১.
ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের যাত্রা শুরু হয়েছিলো ২০০৮ সালে। কলকাতা নাইট রাইডার্স বনাম রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে আইপিএল মাঠে গড়ায়। বলিউডের অন্যতম তারকা শাহরুখ খান এবং সৌরভ গাঙ্গুলির মতো জনপ্রিয় ক্রিকেটার কলকাতার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকার কারণে বাংলাদেশে কলকাতার জনপ্রিয়তা আইপিএলের অন্যান্য দলের চেয়ে বেশি। তাছাড়া একই ভাষাভাষী হওয়ার দিকটাও জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।
২০০৯ সালে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা আইপিএলে নিষিদ্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের পেসার মাশরাফি বিন মর্তুজাকে চড়া দামে দলে অন্তর্ভুক্ত করে কলকাতা নাইট রাইডার্স। মাশরাফি অবশ্য ইনজুরির কারণে এক মৌসুমের বেশি খেলতে পারেননি। পরের বছরেই তাকে ছেড়ে দেয় কলকাতা। আইপিএলের প্রথম তিন আসরে কলকাতার দলগত নৈপুণ্য ছিলো যাচ্ছেতাই। ২০০৮ সালে প্রথম আসরে আট দলের মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থানে, দ্বিতীয় আসরে আট দলের মধ্যে ৮ম স্থানে এবং তৃতীয় আসরে ৬ষ্ঠ স্থানে থেকে মৌসুম শেষ করেছিল তারকা ক্রিকেটারদের দিয়ে ঠাসা দলটি।
২.
২০১১ সালে আইপিএলের চতুর্থ আসরে বাংলাদেশের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিলামে কিনে নেয় কলকাতা নাইট রাইডার্স। এই আসরে আইপিএলে মোট দল সংখ্যা ছিলো দশটি। প্রথম তিন আসরে সুবিধা করতে না পারা সাকিবের কলকাতা ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছিল।
সাকিব আল হাসান আইপিএলে নিজের প্রথম মৌসুমে সাতটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। মূলত বোলিং অলরাউন্ডার হিসাবেই তাকে একাদশে রাখে কলকাতা।
সাত ম্যাচের মধ্যে মাত্র তিন ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। লোয়ার মিডল-অর্ডারে তিন ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ১৪.৫০ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৩১.৮১ স্ট্রাইক রেটে ২৯ রান করেছিলেন সাকিব। বল হাতে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ৭ ম্যাচে ৬.৮৬ ইকোনমি রেট ও ১৫.৯০ বোলিং গড়ে তার উইকেট সংখ্যা ছিল ১১।
২০১২ সালে কলকাতা নাইট রাইডার্স প্রথমবারের মতো আইপিএলের শিরোপা জিতে নেয়। চ্যাম্পিয়ন দলে সাকিব আল হাসানও ছিলেন। তিনি ঐ আসরে আট ম্যাচ খেলে দুবার ম্যাচ সেরার পুরস্কারও জিতেছিলেন। আইপিএলে এখন পর্যন্ত ঐ দুবারই ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন তিনি। প্রথমবারের মতো ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন আসরের ১৫ তম ম্যাচে রাজস্থান রয়্যালসের বিপক্ষে। বল হাতে রাহুল দ্রাবিড় এবং অজিঙ্কা রাহানের উইকেটসহ মাত্র ১৭ রানের বিনিময়ে ৩ উইকেট শিকার করেছিলেন। এরপর ব্যাট হাতে ১০ বলে দ্রুত ১৬ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন সাকিব আল হাসান।
আইপিএলে সাকিব দ্বিতীয় এবং শেষবারের মতো ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছিলেন একই আসরের ৭০ তম ম্যাচে। পুনে ওয়ারিয়র্সের বিপক্ষে তিনি ব্যাট হাতে গুরুত্বপূর্ণ ৪২ রানের ইনিংস খেলার পর বল হাতে মাত্র ১৮ রানের বিনিময়ে ২ উইকেট শিকার করে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জেতেন। এই ম্যাচে সাকিব আল হাসান চার নাম্বারে ব্যাট করার সুযোগ পেয়ে ৩০ বলে ৩টি চার এবং ২টি ছয়ের মারে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৪২ রান করেছিলেন। পুনের স্লো উইকেটে তার ৪২ রানের ইনিংস সত্ত্বেও কলকাতা ১৩৬ রান সংগ্রহ করেছিলো। শেষপর্যন্ত সাকিবসহ দলের অন্যান্য বোলারের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ৩৪ রানের সহজ জয় পায় কলকাতা।
সাকিব আল হাসান ২০১২ সালে আট ম্যাচ খেলে ৯১ রান করেছিলেন। তার রান সংখ্যা কম মনে হলেও প্রতিটি রান ছিলো গুরুত্বপূর্ণ। ফাইনালে তার ৭ বলে অপরাজিত ১১ রানের ইনিংসের উপর ভর করেই জয়ের বন্দরে পৌঁছায় কলকাতা। ফাইনালে চেন্নাইয়ের বিপক্ষে ১৯১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে কলকাতা ২ বল হাতে রেখে জয় তুলে নেয়। জ্যাক ক্যালিস এবং বিসলার দুর্দান্ত ব্যাটিংয়ের পর দ্রুত ৪ উইকেট হারানোর পর তীরে এসে তরী ডোবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল কলকাতার। শেষপর্যন্ত মনোজ তেওয়ারি এবং সাকিব কোনো অঘটন ঘটতে দেননি।
ব্যাটিংয়ে তার রান সংখ্যা কম হলেও বল হাতে দুর্দান্ত আসর কাটিয়েছিলেন সাকিব। ৮ ম্যাচে মাত্র ৬.৫০ ইকোনমি রেট এবং ১৬.২৫ বোলিং গড়ে ১২ উইকেট শিকার করেছিলেন। ফাইনালেও যখন দলের অন্যান্য বোলাররা ওভারে দশের কাছাকাছি রান দিয়েছিলেন, তখনও তিনি তিন ওভারে ২৫ রান খরচায় ১ উইকেট শিকার করেছিলেন।
৩.
সাকিব আল হাসান ২০১৩ সালের আইপিএলে কোনো ম্যাচ খেলেননি। ঐ মৌসুমে তার দল কলকাতা নাইট রাইডার্সও খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। নয় দলের মধ্যে তাদের অবস্থান ছিলো ৭ম।
২০১৪ সালে সাকিব প্রায় সব ম্যাচেই দলের একাদশে ছিলেন। ফলে তার দল কলকাতা নাইট রাইডার্স দ্বিতীয়বারের মতো আইপিএলের ট্রফি ঘরে তোলে।
ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব আল হাসান ২০১৪ সালে ১৩ ম্যাচ খেলে ম্যাচ সেরার পুরস্কার পাননি ঠিকই। তবে দলের শিরোপা জয়ে তার অবদান উল্লেখযোগ্য। তিনি ঐ আসরে সবচেয়ে দামী ক্রিকেটারদের মধ্যে ২৩৮.৫ পয়েন্ট নিয়ে ৬ষ্ঠ স্থানে অবস্থান করেছিলেন। সব ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে তার অবস্থান আর উপরে হতো।
২০১৪ সালে সাকিব ১৩ ম্যাচ খেলে ৩২.৪২ ব্যাটিং গড়ে এবং ১৪৯.৩৪ স্ট্রাইক রেটে ২২৭ রান করেছিলেন। বল হাতেও সফল ছিলেন তিনি। মিতব্যয়ী বোলিং করার পাশাপাশি উইকেটও শিকার করেছিলেন তিনি। মাত্র ৬.৬৮ ইকোনমি রেটে ১১ উইকেট শিকার করেছিলেন তিনি।
আসরে তিনি বেশ কয়েকটি ম্যাচে পার্শ্ব-নায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন। আসরের ৪৭তম ম্যাচে চেন্নাই সুপার কিংসের বিপক্ষে মাত্র ৬টি চার এবং ২টি ছয়ের মারে অপরাজিত ৪৬ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। চেন্নাইয়ের দেওয়া ১৫৫ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে কলকাতা ৯৮ রানের মাথায় দ্বিতীয় উইকেট হারালে ব্যাটিংয়ে নামেন সাকিব। তখন জয়ের জন্য কলকাতার প্রয়োজন ছিলো ৫৭ রানের। এর মধ্যে সাকিব একাই করেন ৪৬ রান। এরপরের ম্যাচে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে আইপিএলে নিজের প্রথম অর্ধশতকের দেখা পান তিনি। ব্যাঙ্গালোরের বিপক্ষে মাত্র ৩৮ বলে ৫টি চার এবং ৩টি ছয়ের মারে ৬০ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি।
আসরের ফাইনালেও দলের জয়ে অবদান রেখেছিলেন তিনি। ফাইনালে প্রথমে ব্যাট করতে নামা কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব কলকাতার সব বোলারকে তুলোধোনা করছিল। এর মধ্যে শুধু ব্যতিক্রম ছিল সাকিবের বেলায়। পাঞ্জাবের ১৯৯ রানের সংগ্রহে যেখানে দলের অন্যান্য বোলাররা ওভারপ্রতি দশ, এগারো করে রান খরচ করছিলেন। তখন সাকিব ৬.৫০ ইকোনমি রেটে মাত্র ২৬ রান খরচ করেন। এরপর ব্যাট হাতে রান আউট হওয়ার আগে মাত্র ৭ বলে ১২ রান করেছিলেন তিনি।
৪.
২০১৫ সালের আইপিএলে সাকিব আল হাসান মাত্র চার ম্যাচ খেলেছিলেন। সাকিব নিয়মিত না খেলাতে কাকতালীয়ভাবে এই আসরেও শেষ চার উঠতে পারেনি কলকাতা। ২০১৬ সালের আসরে সাকিব ব্যাটে-বলে খুব একটা ভালো সময় না কাটালেও নিয়মিত খেলেছিলেন। কলকাতাও শেষ চারে জায়গা করে নিয়েছিলো। এই আসরে সাকিব দশ ম্যাচে মাত্র ৫ উইকেট শিকার করার পাশাপাশি ব্যাট হাতে ২২.৮০ গড়ে ১১৪ রান করেছিলেন, যার মধ্যে এক ইনিংসেই করেছিলেন অপরাজিত ৬৬ রান।
গুজরাট লায়ন্সের বিপক্ষের আসরের ৩৮তম ম্যাচে টসে হেরে প্রথমে ব্যাট করার আমন্ত্রণ পায় কলকাতা। ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ব্যাটিং বিপর্যয়ে সাকিবের দল। মাত্র ২৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসে তারা। এরপর সাকিব এবং ইউসুফ পাঠান ৫ম উইকেট জুটিতে অবিচ্ছিন্ন ১৩৪ রানের জুটি গড়ে দলকে ১৫৮ রানের পুঁজি এনে দেন, যার মধ্যে সাকিব ৪৯ বলে চারটি চার এবং চারটি ছয়ের মারে অপরাজিত ৬৬ রান করেন, যা আইপিএলে তার সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
২০১৭ সালে সাকিব আল হাসান আইপিএলে মাত্র এক ম্যাচ খেলেছেন। এরপরের আসরে কলকাতা নাইট রাইডার্স তাকে ছেড়ে দেয়। ২০১৮ সালের নিলামে সাকিবকে কিনে নেয় সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ। তাকে পেয়ে হায়দ্রাবাদের টিম ম্যানেজমেন্ট বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলো। রশিদ খানের সাথে দ্বিতীয় স্পিনার হিসাবে তাকে খেলানো এবং সেই সাথে মিডল-অর্ডারেও তাকে নিয়মিত খেলানোর পরিকল্পনা করে রেখেছিল হায়দ্রাবাদ।
৫.
সাকিব আল হাসান প্রথমবারের মতো আইপিএলের সবক’টি ম্যাচ খেলেন ২০১৮ সালে। সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে ১৭টি ম্যাচে ১২১.৩১ স্ট্রাইক রেটে এবং ২১.৭২ ব্যাটিং গড়ে ২৩৯ রান সংগ্রহ করেছিলেন তিনি, যা আইপিএলে এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড। বল হাতে রশিদ খানের সাথে জুটি বেঁধে বেশ সফল ছিলেন তিনি। ১৭ ম্যাচে ৩২.৫৭ বোলিং গড়ে তিনি ১৪ উইকেট শিকার করেছিলেন। উইকেটের দিক থেকেও এক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েছিলেন হায়দ্রাবাদের হয় প্রথম আসরে। টুর্নামেন্টে তিনি ২৩৭ পয়েন্ট নিয়ে সবচেয়ে দামী ক্রিকেটারদের তালিকায় ১১তম স্থানে অবস্থান করেছিলেন। তার ব্যাটে-বলে ধারাবাহিক নৈপুণ্যে হায়দ্রাবাদ রানার্সআপ হয়।
২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাকিব আল হাসান কলকাতা নাইট রাইডার্স এবং সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে মোট ৬০ ম্যাচ খেলেন। ব্যাট হাতে ১২৭.২৮ স্ট্রাইক রেট এবং ২১.৬৭ ব্যাটিং গড়ে ৭৩৭ রান করার পাশাপাশি ৫৭ উইকেট শিকার করেছেন ২৭.৩১ বোলিং গড়ে। আইপিএলে ৫০০ রান করার পাশাপাশি ৫০ উইকেট শিকার করেছেন মাত্র ১৩ জন অলরাউন্ডার। এর মধ্যে সাকিব আল হাসান একজন। আইপিএলের ১২তম আসরেও সাকিব আল হাসান সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
আইপিএলে ৫০০ রান এবং ৫০ উইকেট শিকার করা ক্রিকেটাররা
- শেন ওয়াটসন – ১১৭ ম্যাচে ৩,১৭৭ রান এবং ৯২ উইকেট
- কাইরন পোলার্ড – ১৩২ ম্যাচে ২,৪৭৬ রান এবং ৫৬ উইকেট
- জ্যাক ক্যালিস – ৯৮ ম্যাচে ২,৪২৭ রান এবং ৬৫ উইকেট
- রবীন্দ্র জাদেজা – ১৫৪ ম্যাচে ১,৮২১ রান এবং ৯৩ উইকেট
- ডোয়াইন ব্রাভো – ১২২ ম্যাচে ১,৪০৩ রান এবং ১৩৬ উইকেট
- ইরফান পাঠান – ১০৩ ম্যাচে ১,১৩৯ রান এবং ৮০ উইকেট
- অ্যালবি মরকেল – ৯১ ম্যাচে ৯৭৪ রান এবং ৮৫ উইকেট
- হরভজন সিং – ১৪৯ ম্যাচে ৮২৮ রান এবং ১৩৪ উইকেট
- সাকিব আল হাসান – ৬০ ম্যাচে ৭৩৭ রান এবং ৫৭ উইকেট
- আক্সার প্যাটেল – ৬৮ ম্যাচে ৬৮৬ রান এবং ৬১ উইকেট
- সুনীল নারিন – ৯৮ ম্যাচে ৬২৮ রান এবং ১১২ উইকেট
- পিযুষ চাওলা – ১৪৪ ম্যাচে ৫৪২ রান এবং ১৪০ উইকেট
- জেমস ফকনার – ৬০ ম্যাচে ৫২৭ রান এবং ৫৯ উইকেট