“আই থিঙ্ক রুবেল ইজ হ্যাপি নাও।”
অ্যাডিলেডে সেদিন সবাই ছুটছে। মাহমুদউল্লাহ, রুবেল, সাকিব সবাই। কিন্তু একপাশে শুয়ে পড়েছেন তিনি আর পরক্ষণেই তার উপর এসে পড়েছেন সবাই। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে কোয়ালিফাই করলো বাংলাদেশ। ম্যাচ শেষে মাথায় বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে গেলেন আর বললেন উপরের কথা।
ম্যাশকিন সেলিব্রেশন – তাসকিন আর মাশরাফির শূন্যে লাফিয়ে সেই সেলিব্রেশনের কথা জানেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। আর সেই সেলিব্রেশনটা আমরা পেয়েছিলাম আমরা সেই বিশ্বকাপেই। দুই দিক থেকে দুইজন এসে শূন্যে লাফ… আহা, এর থেকে সুন্দর জিনিস বোধহয় আর খুব কমই আছে।
পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত। এই ত্রয়ীর সাথে কখনোই সিরিজ জয় হয়নি আমাদের। বিশ্বকাপ শেষে ঘরে ফিরল বাংলাদেশ। তারপর শুরু পাকিস্তান সিরিজ। আর সিরিজ শেষ হলো ৩-০ বাংলাওয়াশ দিয়ে। তারপর ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে ২-১ ব্যবধানে জয়। তারপর আসলো জিম্বাবুয়ে, ফলাফল হোয়াইটওয়াশ। আর সব সিরিজে নেতৃত্বে ছিলেন মাশরাফি।
বলেছিলেন, টি-টোয়েন্টি দল নিয়ে কাজ করতে চান তিনি। ২০১৭ এর এপ্রিলে খেলতে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়৷ আর সেখানেই হুট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের। শ্রীলঙ্কা থেকে দেশে ফিরলেন, বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলন। সাংবাদিকদের সামনে বললেন,
“এখনও তো ওয়ানডে খেলছি। মজা হবে সেখানেই। ”
৯ জুন ২০১৭, চ্যাম্পিয়নস ট্রফি এর নবম ম্যাচ। কার্ডিফে নিউ জিল্যান্ডের মুখোমুখি বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করে বাংলাদেশকে টার্গেট দেয় ২৬৬ রানের। ব্যাটিংয়ে নেমে ৩৩ রানে গেলো ৪ উইকেট। তারপর শুরু কার্ডিফ-কাব্য। পঞ্চম উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের পার্টনারশিপ করলেন সাকিব আর মাহমুদউল্লাহ। হারতে বসা ম্যাচটি আমরা জিতে নিলাম পাঁচ উইকেটে। আর প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে আমরা। আর সেদিন ড্রেসিংরুমের বারান্দায় মাশরাফির সেই উচ্ছ্বাসটা চোখ এডিয়েছে হয়তো খুব কম মানুষেরই। কারণ, নেতৃত্বে যে ছিলেন তিনিই।
লিটন দাসের ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি সেদিন। ওপেনিংয়ে লিটনের সাথে গিয়েছিলো মেহেদি মিরাজ। লিটনের সেঞ্চুরির পর ড্রেসিংরুমের সামনে থেকে মাশরাফির সেই সাহস দেওয়ার ইঙ্গিতটা ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো সোশ্যাল মিডিয়ায়। আর সেই ইঙ্গিতটা হয়তো আপনাকে বাধ্য করেছিলো চোখের কোণে জল আনতে।
এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে হার, এবং আবার স্বপ্নভঙ্গ। কিন্তু তার আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তামিম যে সাহসটা দেখিয়েছেন, এর পেছনেও ছিলেন মাশরাফি। হাতে চোট পেয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরে গিয়েছিলেন তামিম। পরে মুশফিকের সঙ্গ দিতে হাতে প্লাস্টার নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। এক হাত দিয়ে খেলা সেই বল ছিল অজস্র মহাকাব্যর চেয়েও সুন্দর। ম্যাচ শেষে তামিম বলেছিলেন, ড্রেসিংরুমে প্রথম তাকে ব্যাটিংয়ের কথা বলেছিলেন মাশরাফি।
অবশেষে শিরোপা জিতলো বাংলাদেশ। মালাহাইডে উইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথম ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতলাম। ২০১২ এশিয়া কাপ ফাইনালে পাকিস্তানের সাথে হারের পর সাকিব-নাসিরের কান্নার ছবি এখনো হয়তো অনেকের মোবাইলের গ্যালারিতে রয়ে গেছে, না থাকলেও মনের দৃশ্যপটে তো না থেকেই পারে না। তারপর আবার দীনেশ কার্তিকের পাগলাটে উইলোর কাছে হার। সব দুঃস্মৃতির গ্লানি মুছে দিয়ে সেই মাশরাফির নেতৃত্বে শিরোপা জিতি আমরা।
টার্গেট এবার ২০১৯ বিশ্বকাপ।
শুরুটা ছিল সাউথ আফ্রিকার সাথে জয় দিয়ে। তারপর একদিকে সাকিব আল হাসান খেলে যাচ্ছেন তার ক্যারিয়ারসেরা ম্যাচগুলো, আর অন্যদিকে বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টোপথে। আর ক্যাপ্টেন থাকলেন বিবর্ণ, ৮ ইনিংসে মাত্র ১ উইকেট। বিশ্বকাপ শেষ হলো মাত্র ৩ জয় দিয়ে ৮ নম্বরে থেকে।
বিশ্বকাপের পর চোটের কারণে খেলেননি শ্রীলঙ্কার সাথে সিরিজ। এরপর লম্বা সময় পর জিম্বাবুয়ে সিরিজের মাঠে নামলেন আর ইতি টানলেন অধিনায়কত্বের। মহাকাব্যর সমাপ্তি। কাপ্তান হিসেবে জয়ের হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করলেন। বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে সবচেয়ে বেশি জয়ের মালিক হয়ে উঠলেন এই মাশরাফি। ম্যাচ শেষ হলো, সবাই এলো মাঠে। পেছনে লেখা ‘মাশরাফি ০২’, আর সামনে ‘থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন’।
পুরো স্টেডিয়ামে সেদিন তৈরি হয়েছিল অন্যরকম এক আবহ। বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশের নায়ক তার হাতের ব্যাটনটা তুলে রাখলেন। গোল্ডেন কয়েন হাতে আর টসে নামবেন না তিনি, নামবেন একজন সাধারণ প্লেয়ার হিসেবে। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন জার্সির কলার তুলে বাইশ গজে সুইংয়ের ঝড় তোলা থেকে সরে আসবেন। আর বেশিদিন হয়তো নেই, যখন মাঠের কোথাও দেখা যাবে না দুই নাম্বার জার্সিটা। ধন্যবাদ ‘ক্যাপ্টেন ফ্যান্টাসটিক’, সব কিছুর জন্য।