প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রতিটি ফ্রন্টে পর্যুদস্ত অটোমানরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৮ সালের ৩১ অক্টোবর। যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পরেই অটোমানদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুক্ত করার তিন কারিগর, আনোয়ার পাশা, তালাত পাশা ও জামাল পাশা জার্মান গানবোটে করে পালিয়ে যান। তুরস্কের রাজধানীতে প্রবর্তিত হয় মিত্র বাহিনীর সামরিক শাসন, প্রশাসনযন্ত্রও চলে যায় তাদের নিয়ন্ত্রণে।
ভগ্ন-মনোবলের তুর্কিদের কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনায় মেতে উঠে মিত্রশক্তি। মিত্রশক্তির অনুমতিতে গ্রিক বাহিনী দখল করে নেয় তুরস্কের স্মার্না, যার বর্তমান নাম ইজমির। মিত্রশক্তি কর্তৃক লঙ্ঘিত হয় তুর্কি অধ্যুষিত আনাতালিয়া অঞ্চলের স্বাধীনতাও। ফলে, স্মার্না আর আনাতালিয়াকে কেন্দ্র করে সংগঠিত হতে থাকে তুর্কি জাতীয়তাবাদীরা। গ্রিকদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে থ্রেসেও, প্রতিরোধ-যুদ্ধে শরিক হয় সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশও।
মিত্রশক্তির ওপর ভর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টারত সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ এই তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পাঠান সেনাপতি মোস্তফা কামাল পাশাকে। সামসুন বন্দরে অবতরণ করে এই জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তাদেরকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সৈনিক হিসেবে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন মোস্তফা কামাল। বিভিন্ন প্রতিরোধ সংঘের সাথে যোগাযোগ করে তিনি তৈরি করেন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম। ১৯১৯ সালের ২৩ জুলাই থে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এরজুরামে জাতীয়তাবাদীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তৈরি হয় তুর্কি জাতির ভৌগলিক সীমারেখা রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফর্ম।
এরপর জাতীয়তাবাদীরা ধারাবাহিকভাবে সিভাস মহাসম্মেলন করেছে সুলতানের বাঁধা উপেক্ষা করে। সমস্ত জাতীয়তাবাদী কাজকর্ম সমন্বয়ের জন্য তৈরি হয় প্রতিনিধি পরিষদ, যার সভাপতি হন মোস্তফা কামাল। জাতীয়তাবাদীরা সুলতানের প্রতি তাদের আনুগত্য বজায় রাখলেও, ক্রমেই রাজনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের তুরস্কের প্রকৃত সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। ১৯১৯ সালের শেষদিকে পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং জাতীয়তাবাদীগণ তাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। রাজধানীতে অধিবেশন আহ্বান করা হয়, জাতীয়তাবাদীগণ অধিবেশনে যোগদানের পূর্বেই মিল্লি মিসাক (জাতীয় সনদ) প্রকাশ করেন।
এই রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে সুলতান ধর্মীয় ফতোয়া দিয়ে জাতীয়তাবাদীদের দমনের চেষ্টা করেন, মিত্রশক্তি পূর্ব আনাতালিয়ায় অস্ত্র সরবারহ করে চেষ্টা করে জাতীয়তাবাদ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের উস্কে দিতে। এরমধ্যেই ১৯২০ সালের আগস্টে মিত্রশক্তি ও তুরস্কের সুলতানি সরকার সেভ্রে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির কঠোর ধারাগুলোর কারণে দ্রুতই চুক্তিটি নিয়ে বিরূপ মনোভাব ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ তুর্কিদের মধ্যে, শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে জাতীয়তাবাদীরা। ফলে, দ্রুত পরিণতির দিকে এগোতে থাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।
তুরস্কে তখন একসাথে দুইটি সরকার বিরাজমান- সুলতানি সরকার ও জাতীয়তাবাদী সরকার। বিভিন্ন স্থানে সুলতানি সরকারের ইন্ধনে বিদ্রোহ জেগে উঠছিল। অন্যদিকে গ্রিকরা হঠাৎ করে স্মার্না, ব্রুসা ও উশাক থেকে এসকিশেহির ও আফিয়ুন দখলের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। গ্রিক বাহিনী দ্রুতই দখল করে ফেলে আফিয়ুন। ইসমেতের বাহিনী এসকিশেহিরে প্রতিরোধ গড়ে তুললেও মোস্তফা কামালের নির্দেশে পশ্চাদপসরণ করেন। সামরিক বাহিনীকে সংগঠিত করে ১৯২২ সালের আগস্টে গ্রিকদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন মোস্তফা কামাল, সাকারিয়া নদীর তোরের যুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব প্রদর্শন করে মোস্তফা কামাল ও তার সৈনিকেরা। পশ্চাদপসরণরত গ্রিকদের হটিয়ে আফিয়ুন ও এসকিশেহির দখল করে তারা। পরের মাসেই তুর্কি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসে স্মার্না, কামাল চেষ্টা করতে থাকেন পূর্ব থ্রেস, রাজধানী কনস্টান্টিনোপল ও আদ্রিয়ানোপলের হৃত অংশ পুনরুদ্ধারে।
লুজান শান্তি সম্মেলন
জাতীয়তাবাদী ভাবধারার তুর্কিরা সেভ্রে চুক্তিকে কখনোই মেনে নিতে পারেনি, মেনে নিতে পারেনি মিত্রশক্তিকে ব্যবহার করে সুলতানের ক্ষমতায় থাকার চেষ্টাকেও। ফলে, মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কিরা তুরস্কের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার যুদ্ধে নামে। গ্রিকদের হটিয়ে দেন আফিয়ুন, স্মার্নার মতো অঞ্চলগুলো থেকে। মুদানিয়ার চুক্তির পর সেভ্রে চুক্তি বাতিল করে নতুন চুক্তি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। দেখা দেয় একটি নতুন শান্তি সম্মেলন আয়োজনের। এরই লক্ষ্যে সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে ১৯২২ সালের ২০ নভেম্বর থেকে জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে মিত্রশক্তির শান্তি আলোচনা শুরু হয়। প্রথম দফার আলোচনার ব্যর্থতার পর ১৯২৩ সালের এপ্রিলে পুনরায় শুরু হয় শান্তি সম্মেলন, জুলাই মাসে লুজান বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই পক্ষের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় চুক্তি।
তুরস্কের ভূখণ্ডের রাজনৈতিক রূপ পরিবর্তন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিজিত পক্ষগুলোর সাথে আলাদা আলাদা চুক্তি করে বিজয়ী মিত্রশক্তি। জার্মানির সাথে করে ভার্সাই চুক্তি, অস্ট্রিয়ার সাথে করে সেইন্ট-জার্মেইন চুক্তি, বুলগেরিয়ার সাথে করে নিউইলি চুক্তি আর হাঙ্গেরির সাথে করে তারিয়ানন চুক্তি। অটোমান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার তুরস্কের সাথে প্রথমে স্বাক্ষরিত হয় সেভ্রে চুক্তি, জাতীয়তাবাদী তুর্কিরা এই চুক্তি মেনে না নিয়ে পাল্টা সামরিক পদক্ষেপে গেলে সুইজারল্যান্ডের লুজানে হয় নতুন চুক্তি, যার নাম লুজান চুক্তি। এই চুক্তিতে তুরস্কের ভূ-ভাগের বেশকিছু রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা করে।
প্রথমত, স্মার্নাকে তুরস্কের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এতে। ১৯১৮ সালের ৩১ অক্টোবর অটোমানরা যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষরের পর মিত্রশক্তির প্রচারণায় স্মার্না দখল করেছিল গ্রিকরা, সেভ্রে চুক্তির ৭৭ নং ধারায় স্মার্নায় গ্রিসের শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপন করা হয়েছিল গ্রিসের কাছেই। সেভ্রে চুক্তি কার্যকর হওয়ার পাঁচ বছর পর গণভোটের মাধ্যমে এই অংশ গ্রিসের অংশ হওয়ার জন্য দাবি জানাতে পারতো, গ্রিসের অংশ হলে তুরস্ককে মেনে নিতে হতো সেই অন্তর্ভুক্তি।
দ্বিতীয়ত, একসময় তুরস্ক বিশাল সাম্রাজ্য ছিল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেও এর আয়তন ছিল আঠারো লক্ষ বর্গকিলোমিটারের কাছাকাছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকেই অটোমান সাম্রাজ্যের ভাঙনের সুর প্রবল হয়, বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে আরব দেশগুলোর ওপর আর নিয়ন্ত্রণ ছিল না সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদের। লুজান চুক্তির মাধ্যমে অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এই আরব দেশগুলোর ওপর নিজেদের দাবি ত্যাগ করে তুর্কিরা। দেশগুলোর একটা বড় অংশ চলে যায় যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্সের মতো নেতৃস্থানীয় মিত্রশক্তিগুলোর অধীনে।
তৃতীয়ত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গ্রিকদের তুরস্কের বিভিন্ন অংশ দখলের অভিযান স্মার্না থেকে শুরু হয়। আর তুর্কিদের দিক থেকে জাতীয়তাবাদীরা সংগঠিত হতে শুরু করে আনাতালিয়া থেকে। পূর্ব আনাতালিয়ার এরজুরামে হয় জাতীয়তাবাদীদের প্রথম সম্মেলন, তৈরি হয় ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের সূচনা। প্রায় ৫৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের এশিয়ার মাইনরে অবস্থিত এই এলাকাটি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে চলে যায় ইতালির অধীনে। চলে যাবার বিষয়টি স্বীকৃত হয়েছিল সেভ্রে চুক্তির মাধ্যমে। লুজান চুক্তির ফলে আনাতালিয়া তুরস্কের ভৌগলিক কাঠামোর মধ্যে চলে আসে, প্রতিষ্ঠিত হয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
চতুর্থত, সেভ্রে চুক্তির ১২২ নং ধারা অনুযায়ী, ইজিয়ান সাগরের ইমব্রস ও তেনেদস দ্বীপ গ্রিসের কাছে স্থানান্তর করার কথা ছিল, ইজিয়ান সাগরের আরো কিছু চলে যাওয়ার কথা ছিল গ্রিসের অধীনে। লুজান চুক্তির মাধ্যমে ইমব্রস ও তেনেদস দ্বীপের ওপর তুরস্কের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়। তবে ইজিয়ান সাগরের অন্যান্য দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ থেকে যায় গ্রিসের কাছেই, দোদেকানিজ দ্বীপপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ থেকেও সরানো যায়নি ইতালিকে।
পঞ্চমত, সেভ্রে চুক্তির ৮৮ থেকে ৯০ ধারা পর্যন্ত আলোচনা করা হয়েছিল স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর্মেনীয়দের উপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আছে অটোমান শাসকদের বিরুদ্ধে, অটোমানদের উত্তরসূরি তুরস্কের নেতারা অবশ্য একে দাবি করেন গৃহযুদ্ধ হিসেবে। সবমিলিয়ে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালেই জোরালো হচ্ছিল স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি। লুজান চুক্তিতে এ ব্যাপারে নতুন কোনো ধারা যুক্ত হয়নি। তার মানে স্বাধীনতার ইস্যুটি ছেড়ে দেওয়া হয় রাশিয়া আর তুরস্কের সীমানা সংক্রান্ত চুক্তির উপরেই।
ষষ্ঠত, গ্রিকদের অগ্রাভিযানের মুখে থ্রেসের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হারিয়েছিল তুর্কিরা, লুজান চুক্তির মাধ্যমে এর কর্তৃত্ব ফিরে পায় তারা। এছাড়া মারিৎজা নদী ও এর পশ্চিম পাড়ের কারাগাচ শহর পর্যন্ত স্বীকৃত হয় তুরস্কের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।
সবমিলিয়ে, সেভ্রে চুক্তিতে যেখানে তুরস্কের আয়তন হওয়ার কথা ছিল ৪ লাখ ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার, সেখানে লুজান চুক্তির পরে তুরস্কের আয়তন দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬২ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙে মোট তেরোটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম হয়।
তুরস্কের সার্বভৌমত্ব সীমিতকরণ
অপমানজনক সেভ্রে চুক্তির চেয়ে লুজান চুক্তি তুর্কিদের কাছে তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল। এর মাধ্যমে মিত্রশক্তির কাছ থেকে আদায় করে নেওয়া গিয়েছিল সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তা। সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা সীমিত রাখার বিধান তুলে দেওয়া হয়, বাতিল করা হয় তুরস্কের অর্থনীতিতে মিত্রশক্তির নিয়ন্ত্রণের সুযোগ। সেভ্রে চুক্তিতে বিদেশি নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল কিছু অতিরিক্ত সুবিধা, লুজান চুক্তিতে সেসব বাতিল করা হয়।
ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে জার্মানির যেখানে বিশাল ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নীতি ঠিক হয়, বিজিত অংশ হয়েও তুরস্ককে কোনো ক্ষতিপূরণ দিতে হয়নি লুজান চুক্তির কারণে। বরং, গ্রিকদের কাছ থেকে সামরিক অভিযানের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কিছু অতিরিক্ত এলাকার দখল পায় তুর্কিরা। এরপরও, লুজান চুক্তিতে কয়েকটি প্রশ্নে তুরস্কের স্বাধীনতাকে সীমিত করা হয়। সংকুচিত করা হয় সার্বভৌমত্বকেও। সেটি হয়ে নানা দিক থেকে।
প্রথমত, থ্রেস সীমান্তের ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে সকল ধরনের সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে তুরস্ককে সম্মত হতে হয়, এই সীমানার মধ্যে বন্ধ থাকে তুরস্কের সামরিক কুচকাওয়াজও। দেশের অভ্যন্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করা সামরিক বাহিনীর জন্য এই শর্ত তুরস্কের সার্বভৌমত্বের ধারণা ও কর্তৃত্বকে সীমিত করে।
দ্বিতীয়ত, বসফরাস প্রণালী ও দার্দানেলসের উভয় পাশেও একইভাবে সামরিক তৎপরতা ও সামরিক কুচকাওয়াজ বন্ধ রাখা হয়। মার্মার সাগরেও একইরকম শর্ত আরোপ করা হয়, বেঁধে দেওয়া হয় ইস্তাম্বুলে সামরিক ছাউনিতে থাকা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যাও। সামরিক তৎপরতা বর্জিত এলাকাগুলোতে নিষিদ্ধ করা হয় গোলন্দাজ বাহিনীর উপস্থিতি, নিষিদ্ধ করা হয় সামরিক যানের উপস্থিতি।
লুজান চুক্তি কেন গুরুত্বপূর্ণ
বিভিন্ন দিক থেকেই লুজান চুক্তিটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পরে যখন বিজয়ী মিত্রশক্তি বিজিত দেশগুলোর উপর ইচ্ছামতো চুক্তি চাপিয়ে দিচ্ছিল, তখন তুর্কিরাই জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে আত্মত্যাগের বিনিময় একটি তুলনামূলক সম্মানজনক চুক্তি করতে সক্ষম হয়। লুজান চুক্তির মাধ্যমে এই আত্মত্যাগের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জিত হয়, পাশাপাশি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ পায় তুরস্ক। লুজান চুক্তির পর থেকেই শুরু হয় তুরস্কের জাতি গঠনের প্রক্রিয়া, তৈরি হয় নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ।
দ্বিতীয়ত, এই চুক্তি সেভ্রে চুক্তিকে প্রতিস্থাপিত করে। অর্থাৎ আগের অপমানজনক চুক্তিটিকে বাতিল করে। সুলতান যখন যেকোনো কিছুর বিনিময়ে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করছিলেন, নিজের প্রজাদের বিপক্ষে গিয়ে মিত্রশক্তিকে অবলম্বন করে চেয়েছিলেন নিজের শাসনকে টিকিয়ে রাখতে। যার ফলশ্রুতি ছিল সুলতানি সরকারের সেভ্রে চুক্তি। লুজান চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব হরণকারী সেভ্রে চুক্তি বাতিলের পাশাপাশি সুযোগ হয় সুলতানের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি নির্মাণ করার।
তৃতীয়ত, লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুলনামূলক একটি সন্তোষজনক সীমানা পায় তুর্কিরা। সেভ্রে চুক্তিতে যেখানে তুরস্কের আয়তন ছিল ৪ লাখ ৫৩ হাজার বর্গকিলোমিটার, সেখানে লুজান চুক্তির পরে তুরস্কের আয়তন দাঁড়ায় ৭ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬২ বর্গকিলোমিটার। এর পাশাপাশি, লুজান চুক্তির মাধ্যমেই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিসের সাথে সীমানা নির্ধারিত হয় তুরস্কের, সীমানা নির্ধারিত হয় অটোমান সম্রাজ্যের অন্যান্য অংশের সাথেও, যেগুলো পরাশক্তিগুলোর ম্যান্ডেটে চলে গিয়েছিলো তখন। এই সীমানা ইস্যুর সমাধান তুরস্ককে অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোতে মনোযোগের সুযোগ করে দেয়।
জাতি হিসেবে তুর্কিরা নতুন করে নিজেদের আত্মপরিচয় সন্ধানের সুযোগ পায় লুজান চুক্তির মাধ্যমে। একসময়ের ইউরোপের রুগ্ন মানুষ থেকে এখন অন্যতম আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে তুরস্কের, গড়ে উঠছে সামরিক শক্তি হিসেবে। প্রভাব বাড়ছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে।