গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী বোমা হামলার পর থেকে সারা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম মাওলানা মাসুদ আজহার। তার পরিচালিত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মোহাম্মদ পুলওয়ামা হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি প্রদান করে। তবে পাকিস্তানের এই জঙ্গি সংগঠন ভারতে এবারই প্রথম হামলা করেনি। এর আগে তারা ২০০১ সালে ভারতীয় লোকসভা, ২০০৮ সালের মু্ম্বাই এবং ২০১৬ সালে পাঞ্জাবের পাঠানকোটে হামলা চালায়।
উপমহাদেশের শক্তিশালী দেশ ভারতকে একমাত্র মাসুদ আজহারই বারবার বড়সড় ধাক্কা দিয়েছেন। গত দশক থেকে তার কারণেই বেশ কয়েকবার ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। ভারত সরকারের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ ব্যক্তিদের তালিকায় সবার উপরে রয়েছে এই মাসুদ আজহার।
পুলওয়ামা হামলার পর ভারতের প্রধান লক্ষ্য যেভাবে হোক মাসুদ আজহার ও জইশ-ই-মোহাম্মদকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেওয়া। সেই লক্ষ্যে তারা পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে বিমান হামলাও চালিয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এই বিমান হামলা থেকে বড় সাফল্য পাওয়ার দাবি করলেও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এর সত্যতা পায়নি।
বর্তমানে বিজেপি সরকার ও ভারতের মাথাব্যথার প্রধান কারণ জইশ ও মাসুদ আজহার। তাকে নিকেশ অথবা আটক করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তারা। কিন্তু সফল হতে পারছে না। তবে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী যে একেবারেই ব্যর্থ তা নয়। মাসুদ আজহারকে তারা ১৯৯৪ সালে আটক করেছিল। কিন্তু পাঁচ বছর বন্দী করে রাখার পর তারা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এর পেছনে কারণ ছিল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট আইসি-৮১৪ ছিনতাই।
কেন ফ্লাইট আইসি-৮১৪ ছিনতাই করা হয়?
১৯৯৪ সালের শুরুতে মাসুদ আজহার ভুয়া পরিচয়পত্র দেখিয়ে পাকিস্তান থেকে কাশ্মীরের শ্রীনগর আসেন। তার এই সফরের উদ্দেশ্যে ছিল হরকাতুল আনসার, হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী ও হরকাতুল মুজাহিদিনের মধ্যে সৃষ্ট দ্বন্দ্বের সুরাহা করা। কিন্তু একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। জঙ্গি সংগঠনের সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে তাকে বন্দী করে ভারত সরকার।
কিন্তু এই বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি তার অনুসারী জঙ্গিরা। তারা মাসুদ আজহারকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্ন তৎপরতা শুরু করে। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৬ জন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে জঙ্গিরা। তারা নিজেদের আল ফারান হিসেবে পরিচয় দেয় এবং মাসুদ আজহারকে মুক্তির বিনিময়ে সেই ছয় বিদেশি নাগরিককে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে।
কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার তাদের এই দাবিকে প্রত্যাখান করে। পরবর্তীতে অপহৃত ৬ জনের মধ্যে একজন কোনোভাবে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। আর অন্য একজনকে শিরচ্ছেদ অবস্থায় খুঁজে পাওয়া গেলেও বাকি চারজনের কোনো খোঁজ আজও মেলেনি। মাসুদ আজহারকে মুক্ত করার জন্য আরো চেষ্টা চালায় তার অনুগত জঙ্গিরা। কিন্তু তারা বারবার ব্যর্থ হতে থাকে।
অবশেষে তারা ভারতীয় বিমান ছিনতাই করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার বিনিময়ে তারা মাসুদের মুক্তি চাইবে। পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিগামী ভারতীয় এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ছিনতাই করে। এর নেতৃত্বে ছিল হরকাতুল মুজাহিদিন।
যেভাবে বিমান ছিনতাই হয়
১৯৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর বড়দিনের ঠিক আগমুহূর্তে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ৮১৪ (আইসি-৮১৪ নামে অধিক পরিচিত) নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে উড্ডয়ন করে। উড়োজাহাজটি ছিল এয়ারবাস এ৩০০ মডেলের। এতে মোট ১৭৬ জন যাত্রী এবং ১৫ জন ক্রু ছিলেন।
বিমানের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন দেবি শরণ এবং চিফ অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন অনিল শর্মা। নেপালের আকাশসীমা ভালোভাবে পার হওয়ার পর ভারতের স্থানীয় সময় বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে পাঁচজন সন্ত্রাসী বোমা হাতে নিয়ে পাইলটকে জিম্মি করেন এবং নির্দেশ দেন বিমান পশ্চিম দিকে নিয়ে যেতে। যখন সন্ত্রাসীরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয়, তখন বিমানটি ভারতের আকাশসীমায় ছিল। বিমানে থাকা পাঁচ অস্ত্রধারীর মধ্যে একজন ছিলেন মাসুদ আজহারের শ্যালক ইউসুফ আজহার। তিনিই মূলত ফ্লাইট আইসি-৮১৪ ছিনতাইয়ে নেতৃত্ব দেন।
পাঁচজন অস্ত্রধারীর মধ্যে একজন পাইলটকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের নির্দেশনা মোতাবেক বিমান চালাতে বাধ্য করেন। বাকি ৪ জন লাল মুখোশ পরে সকল যাত্রী ও ক্রুদের মধ্যে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ছিনতাইকারীরা পাইলট দেবি শরণকে লক্ষ্ণৌ থেকে বিমানটি ঘুরিয়ে লাহোরের দিকে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু তখন একটি সমস্যা দেখা দেয়।
বিমানে থাকা জ্বালানী দিয়ে লাহোর পর্যন্ত যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। ফলে পাইলটের অনুরোধে ছিনতাইকারীরা পাঞ্জাবের অমৃতসর বিমানবন্দরে অবতরণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন পাঞ্জাব সরকার কমান্ডো বাহিনীকে প্রস্তুত করেন। তারা কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের কাছে বিমানে অভিযান চালানোর জন্য অনুমতি চান। কিন্তু রাজধানী থেকে কোনো সবুজ সংকেত মেলেনি। কারণ বিমানে তখন ১৯১ জন যাত্রী এবং ক্রু সন্ত্রাসীদের হাতে জিম্মি। অভিযানের কারণে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়তো।
জ্বালানীর জন্য অমৃতসর বিমানবন্দরে অবতরণ করলেও জ্বালানী না নিয়েই সেখান থেকে বিমানটি ছেড়ে যায়। বিমানের পাইলট লাহোর বিমানবন্দরে জরুরী অবতরণের অনুমতি চান। কিন্তু পাকিস্তান প্রথমে তাদের সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করে বিমানবন্দরের রানওয়ের সব লাইট বন্ধ করে দেয়।
যখন লাহোর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে যে, জ্বালানী সংকটে বিমানটি বিধ্বস্ত হতে পারে, তখন তারা অবতরণের অনুমতি দেয়। সেই সাথে জ্বালানী ভর্তি করে বিমানবন্দর ছাড়ারও সম্মতি দেয়। সেখান থেকে বিমানটি দুবাইয়ের সামরিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে এবং ২৭ জন যাত্রীকে সন্ত্রাসীরা ছেড়ে দেয়। ভারতীয় সরকার সেখানে একটি কমান্ডো অভিযান পরিচালনা করতে চেয়েছিল, কিন্তু আরব আমিরাতের সরকার সেটির অনুমতি দেয়নি।
শেষ গন্তব্য কান্দাহার
সবশেষে, বিমানের ছিনতাইকারীরা পাইলটকে বিমানটি আফগানিস্তানের কান্দাহার নিয়ে যেতে বলেন। দেবি সরণ সেটাই করেন। কান্দাহার তখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বিমানটি সেখানে অবতরণের সাথে সাথে তালেবান জঙ্গিরা সেটির চারপাশ ঘিরে ধরে। ভারতীয় সরকারের ধারণা ছিল তালেবান তাদের হয়ে কাজ করবে। কিন্তু তালেবান শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের নজর কাড়তে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। বিমান ছিনতাইকারীরা বিমানের যাত্রী ও ক্রুদের ছেড়ে দেওয়ার বিনিময়ে ভারতের কাছে তিনজন জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায়। এদের মধ্যে ছিলেন মুস্তাক আহমেদ জারগার, আহমেদ ওমর সাঈদ শেখ ও মাওলানা মাসুদ আজহার।
ভারতে তখন বিজেপি সরকার। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ির হাতে বিকল্প কোনো উপায় না থাকায় সন্ত্রাসীদের দাবি অনুযায়ী তিন জঙ্গিকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশবন্ত সিং ও অজিত দোভাল (বর্তমান বিজেপি সরকারের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা) মাসুদ আজহারসহ তিন জঙ্গিকে নিয়ে কান্দাহারে যান। তাদেরকে হরকাতুল মুজাহিদিনের হাতে তুলে দেওয়ার পর তারা বিমানের যাত্রীদের ছেড়ে দেন।
পরবর্তীতে তাদের বিশেষ বিমানে করে ভারতে নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে বিমান ছিনতাইকারী জঙ্গিরা তালেবানের সহায়তায় নিরাপদে কান্দাহার ত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ভারতের সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) ফ্লাইট আইসি-৮১৪ ছিনতাইয়ের ঘটনাটি তদন্ত করে পাঁচ জঙ্গি ছাড়াও আরো সাতজনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়। এদের মধ্যে আবদুল লতিফ, ইউসুফ নেপালি ও দিলীপ কুমারকে আজীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
বিজেপি সরকার ও গোয়েন্দা বাহিনীর ব্যর্থতা
ভারতীয় এয়ারলাইন্সের বিমান ছিনতাই হওয়ার ঘটনাটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর ইতিহাসে অন্যতম বড় এক ব্যর্থতা। উপমহাদেশে জুড়ে তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে থাকলেও নেপাল থেকে বিমান ছিনতাই হবে এমন কোনো তথ্যই তাদের কাছে ছিল না। নব্বইয়ের দশকে নেপালে ‘র’ এর বিপুল পরিমাণ এজেন্ট ছিল। কিন্তু তারা এত বড় একটি ঘটনার কোনো আঁচই করতে পারেনি। তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পাঁচজন জঙ্গি বিমান ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
তবে বিমান ছিনতাই হওয়ার পরও ভারত সরকারের অনেক কিছুই করার ছিল। কিন্তু অটল বিহারি বাজপেয়ি নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকার কার্যকরী কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেননি। যখন বিমানটি অমৃতসরে অবতরণ করেছিল, তখন কমান্ডো অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিদের নিকেশ করার সুযোগ ছিল। এমন কাজই করতে চেয়েছিলেন পাঞ্জাবের তৎকালীন পুলিশ প্রধান সরবজিৎ সিং।
অভিযানটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সফলতা লাভের সম্ভাবনা ছিল। কেননা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিশ্বের অন্যতম দক্ষ কমান্ডো সরবজিৎ ছিলেন। কিন্তু বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটির পর্যবেক্ষণে থাকা ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের কাছে থেকে অনুমতি পাননি সরবজিৎ। পরবর্তীতে তারা নিজ দেশ ছেড়ে আরব আমিরাতের বুকে কমান্ডো অভিযান চালানোর কথা ভাবেন। কিন্তু যেটা তারা নিজ দেশে সুযোগ পেয়েও করেনি, সেটা কী অন্য দেশের মাটিতে সম্ভব? তবে ‘র’ এর ব্যর্থতা হোক কিংবা সরকারের সিদ্ধান্তহীনতাই হোক, ফ্লাইট আইসি-৮১৪ হাইজ্যাকের সূত্র থেকে ভারতের বুকে আর কতগুলো ক্ষতের সৃষ্টি হবে সেটি অজানা। কেননা মাসুদ আজহারের একমাত্র লক্ষ্যই হলো ভারতকে রক্তাক্ত করা।