যুদ্ধক্ষেত্রে সাবমেরিন যে কী মারাত্মক ভূমিকা রাখতে পারে, তা আধুনিক নৌ সমরবিদদের অজানা নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আটলান্টিক জুড়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর সাথে জার্মান সাবমেরিনের যুদ্ধগুলোর কথা অনেকেই মনে রেখেছেন। কাজেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুই পরাশক্তি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সাবমেরিনের পেছনে মরিয়া হয়ে টাকা ঢালবে সেটাই স্বাভাবিক।
এই পটভূমিতেই সমুদ্রে নামে আকুলা নামের বিশালকায় এক সাবমেরিন। সোভিয়েত নৌবিদ্যার সর্বশ্রেষ্ঠ এই নিদর্শনটি আশি ও নব্বইয়ের দশকে সমুদ্র রাজত্ব করে বেড়িয়েছে। বলে রাখা ভালো, আকুলা ক্লাস হিসেবে যে সাবমেরিনের কথা এখানে বলা হচ্ছে তার পোশাকী নাম প্রজেক্ট ৯৪১। মার্কিনরা এই সাবমেরিনগুলোকে ‘টাইফুন ক্লাস’ হিসেবে অভিহিত করে। মূলত বিভিন্ন দেশে নৌযানের প্রকারভেদ করার ধরনে ভিন্নতা থাকার কারণে নামের ক্ষেত্রে এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।
পটভূমি
গোটা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ব্যালিস্টিক মিসাইল বহন করতে সক্ষম এমন সাবমেরিন নির্মাণ করতে শুরু করে। এর পেছনে মূল কারণ ছিল পরমাণু বোমা। সোভিয়েত ও মার্কিন কর্তারা ভাবতেন প্রতিপক্ষ সর্বদা কোনো ছুতায় তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করছে, তাই হাতের কাছে পর্যাপ্ত অস্ত্র থাকা প্রয়োজন। পরমাণু বোমার মতো বিদ্ধংসী অস্ত্রের আচমকা হামলার শিকার হলে পাল্টা হামলা চালানোর জন্য অস্ত্র মজুত রাখাও প্রয়োজন। এ কাজের জন্য দেখা গেল সাবমেরিন খুবই উপযুক্ত। বিশেষ করে উত্তর মেরুর হীমশীতল বরফের নিচে ঘাপটি মেরে থাকা ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিন যে মারাত্মক এক আতংকের নাম, তা দুই দলই জানতো।
এসব সাবমেরিন যেহেতু দীর্ঘদিন পানির নিচে থাকে, তাই তাদের জ্বালানীও লাগে প্রচুর। তাই সাবমেরিনগুলোতে পরমাণু চুল্লী বসানো শুরু করা হলো। কাজটায় প্রথমে সফল হয় যুক্তরাষ্ট্র। তাদের নটিলাস সাবমেরিন একনাগাড়ে দুই সপ্তাহ পানির তলায় থাকতে পারতো। পরমাণু চুল্লীতে জ্বালানী লাগে খুবই সামান্য। ফুয়েল রডগুলো তেজষ্ক্রিয়তার কারণে প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়। উত্তপ্ত রডে পানি ঢালা হলে তৈরি হয় বিপুল পরিমাণ বাষ্প। এই বাষ্পকেই বিশেষভাবে ব্যবহার করে চালানো হতো সাবমেরিন।
সোভিয়েত কে-১৯ বা নভেম্বর ক্লাস সাবমেরিনগুলো ছিল বেশ নিম্নমানের। তাছাড়া এই সাবমেরিনগুলোর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল, এগুলো সাগরের নিচে যাবার সময় প্রচণ্ড শব্দ করতো, ফলে মার্কিন সাবমেরিনের সোনার (Soner) খুব সহজে বুঝে ফেলতো তাদের অবস্থান।
সত্তরের দশক। যুক্তরাষ্ট্র ওহায়ো ক্লাস সাবমেরিন সাগরে নামাবে নামাবে করছে। সাড়ে পাঁচশো ফুট লম্বা এই সাবমেরিনগুলো ছিল তখনকার দিনের বৃহত্তম সাবমেরিন। একনাগাড়ে পানির তলায় ২৪টি পরমাণু বোমাবাহী ট্রাইডেন্ট মিসাইল (পাল্লা প্রায় ৪,৬০০ মাইল) নিয়ে নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াতো এই সাবমেরিনগুলো। এরই পাল্টা জবাব হিসেবে সত্তরের দশকে এক ভাষণে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান লিওনিড ব্রেজনেভ ঘোষণা দেন, শীঘ্রই তার দেশ বিরাট এক পরমাণু বোমাবাহী নিউক্লিয়ার ইঞ্জিন সম্পন্ন সাবমেরিন বানাবে।
ফলশ্রুতিতে ১৯৮১ সালে জলে নামে আকুলা। রুশ ভাষায় এর অর্থ হাঙ্গর। মার্কিন ও ইউরোপীয়রা রীতিমত হতভম্ব হয়ে পড়ে, কারণ তাদের ধারণা ছিল এই ধরনের অত্যাধুনিক সাবমেরিন বানাবার মতো সক্ষমতা অর্জন করতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কম করে হলেও আরো দশ বছর সময় লাগবে।
আকুলার খুটিনাটি
সোভিয়েতদের নৌসীমা ছিল বিশাল। কাজেই তাদের প্রয়োজন ছিল বড় আকারের একটি সাবমেরিন। তাছাড়া সোভিয়েতদের পরমাণু বোমাবাহী ব্যালিস্টিক মিসাইল আর-৩৯ এর ভর ছিল অনেক বেশি। ৫৭৪ ফুট লম্বা এই সাবমেরিনের ভর হলো ৪৮ হাজার টন। ২২ নট গতি নিয়ে আকুলা ছিল সে সময়ের সবচেয়ে দ্রুতগামী সাবমেরিনগুলোর একটি। পানির তলায় ডুবন্ত অবস্থায় এরা ২৭ নট বেগে চলতে পারতো।
জাপানি সাবমেরিনের মতো আকুলার দেহও কয়েক প্রস্থ আবরণ একটির ওপর আরেকটি দিয়ে বানানো হয়েছে। এতে সুবিধা হলো বাইরের আবরণটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও গোটা সাবমেরিন অচল হয়ে পড়ে না। এ কারণে সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো অপেক্ষাকৃত চওড়া হতো। আকুলার সামনের মজবুত অংশ উত্তর মেরুর শীতল বরফ ভেঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার মতো করে বানানো হয়েছিল।
আকুলাতে বসানো দুটি পরমাণু চুল্লীর প্রত্যেকটি ২ লক্ষ ৫৫ হাজার হর্স পাওয়ার শক্তি উৎপাদন করতো। এই পরিমাণ শক্তি দিয়ে ছোটখাট একটা শহরের বিদ্যুতের প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলা যায়। চার মাস (১২০ দিন) ধরে প্রায় শ’দেড়েক মানুষ আরাম আয়েশ করে থাকতে পারতো এখানে। ছিল বিশেষ সুইমিং পুল, জিমনেশিয়াম, ইনডোর খেলার জায়গা। যেন সাগরের তলায় এক চলন্ত সামরিক ঘাঁটি। ১০টি ১০০ কিলোটন পরমাণু বোমা (প্রত্যেকটি হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত লিটল বয়-এর তুলনায় ছয়গুণ বেশি শক্তিশালী) বইতে পারতো এই সাবমেরিনের আর-৩৯ মিসাইলগুলো।
একেকটি আর-৩৯ মিসাইল লম্বায় ৫৩ ফুট, ওজনে ৮৪ টন, পাল্লা দিতে পারতো ঝাড়া ৮,৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব। এর মানে আর-৩৯ মিসাইল উত্তর মেরুর যেকোনো অঞ্চল থেকে মূল মার্কিন ভূখন্ডে আঘাত হানতে পারে। এরকম ২০টি মিসাইল মজুত থাকতো একেকটি আকুলাতে। এর বাইরেও থাকতো একাধিক টর্পেডো মিসাইল। প্রয়োজনে এতে বিমান বিধ্বংসী মিসাইলও বসানোর ব্যবস্থা ছিল। আকুলার সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এগুলো অন্য সোভিয়েত সাবমেরিনের তুলনায় প্রায় নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারে। সব মিলিয়ে বলা যায় আশির দশকে শ্রেষ্ঠ সাবমেরিন ছিল এই আকুলা ক্লাসের বিরাট যানগুলো।
রাজনীতি, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র
মোট ছয়টি আকুলা বানানো হয়েছিল আশি ও নব্বইয়ের দশকে। একেকটি বানাতে খরচ হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে এই কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢেলে বানানো বিশাল সাবমেরিন স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী রুশ সরকারের কাছে শ্বেত হস্তীসম হয়ে ওঠে। একে একে সবগুলো আকুলা সাবমেরিনকে অবসরে পাঠানো হয়। কেবল দিমিত্রি দোনস্কোই এখনো সাগর চষে বেড়াচ্ছে। রাশিয়া ইতোমধ্যেই বোরেই ক্লাসের সর্বাধুনিক সাবমেরিন বানিয়ে ফেলায় ধরে নেওয়া যায় আকুলা ক্লাস সাবমেরিনের সামরিক জীবন শেষ হয়ে আসছে। ২০১২ সালে সাবমেরিনগুলো আধুনিকায়নের প্রস্তাব বাতিল করা হয়।
রাশিয়া এই বিরাট সাবমেরিনগুলোকে নিয়ে কী করবে তা বুঝে উঠতে পারছেন না কর্তারা। কখনো প্রস্তাব ওঠে তাদেরকে দিয়ে সাগরের তলদেশ দিয়ে উত্তরের তুষার রাজ্যের শহরগুলোতে পণ্য পাঠানোর, আবার কখনো প্রস্তাব ওঠে আবারো সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার। তবে আপাতত মনে হয় না এই সাবমেরিনের আর কোনো ভবিষ্যত আছে। সমস্যা হলো, নিউক্লিয়ার সাবমেরিন খোলা জায়গায় ফেলে রাখা যায় না, সাবধানে আলাদা করে তেজষ্ক্রিয়মুক্ত করতে হয়। খরচসাপেক্ষ এই কাজটি করাও ঝক্কির কথা।
টম ক্ল্যানসি নামের এক মার্কিন লেখক দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর শিরোনামে এক উপন্যাস লিখেন যার নায়ক, রেড অক্টোবর নামক আকুলা ক্লাস সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন, যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। বিপুল জনপ্রিয় এই বইকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রও বানানো হয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল আকুলা সাবমেরিন নিয়ে বানিয়েছে ডকুমেন্টারি।
ফিচার ইমেজ – wikimedia commons