জীবনের শেষের দিকে এসে পোলিশ চলচ্চিত্র নির্মাতা ক্রজিস্তফ কিস্লস্কি নিজের পেশা নিয়ে একটি চমকপ্রদ কথা বলেন,
এতটুকুই যথেষ্ট। এটা ভেবে ভালো লাগছে যে আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ ছেড়ে দিচ্ছি। চলচ্চিত্র নির্মাণ করাটা আমার কখনোই ভালো লাগেনি। আসলে পুরো চলচ্চিত্র জগৎটাকেই আমার কৃত্রিম, অবাস্তব মনে হয়। বেচেঁ থাকার জন্য এটা কোনো সম্মানজনক পেশা না।
– তাহলে সম্মানজনক পেশা কী হতে পারে?
হয়তো বা জুতা তৈরি করা!
না, এর পরে অবশ্য কিস্লস্কি জুতা তৈরির কাজ করেননি। তার শেষ সিনেমা থ্রি কালার্স: রেড এর পর চলচ্চিত্র নির্মাণ থেকে অবসর নিয়ে নেন, এবং এর দুই বছর পর মারা যান। নব্বইয়ের দশকের ইউরোপের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র নির্মাতা তার সিনেমাগুলোকে সাজিয়েছিলেন নিজের জীবনের গল্প বলার মতো করেই। তার সিনেমাগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতা, মানুষে মানুষে সম্পর্ক, নিয়তি এবং সুযোগ কীভাবে জীবনকে প্রভাবিত করছে তার উপর ভিত্তি করে। দশ পর্বের মিনি সিরিজ ডেকালগ নির্মাণের পর কিস্লস্কির শেষ নির্মাণ ছিলো এই থ্রি কালার্স ট্রিলজি।
ফ্রান্সের পতাকার তিন রং (নীল, সাদা ও লাল) এর সাথে সিনেমাগুলোর নামকরণ করেন কিস্লস্কি। ফরাসি পতাকার তিন রঙের দ্বারা বোঝানো হয় স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব। সিনেমাত্রয়ীর প্রথম দুটি ব্লু এবং হোয়াইট, যা স্বাধীনতা এবং সমতা নিয়ে। শেষটি ভ্রাতৃত্ব, অর্থাৎ মানুষ মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে। আজ আলোচনা করা হবে ত্রয়ীর শেষ সিনেমা ‘থ্রি কালার্স: রেড’ নিয়ে।
ত্রয়ীর অন্য সিনেমাগুলোর মতোই এটিও নির্মাণ করা হয়েছে নব্বইয়ের দশকের ইউরোপের একটি শহরের কিছু চরিত্রকে কেন্দ্র করে। সিনেমাটির মূল চরিত্রে আছে চারজন মানুষ এবং দুটি কুকুর। জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত উঠতি মডেল ভ্যালেন্টিন, একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, সদ্য বিচারপতি হওয়া অগাস্টে এবং তার প্রেমিকা। আর দুই বিচারকের দুই কুকুর। সিনেমাটি যদিও নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে, তবে গল্পের শুরু থেকে চরিত্রগুলোর মধ্যে কোনো প্রকার যোগাযোগ নেই। তারা সবাই অপরিচিত। এই অসম্ভব পারস্পরিক সম্পর্কের যোগাযোগ নির্মাতা ছেড়ে দিয়েছেন ভাগ্যের হাতে। কিস্লস্কি দেখিয়েছেন কীভাবে চরিত্রগুলোর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো গল্পটিকে এর মূল পরিণতি পর্যন্ত নিয়ে যায়।
সিনেমা শুরু হয় একটি ফোন কলের মাধ্যমে। সিনেমাটির নামকরণে ফরাসি পতাকার লাল রঙ ব্যবহার করার জন্যই যে মানুষের মধ্যে যোগাযোগ এবং সম্পর্ক বোঝাবে এমনটি নয়। বরং সিনেমার থিমটি নির্মাতা সিনেমার শুরুর দিকেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। শুরুর দৃশ্যে দেখা যায়- টেবিলে একটি টেলিফোন, একটি মদের গ্লাস, এবং এক নারীর ছবি। টেলিফোনের লোকটি ফোন করেন। এখানে নির্মাতা দু’পাশে টেলিফোনের আলাপ সরাসরি দেখানোর বদলে দেখিয়েছেন কলটির যাত্রা। টেলিফোন কলটির যাত্রাপথে দেখা যায় কলটি প্রথমে কেবলের মাধ্যমে অনেকগুলো কেবলের সংযোগস্থলে এসে পৌঁছায়, এবং এরপর সাগরের ভেতরের কেবল দিয়ে চলে যায় অন্য দেশে, যদিও পরে কলটি কেটে যায়।
লোকটি আবার কল করে, কিন্তু এবার দেখা যায় সাগরের অপর পাড়ে অগাস্টেকে, যে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে কুকুর নিয়ে রাস্তার অপর পাশের ক্যাফেতে যায়। আমরা টেলিফোনের আওয়াজ আবার শুনতে পাই, কিন্তু এবার আসে ক্যাফের উপরে থাকা অন্য অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। এবার কলটি ধরতে পারে ভ্যালেন্টিন এবং কলটি আসে তার বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে, যে সাগরের ঐ পাড়ে ইংল্যান্ডে থাকে। তারা কথা বলে এবং ভ্যালেন্টিন বলে- সে তাকে গতরাতে মিস করেছে, যদিও তার বয়ফ্রেন্ড আগের কলটি কেটে যাওয়ার জন্য বিরক্ত। অন্যদিকে অগাস্টে তার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যায় এবং প্রেমিকাকে ফোন করে। সে ফোনে তার প্রেমিকাকে আলতো চুমু দেয় এবং প্রথম দৃশ্যের শেষ হয়।
এই দৃশ্যে আছে চারজন, কিন্তু নির্মাতা দেখিয়েছেন এমন দুজনকে, যারা একই রাস্তার দু’পাশে থাকেন, কিন্তু একে অপরকে চেনেন না। শুরুর দৃশ্যটা গল্প চলতে থাকলে মনে থাকার কথা না, কিন্তু এখানেই একটা ইঙ্গিত থাকে ভ্যালেন্টিনের ম্লান হতে থাকা পুরোনো সম্পর্ক, যার একমাত্র মাধ্যম টেলিফোন। এই শুরুর সাড়ে চার মিনিটেই দর্শক বুঝতে পারে ভ্যালেন্টিন এবং অগাস্টে তাদের পুরোনো সম্পর্ক ছিন্ন করবে এবং সিনেমার কোনো এক পর্যায়ে তাদের দেখা হবে।
সিনেমাটি কোনো গতানুগতিক প্রেমের গল্প না। এখানে যেমন আছে শহরের উজ্জ্বল আলোর আড়ালের একাকিত্ব, তেমনই আছে একাকিত্ব দূর করা অসম বন্ধুত্ব। আরও আছে মানবিক আবেগহীন এক অবসরপ্রাপ্ত বিচারকের গল্প, যে কি না তার প্রতিবেশীর ফোনকলে আড়ি পাতে! সে সত্যকে খুঁজে আড়ি পাতা ফোন কলে, কারণ মানুষ বিচারকের সামনে মিথ্যা বললেও ফোনে মিথ্যা বলে লুকোতে পারে না। সিনেমার কাহিনী এগোয় একটি দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে। ভ্যালেন্টিনের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে একটি কুকুর। কুকুরের মালিক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এবং ভ্যালেন্টিন জানতে পারে সে তার প্রতিবেশীদের ফোন কলে আড়ি পাতে।
ভ্যালেন্টিন প্রথমে ব্যাপারটি প্রতিবেশীদের জানাতে যায়, কিন্তু না জানিয়ে ফিরে আসে। এরপর তারা শুনতে পায় দুই প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যকার আলাপ। এই দৃশ্যে দর্শকরা জানতে পারে, সেই দুজন হলো অগাস্টে এবং তার প্রেমিকা, কিন্তু ভ্যালেন্টিন জানতে পারে না। জাজ তাকে বলে, ছেলেটি এখনও তার সোলমেটকে খুঁজে পায়নি, যদিও সে তার প্রেমিকাকে ভালোবাসে। এরপর ভ্যালেন্টিন চলে যায় এবং যাওয়ার সময় ঘৃণাভরে বিচারককে বলে, “One can only feel pity for you।”
ভ্যালেন্টিন আবার বিচারকের সাথে দেখা করে, কারণ বিচারকের কুকুরটি এখন থাকে ভ্যালেন্টিনের কাছে, এবং সেটি আবারও হারিয়ে যায়। কুকুর খুঁজতে সে বিচারকের বাড়িতে আসে, কিন্তু এবার দুজনের সম্পর্ক ধীরে ধীরে বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। একইসাথে সিনেমাতে সমান্তরালে অগাস্টের ঘটনাগুলো চলতে থাকে। আস্তে আস্তে ভ্যালেন্টিন ও বিচারকের অসম বন্ধুত্ব গভীর হতে থাকে, এবং নিজের জীবনের ঘটনাগুলো বিচারক বলতে থাকে। ঘটনাগুলো অনেকটা আগাস্টের সাথে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার মতো।
সিনেমার একটা সময়ে এসে মনে হতে পারে, হয়তো বা বিচারকের আগের জীবন ফ্ল্যাশব্যাক দেখানো হচ্ছে, এবং অগাস্টেই হয়তো এখনকার বৃদ্ধ বিচারক। কিন্তু কিস্লস্কি সিনেমায় ঘটনাগুলো ফ্ল্যাশব্যাক হিসেবে না দেখিয়ে অগাস্টেকে দেখিয়েছেন বিচারকের পুনর্জন্ম হিসেবে। যদিও এটা শুধু রুপকভাবেই দেখানো হয়েছে।
সিনেমাটিতে প্রচুর লাল রঙের ব্যবহার করা হয়েছে। লাল রঙ দ্বারা ফরাসি পতাকায় সহমর্মিতা বোঝানো হলেও এটি নির্দেশ করে ভালোবাসা, যৌনতা, হিংস্রতা ও রোমাঞ্চ। সিনেমার প্রায় দৃশ্যেই ভ্যালেন্টিন লাল অথবা কালো রঙের পোশাক পরে থাকে। কিস্লস্কি কীভাবে কালার সাইকোলজি দৃশ্যে ব্যবহার করেছে এটা দর্শকদের চিন্তার সাথে না-ও মিলতে পারে কিন্তু রঙের ব্যবহার প্রতিটি দৃশ্যকেই আরও বেশি আবেদনময় এবং সুন্দর করে তুলেছে।
সিনেমাটির গল্প বলা হয়েছে ক্যামেরার সাহায্যে। কিস্লস্কি তার সিনেমায় ন্যারেশন ব্যবহার না করে ব্যবহার করেছেন ক্যামেরা এবং রঙ। দৃশ্যগুলোতে রঙের ব্যাহার সেগুলো বলার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, এবং দৃশ্যায়ন গল্পগুলো বলেছে। একটা দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই থিয়েটারে ভ্যালেন্টিনা এবং বিচারক কথা বলার সময় বিচারক তাকে বলে, সে তরুণ বয়সে প্রায়ই থিয়েটারে আসতো এবং উপরের দিকে এক কোণায় সবসময় বসতো। একদিন তার হাত থেকে বই পড়ে যায় নিচে। সিনেমার শুরুতে এই দৃশ্য আমরা আগেও দেখেছি অগাস্টের সাথে। দুটি দৃশ্যেই ভ্যালেন্টিন থাকে, যদিও অগাস্টে এবং ভ্যালেন্টিন একে অপরকে দেখে না। বিচারকের দৃশ্যে ভ্যালেন্টিন এবং সে বই পড়ার মুহূর্তে নিচের দিকে তাকায়, কিন্তু ক্যামেরা নিচে না দেখিয়ে দেখায় দুজনের মুখের দিকে, এবং তারা নিচে তাকিয়ে আছে।
ক্যামেরা বইয়ের দিকে তাক করা নেই, কারণ ঘটনাটি অতীতে ঘটে গেছে। কিন্তু অগাস্টের সাথে একই ঘটনায় ক্যামেরা তাক করা থাকে বইয়ের দিকে, কারণ ঘটনাটা তখনই ঘটছে। ব্যাপারটি দুর্বোধ্য মনে হলেও দর্শকরা ঠিকই অবচেতনভাবে বুঝে যায়। এখানেই আছে সিনেমাটির সার্থকতা। এটি দেখা শুরু করলে দর্শক একসময় গল্পের ভেতরে ঢুকে যায়।
সিনেমায় ‘Breath of Life’ পোস্টারটি ব্যবহার করা হয়েছে কয়েকবার। এর ফটোশুটের সময় ভ্যালেন্টিনাকে বলা হয় হতাশা এবং কষ্টের অভিনয় করতে। পোস্টারটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আরেকটি ছবি দেখা যায় সিনেমার শেষ দৃশ্যে। কিস্লস্কি বলেছিলেন, তিনি চলচ্চিত্র জগতের কৃত্রিমতাকে ঘৃণা করেন। সিনেমায় ভ্যালেন্টিনও একসময় কৃত্রিম জগত থেকে ফিরে আসে বাস্তবে, যদিও সেটা শুরু হয় ট্র্যাজেডির মাধ্যমে।
সিনেমায় নিয়তিকে দেয়া হয়েছে একটা আলাদা গুরুত্ব। কিস্লস্কি নিয়তি নিয়ে বলেছেন,
We are a sum of several things, including will, fate (but we can change fate a little) and chance, which is not so important.
সিনেমার গল্পের দিকেই যদি তাকানো হয়, তবে দেখা যাবে প্রতিটি ঘটনাই ভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত। বিচারকের কুকুর যদি ভ্যালেন্টিনার গাড়ির নিচে না এসে পড়তো তাহলে তার সাথে বিচারকের দেখাও হতো না। অথচ গল্পের শুরুটা হয় ওখান থেকেই। দর্শক শুরু থেকেই বুঝতে পারে ভ্যালেন্টিনা এবং অগাস্টে প্রেমে পড়বে, কিন্তু অনেকবার কাছাকাছি থেকেও তাদের মধ্যে দেখা হয় না। অনেক সময় দুর্ঘটনার ফলেই হয় নতুন সম্ভাবনার সূত্রপাত।
সিনেমাটি তিনটি অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। বেস্ট ডিরেক্টরের জন্য ক্রজিস্তফ কিস্লস্কি, বেস্ট রাইটিং ও স্ক্রিনপ্লের জন্য ক্রজিস্তফ কিস্লস্কি ক্রজিস্তফ পিসউইচ্য এবং বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফির জন্য পিওতর সবোচিনস্কি। এছাড়াও গোল্ডেন গ্লোব নমিনেশন পায় বেস্ট ফরেন ল্যাংগুয়েজ ফিল্মের জন্য। এছাড়াও সিনেমাটির আরেকটি অসাধারণ দিক হলো এর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক। প্রেইজনারের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরে প্রতিটি সিনেই একটা ক্যারিসম্যাটিক আবহ সৃষ্টি হয়।