বরের পর থেকে বাতিল করে দেওয়া ছুটি কাটানোর পরিকল্পনা, ব্যবসায়িক সফর কিংবা পারিবারিক পুনর্মিলনীগুলোর দিকে তাকালে ভ্রমণখাতের ক্রমাগত নিম্নমুখী যাত্রা আপনার চোখে পড়তে বাধ্য। সেই সাথে বারংবার লকডাউন বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত এই খোলা-এই বন্ধের দোলাচলে ভ্রমণ খাতের ক্ষতটা একটু বেশিই। আর তাই ধারণা করা হচ্ছে যে, মহামারির অবসান ঘটলেও এই খাতে তা রেখে যাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের ছাপ। রয়্যাল ক্যারিবিয়ান ক্রুজের প্রধান নির্বাহী যেমনটি বলেছেন,
ভ্রমণ ও পর্যটন আবার সমৃদ্ধ হবে কিন্তু পূর্বের অবস্থায় ফিরে গিয়ে নয়। বরং নতুন পৃথিবীর নতুন নিয়মগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে, সামঞ্জস্য রেখে এই খাতকে এগিয়ে যেতে হবে।
মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, চৌদ্দ দিন কোয়ারেন্টিন- এরকম নিয়মগুলোর সাথে সাথে ভ্রমণখাতের স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তনগুলো আসলে কীভাবে হচ্ছে চলুন দেখে নিই।
বিমান সংস্থাগুলো কি পারবে নিরাপত্তার পাশাপাশি লাভের অংশটিও নিশ্চিত করতে?
সম্প্রতি ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ধীরে ধীরে তুলে নেওয়া হচ্ছে, খুলতে শুরু করেছে আন্তর্জাতিক সীমান্তগুলো। মহামারি শুরুর পর থেকে স্বল্প পরিসরে উড়োজাহাজ চলাচল শুরু হলেও ভেতরকার চিত্রটি আমাদের সবারই জানা। নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর এক-দুই আসন খালি রেখে যাত্রীদের জন্য সীমিত পরিসরে আসন সংখ্যা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিমান সংস্থাগুলোকে তাদের ‘ব্রেক ইভেন লোড ফ্যাক্টর’ এর ঘাটতি পূরণে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
সহজ করে বলতে গেলে, ‘ব্রেক ইভেন লোড ফ্যাক্টর’ হলো প্রতি ফ্লাইটে প্রচলিত ভাড়াতে গড়ে যতগুলো আসন পূরণ হলে উড়োজাহাজ পরিচালনার খরচ উঠে আসে। অধিকাংশ বিমান সংস্থার ক্ষেত্রে এই ফ্যাক্টর হতে হয় ৭৫-৮০ শতাংশ। কিন্তু বর্তমানে তা ৫৫-৬০ শতাংশে নেমে এসেছে, সেই সাথে অভ্যন্তরীণ বাড়তি পরিচ্ছন্নতা, মনিটরিং, স্বাস্থ্য পরীক্ষা এসব কিছু মিলিয়ে খরচ বাড়ছে বৈ কমছে না। এতে টিকে থাকার লড়াইয়ে ছোটখাট সংস্থাগুলোকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে, একইসাথে বাড়ছে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এমন সীমিত আকারে যাত্রী পরিবহন ঠিক কতদিন সম্ভব হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এমন এক সময় আসবে যখন প্রয়োজনের তাগিদেই মানুষের চাপ বাড়তে শুরু করবে। তাই ভবিষ্যতের পরিবর্তনগুলো অনেকটা আন্দাজ করা যাচ্ছে। যাত্রীদের সর্বোচ্চ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে থার্মাল ইমেজিং ক্যামেরা, নিরাপত্তা পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে রোবট চালিত বা ‘টাচ-লেস’ প্রযুক্তির ব্যবহার, প্রবেশ কিংবা বহির্গমনের পথগুলো প্রশস্ত করা, বায়োমেট্রিক স্ক্রিনিংসহ এমনই অনেক সময়োপযোগী নতুন পরিবর্তন নিয়ে সংস্থাগুলো নতুন গাইডলাইন ইতোমধ্যেই প্রচার করতে শুরু করেছে।
কোনো কোনো দেশে আবার ভ্রমণের অনুমতি পাওয়ার আগে দেখিয়ে নিতে হচ্ছে ভ্রমণকারীর করোনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে কি না। দুবাইয়ের কয়েকটি বিমানসংস্থা নিজস্ব উদ্যোগে ভ্রমণের আগে সীমিত আকারে যাত্রীদের করোনা পরীক্ষার সুযোগ করে দিয়েছে, যেখানে দশ মিনিটের মাঝেই মিলছে ফলাফল। হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এমন একধরনের যন্ত্রের ব্যবহার চালু হয়েছে যাতে মাত্র চল্লিশ সেকেন্ডের ভেতর একজন যাত্রীর পুরো শরীরে স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক দ্রব্য ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে উড়োজাহাজের সাধারণ ফ্রেশরুম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা এবং যথাসম্ভব কম ব্যাগ ও মালপত্র বহন করতে বলা হচ্ছে। ভ্রমণ শুরুর আগে হাস্যোজ্জ্বল বিমানবালাদের সুমিষ্ট হাসি হয়তো ঢাকা পড়ে যাবে মাস্কের আড়ালে, কিংবা ভবিষ্যতে পিপিই পরিহিত বিমানবালাদের দেখলেও অবাক হবেন না যেন।
সাধারণভাবে দেখা যায়, ভ্রমণের মৌসুমে অন্যান সময়ের তুলনায় বিমান ভাড়া একটু বেশি থাকে। কিন্তু এখন ধারণা করা হচ্ছে, যাত্রী সংখ্যা কম থাকলেও সব কিছু মিলিয়ে খরচ মেটাতে ভাড়া কমানো সম্ভব হবে না। হতে পারে, ‘ইকোনমি ক্লাসে’র যাত্রীদের ক্ষেত্রে মূল্যছাড় থাকলেও ‘বিজনেস ক্লাস’ যাত্রীদের ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়িয়ে সামঞ্জস্য আনা হবে। সব মিলিয়ে আনুমানিক ২০২২ সাল নাগাদ হয়তো করোনার ঘা বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে বিমান সংস্থাগুলোকে।
সাবধানী ভ্রমণকারীরা থাকবেন বাড়ির কাছাকাছি
ম্যাথিউ কার্স্টেন বলেছিলেন, “ভ্রমণের জন্য বিনিয়োগ হলো নিজের জন্য বিনিয়োগ”। আর তাই নতুন প্রাণশক্তি সঞ্চারের আশায় কিংবা মুক্ত জীবনের স্বাদ পেতে ভ্রমণপিপাসুরা ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে বেরোবেন ঠিকই, তবে গন্তব্যস্থল হিসেবে বেছে নেবেন বাড়ির কাছেরই কোনো নিরাপদ স্থান।
বুকিং সাইট ট্রাভেলোসিটি-র তথ্যানুসারে, এই সময়ে তারা যতগুলো ভ্রমণের বুকিং পেয়েছে, তার বেশিরভাগই ভ্রমণকারীদের বাড়ির ঠিকানার একশো মাইলের মধ্যে। ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স কম্প্যারিসন সাইট ‘স্কয়ারমাউথ’-এর পরিসংখ্যানে এপ্রিল ১ থেকে মে ১০ এর মধ্যে যতগুলো ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স পলিসি কেনা হয়েছে তার প্রায় ৪৮ শতাংশই অভ্যন্তরীণ ট্রিপের জন্য, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১৫ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক ভ্রমণের চেয়ে বাড়ির কাছের রোড ট্রিপ, ট্রেকিং বা ‘ব্যাকপ্যাকিং’- এমন রোমাঞ্চকর ভ্রমণগুলোতে মানুষের আকর্ষণ এখন তুলনামূলক বেশি। আর বলা বাহুল্য, তাদের ‘ব্যাকপ্যাক’-এর অনেকখানি জায়গা দখল করে নেবে সাবান, স্যানিটাইজার, মাস্ক বা শিল্ড।
ঢাকা থেকে সিলেট ভ্রমণে হয়তো নিষেধাজ্ঞা থাকবে না, কিন্তু ঢাকা থেকে অরূণাচল ভ্রমণের ক্ষেত্রে আপনাকে অবশ্যই দেখাতে হবে স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট কিংবা নিতে হবে বাড়তি কোনো অনুমতি। একইসাথে ‘সেইফ জোন’গুলোতে ভ্রমণের অনুমতি মিললেও করোনার উত্তাল তরঙ্গে নিমজ্জিত রাষ্ট্রগুলোতে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ চালু করতে নিঃসন্দেহে বেশ ঝামেলা পোহাতে হবে।
ভাবুন তো, ইন্দোনেশিয়ার বালি বা আমাদের দেশেরই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কথা, কেমন হবে যদি সাগর পাড়ে প্লেক্সিগ্লাস দিয়ে কুঠুরির মতো অংশ আলাদা করা হয় পর্যটকদের সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার জন্য? এমন চিত্রগুলোই হয়তো হবে ভবিষ্যতের ভ্রমণের স্বাভাবিক অবস্থা। অন্যদিকে এমন ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে বেশিরভাগই হবে তরুণ, যেমনটি এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়- প্রতি বছর আন্তর্জাতিক ভ্রমণের এক-চতুর্থাংশই থাকে তরুণদের দখলে, সংখ্যাটি প্রায় ৩৭০ মিলিয়নের কাছাকাছি।
বিদেশ ভ্রমণের খরচ কি তবে বেড়ে যাবে?
ইউনাইটেড ন্যাশনস ওরার্ল্ড ট্যুরিজম অর্গানাইজেশনের মতে, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবকিছু মিলিয়ে ২০২০ সালে ক্ষতি গুণতে হতে পারে ৯১০ বিলিয়ন থেকে ১.২ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই সংখ্যাটি নির্ভর করবে ঠিক কখন পর্যটকদের জন্য পৃথিবীর দরজাগুলো আগের মতো স্বাভাবিকভাবে খুলবে তার ওপর। অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবে উড়োজাহাজের ভাড়া নির্ধারিত হয় প্রতি মাইলে তার খরচের ওপর, সেদিক থেকে যাত্রী সংখ্যা কম হলে প্রতি মাইলে খরচ কমে যায়, ফলে ভাড়াও কম হয়। কিন্তু মহামারির ধাক্কা সামলাতে গিয়ে এই নিয়মের ব্যতিক্রম হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। ইউরোপীয়ান ট্রাভেল এক্সপার্ট রিক স্টিভসের মতে, এক্ষেত্রে গুণতে হতে পারে স্বাভাবিকের চেয়ে দুই গুণ বেশি ভাড়া।
এমন ভাড়া প্রদানের সামর্থ্য হয়তো সবার থাকবে না, তাই কে জানে ভবিষ্যতে বিদেশ ভ্রমণ হয়তো কেবল হবে শুধুমাত্র ধনিক শ্রেণীর জন্য।
একইসাথে যেসব রেস্তোরাঁ বা হোটেলগুলো টিকে থাকে পর্যটনের আয় দিয়ে তাদেরও হয়তোবা তল্পিতল্পা গুটিয়ে অন্য কিছু শুরু করতে হবে। ইতোমধ্যেই এমন অনেকেই কিন্তু সুপার-শপ বা অনলাইনে খাবার সরবরাহকারী হিসেবে সে খাতায় নাম লিখিয়েছে, কারণ তাদের লভ্যাংশের এক শতাংশও উঠে আসছে না, উপরন্তু গুণতে হচ্ছে কর্মচারীদের বেতন আর জায়গার ভাড়া। যারা টিকে থাকবে তারাও হয়তো উর্ধ্বগামী কলম চালাবে নির্ধারিত মূল্য-তালিকায়। আর সবচেয়ে বড় কথা, সামাজিক দূরত্বের চাদরে হারিয়ে যাবে সেসব জায়গাগুলোর প্রাণখোলা আড্ডা কিংবা হৈ হৈ-রৈ রৈ ব্যাপারগুলো। সব মিলিয়ে, বিদেশ ভ্রমণের খরচ আগের তুলনায় বেশিই হবে, তবে আশার কথা আপনি যদি অনেক বড় দল নিয়ে ভ্রমণ করেন তবে মাথাপিছু খরচ কিছুটা হলেও কমতে পারে।
চলুন একটু ঘুরে আসি জনাকীর্ণ পার্ক বা পর্যটন-স্থানগুলোতে
ভাবুন তো ডিজনির থিম পার্ক, ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়াম কিংবা আমাদের দেশেরই নন্দন পার্ক বা ফ্যান্টাসি কিংডমের কথা। ভাবতে পারেন পুনরায় খুলে দেওয়া হলে কেমন হবে চিত্রটি? ওয়াল্ট ডিজনি জুলাই মাসের ১১ তারিখে তাদের ফ্লোরিডা পার্কের একটি অংশ চালু করার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে একটি বক্তব্যে জানায়,
এই অসময়ে পার্কের একটি অংশ পুনরায় চালু করতে গিয়ে আমাদের অনেক নতুন পরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে, সকলের পরিচিত রূপ থেকে থিম পার্কের নতুন এই রূপ বেশ ভিন্ন।
স্ক্রিনিং, মনিটরিং, নির্দিষ্ট দূরত্বে লাইনে দাঁড়ানো এসব তো এখন সাধারণ জীবনযাত্রারই অংশ। সেই সাথে আনা হচ্ছে অনলাইনে টিকিট মনিটরিং ব্যবস্থা, যেন একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি মানুষ এসব স্থানে ঢুকতে না পারে। আতশবাজির কারসাজি, ঝর্ণার নৃত্য বা এমনই আকর্ষণীয় শো-গুলো দেখানো হবে ভার্চুয়ালি, যেমনভাবে ‘সি-ওয়ার্ল্ড ওরল্যান্ডো’ তাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘এনিম্যাল ইন্টারেকশন’ অংশে বেশ ভালই পরিবর্তন আনছে। ভেতরে হয়তো সাধারণ পর্যটকের তুলনায় পরিচ্ছন্নতা বা মনিটরিংয়ের কাজে নিয়োজিত কর্মীদেরই বেশি দেখা যাবে।
প্রমোদতরীগুলোর খবর কী?
ঝাঁ-চকচকে ‘ক্রুজ শিপ’ বা প্রমোদতরীগুলোর প্রতি ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণ বরাবরই একটু বেশি। তাই মার্চের মাঝামাঝি থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া এই জাহাজগুলো আবার কবে সমুদ্রে ফিরবে তা জানতে বেশ উৎকণ্ঠিত সেসব পর্যটকেরা যারা মহামারি শুরুর আগে নিজেদের আসনটি সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। একটি জাহাজে হাজার হাজার মানুষের সমাগম হতে পারে করোনা সংক্রমণের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র। তাই খুব তাড়াতাড়িই জাহাজগুলোর সাগরে ফেরার আশা নেই।
ভবিষ্যতে চালু হলেও আসন সংখ্যা হবে সীমিত, হারিয়ে যাবে ‘ডিশ-ইট-ইওরসেলফ বাফে’, পুলের পাড়ে সংগীতায়জন বা এ ধরনের ব্যাপারগুলো। ক্ষণে ক্ষণে চলবে তাপমাত্রার পরীক্ষা, চালু হবে নতুন নতুন সংক্রমণ নিরোধক নিয়মাবলি, জাহাজে থাকাকালে কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার জন্য পৃথক স্বাস্থ্যসেবা এবং কোয়ারেন্টিন রুম, মেডিক্যাল গ্রেডেড এয়ার ফিল্টার- এমনই আরো কত আয়োজন! অন্যদিকে নতুন করে এমন প্রমোদতরী নির্মাণের কাজ অবশ্যই খুব সহজে শুরু হচ্ছে না এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বাড়বে ব্যক্তিগত আয়োজন এবং হোম-স্টে’র চাহিদা
লকডাউনের এই সময়গুলোতে আমরা এখন অনেকটাই বুঝে গেছি যে বেশিরভাগ প্রয়োজনীয় কাজই আসলে বাড়িতে বসে করা সম্ভব। তাই আরাম বা আনন্দের মধ্য দিয়ে কাজ করার একটি নতুন প্রবণতাও আমাদের মাঝে তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার এই সময়ে স্কাইপ, জুম বা বিভিন্ন অডিও-ভিডিও প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার আমাদের মূলত দশ বছর এগিয়ে নিয়ে গেলো। সব কিছু মিলিয়ে নতুন এই অভিজ্ঞতা বুঝিয়ে দিয়েছে ভ্রমণ এবং কাজ যেমন একইসাথে করা সম্ভব, তেমনিভাবে কেউ কেউ চাইলে নিজের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য অফিস বা বাড়ি থেকে দূরে কোনো নির্জন নতুন স্থানে প্রকৃতির কাছাকাছি গিয়ে কাটাতে পারেন অনেকখানি সময়।
তাই তো এয়ারবিএনবি তাদের ওয়েবসাইটের হোম-পেইজে এপ্রিল মাস থেকে ‘মান্থলি স্টে’ অর্থাৎ পুরো একমাস ভাড়া নিয়ে থাকতে আগ্রহী কি না- এমন একটি নতুন একটি ফিচার যুক্ত করেছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, করোনাকালে দীর্ঘ-মেয়াদী বুকিংয়ের সংখ্যাই এখন সবচেয়ে বেশি, যা ভ্রমণকারীদের নতুন এই প্রবণতাকেই নির্দেশ করছে। আর একইসাথে সংক্রমণের কথা মাথায় রেখে বেশিরভাগই হোটেলের বদলে হোম-স্টে’কে বেছে নিচ্ছেন, যেখানে নিজের মতো করে থাকা-খাওয়া আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা যাবে। এদিক থেকে যারা বাসা বা একটি কক্ষ ভাড়া দিচ্ছেন তাদেরও আয় বাড়ছে, ভ্রমণকারীরাও স্বচ্ছন্দে থাকতে পারছেন দীর্ঘদিন।
এয়ারবিএনবি’র মতো এমন ওয়েবসাইটগুলো পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে যোগ করছে নতুন করে পরিচ্ছন্নতার নিয়মাবলি। মানুষ এখন ভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিকে বেশি সচেতন। শেষ কয়েক মাসে বাইরের দেশগুলোতে ‘প্রাইভেট ভিলা’, ‘প্রাইভেট ফ্লাইট, ‘প্রাইভেট আইল্যান্ড’ এমন ব্যক্তিগত বুকিং এর সংখ্যা বেশি দেখা গেছে, বেড়েছে ‘প্রাইভেট জেট’ বিমান বুকিংয়ের হারও। ধারণা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে এমন ‘ট্রাভেল বুকিং সেফটি অ্যাপ’গুলোর জনপ্রিয়তাও তাই দিন দিন বাড়বে।
তবে কি দুটি ভিন্ন দিকে মোড় নেবে ভ্রমণ খাত?
মহামারির কারণে আচমকাই যেন ধ্বস নেমে এলো ভ্রমণ খাতে। একদিকে অনেকে বলছেন, জনাকীর্ণ পর্যটন স্থানগুলো এখন একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, প্রকৃতি তার ক্ষত শুকিয়ে আবার সতেজ হয়ে উঠছে, স্থানীয়রাও যেন বহুদিন পর পর্যটকদের কোলাহল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে পারছেন। অন্যদিকে ভ্রমণ খাতের এই ধ্বস বিশ্ব অর্থনীতিকে কীভাবে গুটিয়ে ফেলছে তা নিয়ে আরেকদল সন্দিহান।
‘দ্য এক্সপ্লোডিং বিজনেস অভ ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম’ এর লেখক এলিজাবেথ বেকার তাই ধারণা করছেন, কিছু রাষ্ট্র এখন পরিবেশ সংরক্ষণের কথা মাথায় রেখে ভ্রমণখাতের দিকে কম নজর দিয়ে অন্যান্য খাতের ঘাটতিগুলো পুষিয়ে নিতে চাইবে। আবার কোনো কোনো রাষ্ট্র চাইবে ভ্রমণখাতকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে, তাই হোটেল বা পর্যটন স্থানগুলো বেশি বেশি মূল্যছাড় বা বাহারি চুক্তি ছুড়ে দেবে ভ্রমণপিপাসুদের ঝুলিতে। আর এদিকে বুদ্ধিমান পর্যটকেরা এমন জায়গাই বেছে নেবেন যেখানে মিলবে উন্নত স্বাস্থ্যবিধি আর পর্যাপ্ত নিরাপত্তা।
শেষ করা যাক ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের একটি জরিপ দিয়ে। তারা জিজ্ঞাসা করেছিল, মহামারির এই সময়ে আপনি ঠিক কতদিন পর পরবর্তী ফ্লাইটটি বুকিং দিতে আগ্রহী? ৬০ শতাংশ মানুষের মতে, তাদের জন্য এই সময়কাল দুই মাস, আর ৪০ শতাংশ মানুষ বলেছিল অন্ততপক্ষে ছয় মাসের আগে নয়। সে যা-ই হোক, রবি ঠাকুর বলেছিলেন, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”। আর বিশ্বলোকের সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ভ্রমণপিপাসু মন বার বার ছুটে যাবে বহির্পানে, আর এভাবেই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে আমাদের ভ্রমণের ভবিষ্যত।