২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৬; ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে আমেরিকান বিমান কোম্পানি এক্সেল এয়ারের কেনা নতুন জেট বিমান। এমব্রায়ার লেগেসি ৬০০ মডেলের বিমানটি নিউ ইয়র্কে যাবার আগে ব্রাজিলের ম্যানাওসের বিরতি নেবে। মাঝের প্রায় পুরো পথটিতেই জেট বিমানের যাত্রীরা উপভোগ করতে থাকে আমাজনের সবুজ রাজ্য। কিন্তু বিকাল পাঁচটার সামান্য আগে হঠাৎ কেঁপে ওঠে বিমান, জরুরি অবতরণ করতে হয় আমাজনে অবস্থিত একটি সামরিক বিমানঘাঁটিতে। সবাই বেঁচে গেলেও ঘটনা শেষ হয়নি তখনো। বরং কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা যায়, ঘটনা শুরুই হয়েছে কেবল।
এক্সেল এয়ারের কেনা বিমানটি ব্রাজিল থেকে আমেরিকায় যাচ্ছিল ডেলিভারি ফ্লাইট হিসেবে। বিমানে দু’জন পাইলট ছাড়াও ছিলেন এক্সেল এয়ার ও অ্যামব্রায়ারের দুজন করে কর্মকর্তা। তাদের সাথে ছিলেন নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভ্রমণ বিষয়ক একজন সাংবাদিক। ৪২ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন জোসেফ লেপোরে এবং ৩৪ বছর বয়সী ফার্স্ট অফিসার জ্যান পল পালাদিনো ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। দুজন পাইলটই ছিলেন বিমান চালানোয় যথেষ্ট অভিজ্ঞ।
সাও পাওলো থেকে ম্যানাওসের যাত্রাপথে বিমানটি ছিল ৩৭,০০০ ফুট উচ্চতায়। নতুন জেটে পাঁচ যাত্রী বেশ আরাম করেই উড়ছিলেন। কিন্তু হঠাৎই বিকট শব্দে বিমানটি কেঁপে উঠলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। জানালা দিয়ে তারা দেখতে পান বিমানের বাম দিকের পাখার অংশবিশেষ ভেঙে গিয়েছে। আমাজনের আকাশে এ ভয়ংকর অবস্থায় মৃত্যুভয় পেয়ে বসে সবাইকেই। ঘটনাস্থল থেকে নিকটবর্তী বিমানবন্দর যাওয়া সম্ভব ছিল না, কারণ সে অবস্থায় বিমান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। পাইলটরা তাদের ফ্লাইট চার্ট খুঁজে ব্রাজিলের একটি সামরিক বাহিনীর বিমানঘাঁটি খুঁজে পান। জরুরি অবতরণের অনুমতি নিয়ে নিরাপদেই অবতরণ করে বিমানটি। কিন্তু অবতরণের পরপরই পাইলট ও যাত্রীদের পাসপোর্ট নিয়ে নেয়া হয় ও একপ্রকার গ্রেপ্তার করা হয় তাদের। পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাদের বিমানঘাঁটিতেই আটকে রাখতে বলা হয়। তারা কেউ কোনোভাবেই বুঝতে পারছিলেন কোন ভৌতিক কারণে মাঝ আকাশে বিমান এরকম ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
আমাজনে যখন এ ঘটনা ঘটছে, ঠিক তখন ব্রাজিলিয়ার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) রুমে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। ব্রাজিলিয়া ব্রাজিলের বড় শহরগুলোর একটি। ব্রাজিলের আকাশে যত বিমান যায় তার সিংহভাগ যায় ব্রাজিলিয়ার আকাশ সীমানা দিয়ে। লেগেসি ফ্লাইটটি তাদের রাডার থেকে নিখোঁজ হবার পাশাপাশি নিখোঁজ হয়ে গেছে ম্যানাওস থেকে আসা বোয়িংয়ের একটি বিমানও! দু’ঘন্টা আগে ম্যানাওস থেকে রওনা দেবার পরেও রাডারে বিমানটির কোনো খোঁজ পাচ্ছিল না ব্রাজিলিয়ায় দায়িত্বরত এটিসি ক্রু। ম্যানাওসে যোগাযোগ করলে তাকে বলা হয় আরো আধা ঘন্টা আগেই বিমানটির ব্রাজিলিয়ার সাথে যোগাযোগ করার কথা ছিল!
স্বাভাবিকভাবেই নির্মম সত্যটিকেই ধরে নেয়া হয়। ব্রাজিলিয়ান বিমানবাহিনীর পাঁচটি হেলিকপ্টার আমাজন জঙ্গলে অভিযান শুরু করে। উঁচু ও ঘন গাছের মাঝে বিমান খোঁজাও বেশ কঠিন একটি কাজ ছিল। তবে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় বিধ্বস্ত বোয়িং বিমানটি। ছ’জন ক্রু ও ১৪৮ জন যাত্রীর কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বোয়িং বিমান দুর্ঘটনার কথা আমাজনের বিমানঘাঁটিতেও জানানো হয়। সেসময়ই ধারণা করা হয়, দু’টি বিমানের ঘটনা এক সুতোয় বাঁধা। লেগেসি জেটের দুই পাইলটকে গ্রেপ্তার করা না হলেও একটি হোটেলে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত থাকতে বলা হয়।
ব্রাজিলের বিমানবাহিনী দায়িত্ব পায় পুরো ঘটনা তদন্তের। শুরুটা হয় ব্রাজিলিয়ার এটিসির রাডার থেকে। রাডারে দেখা যায় লেগেসি ফ্লাইটটির ৩৭,০০০ ফুট উচ্চতায় চলার কথা থাকলেও সেটি বারবার ওঠানামা করছিল। তদন্তকারীরা ধারণা করেন নতুন বিমানটিকে বাজিয়ে দেখতেই পাইলটরা এ কাজ করছিলেন। তবে তাদের এ ধারণা পাল্টে যায় লেগেসি জেটের ব্ল্যাকবক্স থেকে পাওয়া তথ্য পেয়ে। ব্ল্যাকবক্সের তথ্য অনুযায়ী বিমানটি পুরো সময়ই ৩৭,০০০ ফুটেই ছিল, একবারের জন্যও ওঠানামা করেনি।
অন্যদিকে বিধ্বস্ত বোয়িং বিমানের ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি ভয়েস রেকর্ডার। বোয়িং বিমানের ফ্লাইড ডাটা রেকর্ড থেকে দেখা যায় কোনো প্রকার ওয়ার্নিং ছাড়াই বিমানটি হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তারচেয়েও ভয়ংকর ব্যাপার ছিল, পাইলটরা কোনো সুযোগই পাননি নিয়ন্ত্রণের। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগে এগারোবার চক্কর দিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় বিমানটি! লেগেসি জেটের তথ্যের সাথে মিলিয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় দু’টো বিমানের সংঘর্ষ হয়েছিল, আর সেখান থেকেই এই দুর্ঘটনার সূত্রপাত। পরবর্তীতে বোয়িং বিমানের আলাদা হয়ে যাওয়া পাখাও নিশ্চিত করে লেগেসি জেটের সাথে সংঘর্ষেই সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
কিন্তু দুটো বিমানের এ ধরনের সংঘর্ষ মোটেও স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। রাস্তায় যেমন গাড়ি চলার জন্য লেন আলাদা করা থাকে, আকাশে বিমান চলার জন্য তেমন উচ্চতা আলাদা করা থাকে। প্রতিটি বিমান একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় চলে, প্রতিটির মাঝে অন্তত এক হাজার ফুট দূরত্ব থাকে। এর বাইরেও দু’টো বিমান কাছাকাছি চলে এলে বিমানে ‘টিকাস’ নামে সতর্কবার্তা চালু হয়ে যায়। যখন দু’টি বিমান কাছাকাছি চলে আসে তখন একটি বিমানের টিকাস তাকে উপরে যেতে আর অপরটিকে নিচে যেতে বলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কিন্তু আমাজনের আকাশে ঘটে যাওয়া এ দুর্ঘটনায় উচ্চতা যেমন এক ছিল, ঠিক তেমনি কোনো বিমানেরই টিকাস কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি পাইলটদের।
পরবর্তীতে দেখা যায়, লেগেসি জেটের ট্রান্সপোন্ডার বন্ধ ছিল। ট্রান্সপোন্ডার একটি বিমানের উচ্চতা, বিমানের সাংকেতিক নম্বর, অবস্থান প্রভৃতি তথ্য বিমানবন্দরে এটিসির রাডারে পাঠায়। মূলত এর সাহায্যেই এটিসি বিমানগুলোকে ট্র্যাক করে থাকে। ট্রান্সপোন্ডার বন্ধ হয়ে গেলে প্রাথমিক রাডার দিয়ে বিমানকে ট্র্যাক করা হয়। কিন্তু প্রাথমিক রাডার ট্রান্সপোন্ডারের মতো নিখুঁত তথ্য দিতে পারে না। আর কাছাকাছি দুটো বিমানের একটিরও যদি ট্রান্সপোন্ডার বন্ধ থাকে তাহলে টিকাসও কাজ করে না! এই ট্রান্সপোন্ডার থেকেই বোঝা গেল কেন সেদিন পাইলটরা বুঝতে পারেনি দুটো বিমান সংঘর্ষের দিকে এগোচ্ছিলো। সেইসাথে পরিষ্কার হয় যে কেন ব্রাজিলিয়ার এটিসি রাডারে লেগেসি জেটকে দেখে মনে হয়েছিল বারবার ওঠানামা করছিল।
লেগেসি জেটের ককপিটে তদন্তকারীরা আরেকটি ব্যাপার খেয়াল করেন, যেটি আগে অন্য কেউ খেয়াল করলে হয়তো এই দুর্ঘটনা ঘটতোই না। লেগেসি জেটের ককপিট এমনভাবে নকশা করা, কো-পাইলটের পা লেগে ট্রান্সপোন্ডার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তার থেকেও ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে, ট্রান্সপোন্ডার যে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটি সতর্কবার্তা হিসেবে কোনো অ্যালার্ম নেই, রয়েছে একেবারে নিচের দিকে একটি মনিটর, যেখানে লেখা ওঠে ট্রান্সপোন্ডার বন্ধ রয়েছে। বিমান চালানোর সময় অ্যালার্মবিহীন সতর্কবার্তা পাইলটদের চোখ এড়িয়ে যাওয়া মোটেও অস্বাভাবিক ছিল না।
রাস্তায় গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য যেমন ট্রাফিক পুলিশ থাকে, আকাশে বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বের থাকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার। একেকজন কন্ট্রোলার একসাথে চার-পাঁচটি বিমান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতসব তথ্য পাবার পর স্বাভাবিকভাবেই তদন্তকারীরা এবার সেদিন ব্রাজিলিয়ায় থাকা কন্ট্রোলারকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আর এখানেই উঠে আসে ঘটনার বাকি অংশটুকু।
লেগেসি জেট যখন ব্রাজিলিয়ায় যোগাযোগের চেষ্টা করেছিল তখন তারা একদমই যোগাযোগ করতে পারেনি। লেগেসি জেটের ফ্লাইট প্ল্যান ছিল প্রথমে ৩৭,০০০ ফুট উচ্চতায় থেকে পরবর্তীতে ৩৬,০০০ ফুট উচ্চতায় নেমে যাওয়া। এ তথ্যটি পাইলটদের জানানোর দায়িত্ব এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের। ব্রাজিলিয়ার রাডার ছিল অন্য বিমানবন্দরের থেকে কিছুটা উন্নত। সাধারণত কোন বিমান কখন কোন উচ্চতায় থাকবে, এটি কন্ট্রোলার নিজে থেকে পাইলটকে জানিয়ে দেয় এবং রাডারে তথ্য আপডেট করে। কিন্তু ব্রাজিলিয়ার রাডারে ছিলো উল্টো। এখানে আগে থেকেই ফ্লাইট প্ল্যান ইনপুট দেয়া থাকে, সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উচ্চতা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন কন্ট্রোলারের কাজ হয় পাইলটকে জানানো। সেদিন দায়িত্বে থাকা কন্ট্রোলার ঠিক এখানেই ভুলটি করেছিল, পাইলটকে নিচে নামার কথা জানাতে ভুলে গিয়েছিল!
শুধু ভুলেই যায়নি, পরের শিফটে কাজ করতে আসা কন্ট্রোলারকেও বলেছিল লেগেসি জেট ৩৭,০০০ ফুট উচ্চতায় রয়েছে, এভাবেই থাকবে। ফলে পরে আসা কন্ট্রোলারও খেয়াল করেনি ভালোভাবে। তদন্তকারীরা আরো গভীরে গেলে দেখা যায়, ব্রাজিলের বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেয় না। সেইসাথে বেশিরভাগ সময়ে তাদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে হয়। এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের কাজ পৃথিবীর কঠিনতম কাজগুলোর একটি। এ ধরনের কাজে পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও প্রশিক্ষণ না থাকলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। লেগেসি জেট ও বোয়িং বিমানের সংঘর্ষ সেটিরই ফল। ব্রাজিলের তদন্তকারীরা শেষ পর্যন্ত দুই এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার ও লেগেসি জেটের পাইলটদের দোষী করে তাদের কাজ শেষ মনে করলেও আমেরিকার National Transportation Safety Board (NTSB) দুর্ঘটনার জন্য পাইলটদের দোষ দেয়নি। বরং ব্রাজিলিয়ার এটিসিতেই তারা সমস্যা দেখেছিল এবং সে অনুযায়ী এনটিএসবি তাদের তদন্ত রিপোর্ট জমা দেয়।
এ দুর্ঘটনা ব্রাজিলের ইতিহাসের অন্যতম বড় বিমান দুর্ঘটনাগুলোর একটি। স্বাভাবিকভাবেই এ দুর্ঘটনার পর ব্রাজিল তাদের এটিসিগুলোকে ঢেলে সাজায় নতুন করে। কন্ট্রোলারদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ অতিরিক্ত সময়ে কাজ না করার ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে। কিন্তু তারপরেও ব্রাজিলে বিমান দুর্ঘটনা বন্ধ হয়নি। এর থেকেও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে ব্রাজিলের মাটিতে ও আকাশে। সেগুলোর কথা নাহয় আরেকদিন বলা যাবে!
ফুটনোট:
১. National Geographic: Air Crash Investigation: Phantom Strike. (Season 5 Episode 10)
২. CINIPA: Final Report on midair collision (December 2008)
৩. NTSB: Final Report on Gol 1907 accident report (2009)