থ্রিলার ও রাজনীতিকে উপজীব্য করে দেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সিনেমা হয়েছে খুবই কম। আদৌ হয়েছে কিনা, তা নিয়েও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সেই পলিটিকাল থ্রিলার ঘরানায় যখন ‘সাপলুডু’ চলচ্চিত্রটি নির্মিত হলো, তখন তা স্বাভাবিকতই চলচ্চিত্রপ্রেমীদের আগ্রহের শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে।
নাট্যনির্মাতা হিসেবে গোলাম সোহরাব দোদুলের বেশ খ্যাতি রয়েছে। তিনি যখন প্রথম সিনেমা তৈরি করতে শুরু করলেন, তাও এরকম একটি মৌলিক থ্রিলারধর্মী গল্প নিয়ে, তখন ছবিটি মুক্তির জন্য সকলেই অপেক্ষা করছিল। শেষমেশ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ছবিটি মুক্তি পায় গত ২৭শে সেপ্টেম্বর।
চলচ্চিত্রটি শুরু থেকেই দর্শকের মনোযোগ কেড়ে নিতে সক্ষম। কয়েক মিনিটের মাথায়ই দর্শকের মনে হবে তিনি একটা গেমের ভেতর ঢুকে পড়েছেন, যাতে সাপলুডুর মতোই সিঁড়ি ওঠা-নামার রোমাঞ্চ আছে। বাংলা সিনেমার খরায় এই রোমাঞ্চ দর্শকের তৃষ্ণা খানিকটা হলেও মেটাতে পারবে।
একটি গ্রামে সন্ত্রাসী ঘটনায় একজন ফটোগ্রাফারকে (ইন্তেখাব দীনার) খুন করা দিয়ে শুরু হয় সিনেমা। এরপর একের পর এক খুন, বিস্ফোরণ। রহস্য দানা বেঁধে উঠতে থাকে ক্রমশ। সন্দেহের তীর স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর (তারিক আনাম খান)। মন্ত্রী, ডিবির এডিসি সবাই সঙ্গত কারণে কিছু আলামতের ওপর ভিত্তি করে এমপিকেই দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করতে চায়। কিন্তু এরই মধ্যে কাহিনী ঘুরে যায়, খুন হন সাংসদের মা, তার নিয়ন্ত্রণাধীন বাচ্চাদের সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালক নারীও। খুনিকে খুঁজতে গিয়ে নিজেই খুনি হয়ে যান এমপি সাহেবের ছোটভাইও (আরেফিন শুভ)। সাপের মুখে পড়ে বারবার দংশনের শিকার হতে থাকেন তিনি। রহস্য ঘনীভূত হতে থাকে শুধু। একসময় বোঝা মুশকিল হয়ে যায়, কে সেই নাটের গুরু, যার নির্দেশে ঘটে চলেছে এত অঘটন?
সাপলুডু এখনও হলে চলছে, তাই কাহিনীর আর বিস্তারিত প্রকাশ করছি না। চলচ্চিত্রটির অন্যান্য দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই আসা যাক গল্পের কথায়। এই ছবির গল্প একদম বাংলাদেশের গল্প এবং মৌলিক একটি গল্প। গল্পে চৌধুরী সাহেব ছিলেন না, ন্যাকা বা ‘সস্তা’ প্রেমের রসায়ন ছিলো না, “আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না” ধরনের চিরচারিত সংলাপ ছিলো না। কল্পনা আর বাস্তবতার সমন্বয় আছে দারুণভাবেই। যারা বাংলা ছবি বানানোর জন্য গল্প খুঁজে না পেয়ে নকল কিংবা রিমেক করেন, তাদেরকে সাপলুডু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে আমাদের চারপাশে যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়েই সিনেমা বানানো যায়। যে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অসাধারণ সব গল্পের ছড়াছড়ি, সেখানে সিনেমা বানাতে গল্প খুঁজে না পাওয়াটা আসলে কাদের ব্যর্থতা?- এ প্রশ্নও ছুঁড়ে দিয়েছে সিনেমাটি।
সাপলুডুর গল্পটাই সিনেমার মূল শক্তি। হ্যাঁ, যারা নিয়মিত থ্রিলার পড়েন, থ্রিলার সিনেমা দেখেন, তারা ছবি শেষ হওয়ার আগেই হয়তো মূল দোষী কে, তা বুঝে ফেলতে পারেন। কিন্তু সাধারণ দর্শক শেষ দৃশ্যের আগে বুঝতে পারবে না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। বোদ্ধা দর্শকদের জন্য গল্পে আরেকটু সাসপেন্স, টুইস্ট রাখা যেত। খেলাটা আরেকটু জটিল করে তোলা যেত। তবে প্রথম সিনেমা হিসেবে পরিচালক যা করেছেন, তাতেও বাহবা না দিয়ে উপায় নেই।
গল্পের পর এই সিনেমার প্রাণ হলো অভিনয় ও সংলাপ। প্রায় প্রত্যেকেই তার নিজের জায়গায় ভালো করেছেন। আরেফিন শুভ, মিম দুজনেই পরিমিত ছিলেন। অতি-অভিনয় ছিলো না তাদের মধ্যে। আরমান চরিত্রটি শুভর ক্যারিয়ারে ভালো একটা মাত্রা যোগ করেছে বলা যায়। সিনেমার শেষ দৃশ্যে তার বলা “সাপলুডু খেলায় সাপকে কখনো জিততে দেখছো?” সংলাপটা বহুদিন মনে জায়গা করে রাখার মতো। ছবির গল্পে পুষ্প চরিত্রটিতে মিমের ভূমিকা অবশ্য খুব বেশি ছিলো না। অভিনয়ের সুযোগও কম ছিলো। তবু যতটুকু করেছেন, খারাপ করেননি।
সাংসদ আহসান উল্লাহ চরিত্রে তারিক আনাম খান উতরে গেছেন ভালোভাবেই। তিনি বরাবরই দুর্দান্ত অভিনেতা। ফ্লোরা চরিত্রে সুষমা সরকার, ছোট ছোট কয়েকটি চরিত্রে যথাক্রমে রুনা খান, শতাব্দী ওয়াদুদ, মারজুক রাসেল, মৌসুমী হামিদরা নিজেদের সেরাটাই দিতে চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে রুনা খান তো ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে দুর্দান্ত ছিলেন। মনে থাকবে তার সংলাপ ‘আমি জলে ভাসা পদ্ম’র কথা। তবে সবাইকে ছাপিয়ে গেছেন ডিবি অফিসার নজরুল চরিত্রে অভিনয় করা সালাউদ্দিন লাভলু। সিনেমাটিতে নিজের চরিত্রের প্রতি সবচেয়ে বেশি সুবিচার করেছেন তিনিই। একজন স্পাই হিসেবে রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে তার অ্যাকশন আর এক্সপ্রেশন দুটোই ছিলো নিখুঁত।
সিনেমার মূল ভিলেন হিসেবে অনেকটাই হতাশ করেছেন জাহিদ হাসান। জাহিদ হাসান অনেক বড় মাপের অভিনেতা। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে এত দারুণ সব অভিনয়ের মধ্যে জাহিদ হাসানকেই খাপছাড়া লেগেছে। নেতিবাচক রুলে যে ধরনের অভিব্যক্তি, মেজাজ, পাষণ্ডতার দরকার ছিলো, তার ঘাটতি ছিলো অনেকটাই। হয়তো তাকে এরকম চরিত্রে খুব একটা দেখা যায় না বলেও খটকাটা লাগতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিমত হলো সাপলুডুতে জাহিদ হাসানের জায়গায় অন্য কেউ মূল ভিলেন হলে হয়তো খেলাটা জমে যেত আরও গভীরভাবে।
ছবির লোকেশন বাছাই, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, ক্যামেরার কাজ এবং সিনেমাটোগ্রাফি চমৎকার ছিলো। তবে গানগুলো তেমন আবেদন তৈরি করতে পারেনি। চারটি গানের মধ্যে পরিচালকের নিজের লেখায়, ইমন সাহার সুর ও কম্পোজিশনে ইমরানের গাওয়া ‘মাওলা’ গানটি ভালো লেগেছে খুব। গানের সাথে চিত্রায়নও ছিলো যথার্থ। অন্য গানগুলোর মধ্যে বাপ্পা মজুমদারের গাওয়া ‘জন্মদিন’ গানটিই কিছুটা ভালো লেগেছে। অ্যাকশন দৃশ্যগুলোতে সুপার হিরোইজম না থাকলেও গল্প অনুযায়ী ঠিকই ছিলো।
বাংলা সিনেমা একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছবি পরিচালনায় নতুনের আবাহন। গিয়াসউদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, দীপঙ্কর দীপন, রায়হান রাফি, তৌকির আহমেদের সাথে এবার যোগ হলেন গোলাম সোহরাব দোদুল। নির্মাণে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে এদের হাত ধরে। গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে তারা চেষ্টা করছেন মৌলিক গল্পে আমাদের বর্তমান সময়টাকে রিপ্রেজেন্ট করার মতো চলচ্চিত্র তৈরি করতে। মৃতপ্রায় ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচাতে হলে তাদের আইডিয়াগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা করে যেতে হবে।
সাপলুডু থ্রিলার হিসেবে হয়তো বিদেশী চলচ্চিত্রে তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে থাকবে, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমার দেখা এখন পর্যন্ত সেরা পলিটিকাল থ্রিলার হলো সাপলুডু। এমন ছবি বছরে কয়েকটা আসা উচিত। আমাদের চলচ্চিত্রের ঘুরে দাঁড়াতে এর কোনো বিকল্প নেই।
পরিবেশ নিয়ে ব্যক্তিগত অভিমত
তবে ভালো সিনেমা দেখার জন্য ভালো পরিবেশও তৈরি হওয়া দরকার। সিলেটের মতো বিভাগীয় মহানগরীতে একটা সিনেপ্লেক্স নেই, এটা মেনে নেয়া যায় না। আমরা বাংলা চলচ্চিত্রকে অনেক বেশি ভালোবাসি বলেই হয়তো নন্দিতা ও বিজিবির মতো মান্ধাতার আমলের হলে গিয়ে ছারপোকার কামড় খেয়ে, গরমে সেদ্ধ হয়েও ভাঙাচোরা চেয়ারে বসে ছবি দেখি এখনও। কিন্তু আমাদের কাছের মানুষগুলোই হলের এমন পরিবেশ নিয়ে আমাদের টিটকারি মারে। দেশী সিনেমা বাঁচাতে হলে এই অবস্থাটারও দ্রুত উন্নতি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি।
শেষকথা
সাপলুডু কেন দেখবেন? কারণ এটি একটি মৌলিক গল্পের বাংলাদেশি সিনেমা। যে সিনেমায় ভালো অভিনয় আছে, সাসপেন্স আছে, থ্রিল আছে এবং আছে টানটান উত্তেজনাও। বাংলা চলচ্চিত্রকে প্রমোট করার জন্য হলেও ছবিটি হলে গিয়ে দেখা উচিত। আপনার মূল্যবান ১৩৯ মিনিট ও টিকেটের পয়সাগুলো বিফলে যাবে না। জয় হোক বাংলা চলচ্চিত্রের।
সিনেমা: সাপলুডু
চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: গোলাম সোহরাব দোদুল
ব্যক্তিগত রেটিং: ৭/১০