“২০১২ সালের ২১ ডিসেম্বর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে” এই ভবিষ্যদ্বাণীর সঙ্গে আমরা কম-বেশি সবাই মোটামুটি পরিচিত। এর পেছনে পৃথিবীর সবথেকে প্রাচীন এক রহস্যময় সভ্যতা জড়িত; ইতিহাসের পাতায় এ সভ্যতার নাম মায়া সভ্যতা। রহস্যের চাদরে আচ্ছাদিত এই সভ্যতার মানুষেরা শুধু ভবিষ্যদ্বাণী পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যশিল্প, নানারকম চিত্রকর্ম, বর্ষপঞ্জিকা, সংখ্যা গণনা, গণিত- সবকিছুতেই তাদের পদার্পণ ছিল অভাবনীয়। আর এই রহস্যময় মায়া সভ্যতাকে কেন্দ্র করেই গ্রাহাম ব্রাউন ‘দ্য মায়ান কনস্পিরেসি’ বইটিতে গল্পের পরিধি রচনা করেন। বইটি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন অসীম পিয়াস।
গল্প প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে কোল্ড ফিউশন সম্পর্কে হালকা ধারণা দেয়া প্রয়োজন। যে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ায় দুটি হালকা নিউক্লিয়াস একত্রিত হয়ে অপেক্ষাকৃত একটি ভারি নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং প্রচুর পরিমাণে শক্তি নির্গত হয়, সেটিই নিউক্লিয়ার ফিউশন। এ বিক্রিয়া ঘটানোর জন্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। আর কোল্ড ফিউশন হলো একপ্রকার নিউক্লিয়ার ফিউশন, যা কক্ষ তাপমাত্রা এবং স্বাভাবিক চাপে সংঘটিত হয়। এর ধারণা প্রথম আসে ১৯৮৯ সালে। তবে সেসময় বিজ্ঞানীরা আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায় প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে আবারো এ প্রজেক্ট নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা শুরু করেন, যা এখন পর্যন্ত চলমান।
এই কোল্ড ফিউশনের প্রধান কয়েকটি সুবিধা হলো প্রচুর জ্বালানি শক্তি যা ভবিষ্যত পৃথিবীকে অফুরন্ত জ্বালানি যোগান দিতে সক্ষম হবে, কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্যাস নির্গত হয় না ফলে জলবায়ুর উষ্ণতাও বৃদ্ধি পাবে না, এবং পারমাণবিক বর্জ্য উৎপন্ন হয় না তাই পরিবেশ দূষিত হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।
কাহিনীসংক্ষেপ
ন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা এনআরআই আমেরিকার একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান কাজ হচ্ছে পুরো পৃথিবী চষে বেড়িয়ে আমেরিকার জন্য যা ভালো- তা হাসিল করে নেওয়া। সম্পর্ক উন্নয়ন, চুরি, ডাকাতি কিংবা যুদ্ধ করে হলেও তারা তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য বদ্ধপরিকর।
১৯২৭ সাল; ব্ল্যাকজ্যাক মার্টিন নামের একজন আমেরিকান আমাজন জঙ্গল থেকে খোদাইকৃত কিছু পাথর, স্ফটিক এবং একটা স্বর্ণের ট্রে নিয়ে ফিরে আসে। প্রায় ১০০ বছর পর মার্টিনের উদ্ধারকৃত এই জিনিসগুলো এনআরআইয়ের কাছে চলে আসে। গবেষণায় তারা দেখতে পায়, উদ্ধারকৃত জিনিসগুলো প্রাচীন মায়া সভ্যতার নিদর্শন এবং স্ফটিকগুলো থেকে ট্রিশিয়াম নামের একপ্রকার বায়বীয় গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছিল। কিন্তু ট্রিশিয়াম গ্যাস শুধুমাত্র পারমাণবিক বিক্রিয়ার ক্ষেত্রেই উৎপন্ন হয়। তাহলে স্ফটিকগুলো থেকে ট্রিশিয়াম উৎপন্ন হওয়ার রহস্য কী? গবেষক দলের ধারণা, স্ফটিকগুলো যে জায়গা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেখানে কোনো শীতল ফিউশনের উৎস রয়েছে কিংবা শীতল ফিউশন ঘটানো যাবে- এরকম কোনো যন্ত্র সেখানে রয়েছে। যদি সত্যিই এরকম কোনো যন্ত্র থেকে থাকে আর তা যদি হাসিল করা যায়; পুরো পৃথিবীকে যে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসা যাবে, তা বলাই বাহুল্য!
আমাজনের গহীনে লুক্কায়িত এই রহস্য অন্বেষণের দায়িত্ব বর্তায় এনআরআরআইয়ের ফিল্ড অপারেটিভ ড্যানিয়েল লেইডল এবং আরনল্ড মুরের উপর। কিন্তু আচমকা আরনল্ড মুরকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। লেইডলের সঙ্গী হয় হকার নামের একজন প্রাক্তন সিআইএ কর্মী, সাউথ আফ্রিকার একজন ভাড়াটে সৈনিক ভেরহোভেন এবং তার দক্ষ লোকবল, প্রফেসর ম্যাককার্টার এবং তার ছাত্রী সুসান, রেডিও টেকনিশিয়ান হিসেবে মার্ক পোলাস্কি, আদিবাসীদের ভাষায় দক্ষ ডেভারস ক’জন কুলি।
কেন জানি গোপন মিশনে গোপনীয়তা রক্ষা করাই অনেক বড় কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়ায়। এনআরআই দল গোপনীয়তা রক্ষা করতে ব্যর্থ হলো। তাদের থেকেও এককদম এগিয়ে আছে কফম্যান এবং তার ভাড়াটে সেনারা। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, যদি শীতল ফিউশনের উৎস সত্যিই থেকে থাকে, যুদ্ধ করে হলেও তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ চাই।
আবার মার্টিনের উদ্ধারকৃত হাতিয়ারগুলো মায়ানদের আদি বাসস্থান আল জয়ুয়ানকে নির্দেশ করে। মায়ানদের স্বর্গ হিসেবে পরিচিত আল জয়ুয়ানকে ‘চোলোকোয়ান’ নামের এক হিংস্র মানবগোষ্ঠী পাহারা দেয়। বহিরাগত কেউ এই জায়গায় প্রবেশ করলে, ভাগ্য খুব সুপ্রসন্ন না হলে সহজে কেউ বেঁচে ফিরে আসতে পারে না। এর আগেও এনআরআইয়ের একটি দল আমাজনে গিয়েছিল। একজন বাদে কেউই বেঁচে ফিরে আসতে পারেনি। ফিরে আসা ব্যক্তিটি এখন প্রলাপ বকে!
সত্যিই কি আল জয়ুয়ানে শীতল ফিউশনের উৎস রয়েছে? মায়ানদের সাথেই বা এর কানেকশন কোথায়? কী এমন ঘটেছিল এনআরআইয়ের প্রথম দলের সঙ্গে? মুরকে কেন দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হলো? ব্যক্তিগত স্বার্থ, নাকি দেশের স্বার্থ? কফম্যান এবং লেইডলের দলের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল? সব প্রশ্নের উত্তর রয়েছে ‘দ্য মায়ান কনস্পিরেসি’তে।
পাঠ প্রতিক্রিয়া
আমাজন জঙ্গল, মায়া সভ্যতা, শীতল ফিউশন- এই বই ইতিহাস, বিজ্ঞান বা রোমাঞ্চপ্রেমী পাঠকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার জন্য এই তিনটি বিষয়ই যথেষ্ট। কাঠমানবের কাহিনী থেকে শুরু করে মায়ানদের অদ্ভুত সব পৌরাণিক কাহিনী, আমাজনের বিপদসংকুল পরিবেশে টিকে থাকা, অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার সবকিছুর মিশেলে চমৎকার একটা প্লট ছিল এই বইয়ে। লেখক মায়ানদের পৌরাণিক বিষয়গুলো গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, বিরক্তবোধের আশঙ্কা নেই। পড়ার সময় বারবার মনে হবে যেন পাঠক তাদের দলেরই একজন সদস্য। এই বই পাঠককে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আঁকড়ে ধরে রাখার আকর্ষণী ক্ষমতা রাখে।
নির্দিষ্ট করে কাউকে কেন্দ্রীয় চরিত্রের আসনে বসানো যাবে না। পড়তে গিয়ে কখনো মনে হবে ড্যানিয়েল, কখনো বা হকার, আবার কখনো ম্যাককার্টার। তবে এরা প্রত্যেকেই প্রতিকূল পরিবেশে ঠাণ্ডা মাথার পরিচয় দিয়েছিল। অন্যদিকে ভেরহোভেনের মাঝে একটু খ্যাপাটে স্বভাব লক্ষ্য করা যায়; একজন সৈনিকের স্বভাবজাতই মনে হয় তা।
তবে সবচেয়ে হতাশার দিক হলো, আমাজনের আবহ তুলে ধরতে এই বই মোটামুটি ব্যর্থ। পুরো পৃথিবীর জঙ্গলের এক রূপ আর আমাজনের যে আরেক রূপ; এই দিকটায় লেখক যদি একটু মনোযোগ দিতেন, তাহলে বইটি আরো বেশি মানানসই হতো। তবে পৌরাণিক দানবগুলোর সঙ্গে লড়াইয়ের মুহূর্তটুকু; একদম মন্ত্রমুগ্ধের মতো লাগবে। এই অংশটুকু আলাদা প্রশংসার দাবি রাখে।
অনুবাদের কথা বললে, অসীম পিয়াসের অনুবাদ শুরুর দিকে একটু খাপছাড়া মনে হয়। কিছু শব্দের অযাচিত ব্যবহার সহজ বাক্যকে দুর্বোধ্য করে তোলে। পরে অবশ্য তিনি তার ছন্দে ফিরে আসেন। পড়তে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। সব মিলিয়ে, অনুবাদ ভালো ছিল। তবে আরো ভালো হতে পারত।
“সামনের পৃথিবীতে আমরা থাকবো না, থাকবে অন্যরকম কেউ।”
আপনি যদি অ্যাকশন ও অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী হয়ে থাকেন, পৌরাণিক কাহিনী যদি আপনার ভালো লাগে, মায়ানদের সম্পর্কে আপনার আগ্রহ যদি হয় আকাশচুম্বী- নির্দ্বিধায় আপনি এ বই নিয়ে বসতে পারেন। আশা করি, ভালো একটা সময় পার করবেন।
বই: দ্য মায়ান কনস্পিরেসি
লেখক: গ্রাহাম ব্রাউন
অনুবাদক: অসীম পিয়াস
প্রকাশনী: রোদেলা
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩৬৭