সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চর্চা শুরু হয় মানুষের দলবদ্ধ জীবনের প্রারম্ভিক সময় থেকেই। শিকার করা, গুহার মানুষদের মধ্যে খাদ্যবণ্টন থেকে শুরু করে পরবর্তী গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনেও ছিল এই প্রক্রিয়ার চর্চা। তবে, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির প্রথম আলামত আমরা পাই আড়াই হাজার বছর আগে, প্রাচীনের গ্রিসের নগররাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক কাঠামোতে। গ্রিসের সেই নগররাষ্ট্রগুলোর বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গণতন্ত্র চর্চার আলামত পাওয়া গেছে রাষ্ট্রচিন্তকদের সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে। তবে, মোটাদাগে গ্রিসের নগরররাষ্ট্রগুলোতে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক কাঠামোর বিলোপ পায় একশো বছরের মধ্যেই। পরবর্তীতে কাঠামোগত গণতন্ত্রের আবার উত্থান ঘটে আটলান্টিক রেভ্যুলুশনের মাধ্যমে।
এরপর, উনবিংশ শতাব্দী আর বিংশ শতাব্দীতে শাসনব্যবস্থা হিসেবে অনেকগুলো উত্থান-পতনের মধ্যে দিয়ে গেছে গণতন্ত্র। উনবিংশ শতাব্দীতে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকাতে আর লাতিন আমেরিকাতে গণতন্ত্রের শাসনতান্ত্রিক লড়াইটা ছিল মূলত প্রথাগত রাজতন্ত্রের সাথে। পরের শতাব্দীতে শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে গণতন্ত্রের লড়াই হয়েছে ফ্যাসিজম আর কমিউনিজমের সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার আর মুসোলিনীর পতনের সাথে সাথে শাসনতান্ত্রিক মতাদর্শ হিসেবে পতন ঘটে ফ্যাসিজমের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টাতে মতাদর্শগত লড়াই হয়েছে গণতন্ত্র আর কমিউনিজমের মধ্যে। গণতান্ত্রিক বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর কমিউনিস্ট দেশগুলোতে নেতৃত্ব দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে এসে দুই পরাশক্তির এই কথিত স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হয়। এককভাবে মানব সভ্যতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় গণতন্ত্র।
নব্বইয়ের দশকে এই ধারণাকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামো তার ‘এন্ড অব হিস্টোরি’ আর্টিকেলে দাবি করেন, শাসনতান্ত্রিক মতবাদের সংঘাত শেষ হয়েছে এবং গণতন্ত্র মানবসভ্যতার সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই মতবাদের কিছু দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে, রয়েছে মৌলিক কিছু মূল্যবোধ। এই আর্টিকেলের আলোচনা সেই মূল্যবোধগুলোকে নিয়েই।
নিয়মিত ও ন্যায্য নির্বাচন
গণতন্ত্রের সাথে অন্যান্য শাসনতান্ত্রিক মতবাদগুলোর একটি মৌলিক সংঘাত হলো, একজন শাসকের পরিবর্তন আনা, পরিবর্তিত শাসক নির্ধারণ করা ও নির্ধারণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। রাজতন্ত্রে সাধারণত উত্তরাধিকার সূত্রে শাসকের পরিবর্তন এসেছে, রাজার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকার অধিষ্ঠিত হয়েছেন নতুন রাজা হিসেবে। অভিজাততন্ত্রে সাধারণত রাষ্ট্রের অভিজাত অংশের মাধ্যমেই শাসনতন্ত্র নির্ধারিত হয়। গণতন্ত্র এই জায়গা থেকে ব্যতিক্রম। একটি রাষ্ট্রের শীর্ষ বা স্থানীয় পর্যায়ের শাসক হিসেবে কে দায়িত্ব নেবেন, তা নির্ধারিত হয় ‘এক ব্যক্তির এক ভোটের মাধ্যমে’।
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, জনগণ মতামত দিতে পারে তাদের প্রতিনিধির ব্যাপারে, ব্যালটের মাধ্যমে জানাতে পারে সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টি। একজন মানুষ তার জাতি, বর্ণ, অঞ্চলের পরিচয়, ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে, নাগরিক পরিচয়ের ভিত্তিতে ভোট দিতে পারবেন বাঁধাহীনভাবে, করতে পারবেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নির্বাচিত জনপ্রিনিধিরা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রশাসকদের নেতৃত্ব দেন, জাতীয় পর্যায়ের প্রতিনিধিরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন আইন তৈরিতে, রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে।
প্রত্যেক নির্বাচনে যেমন বিজয়ী রয়েছে, একইভাবে রয়েছে পরাজিত অংশ। সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির দেশগুলোতে প্রায়ই দেখা যায়, পরাজিত প্রার্থী নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে চান না। কোন ন্যায্য নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে, সেটি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে, বিঘ্নিত করতে পারে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশকে। ফলে, প্রকৃত অর্থেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও ন্যায্য হলে, পরাজিত প্রার্থীর নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেওয়া উচিত। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ।
জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা
রাজতন্ত্রে একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে শাসনব্যবস্থা আবর্তিত হয় হয়, কেন্দ্রীভূত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে প্রায় সকল ক্ষমতাই নিহিত থকে এক ব্যক্তির কাছে। এই অসীম ক্ষমতার কারণে রাজার ইচ্ছার উপরে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আচরণ নির্ভর করে, নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় পলিসি। ফলে, এই প্রক্রিয়াতে রাজার অসীম ক্ষমতাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার মতো কোনো ব্যক্তি থাকে না, থাকে না কোনো প্রতিষ্ঠান।
গণতান্ত্রিক কাঠামো শাসকের এই অসীম ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করাকে গুরুত্ব দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে আবশ্যিক মূল্যবোধ হিসেবে। এরই অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রধান তিনটি অঙ্গ কর্তৃত্ব আর কাজের পরিধিকে আলাদা করা এই মূল্যবোধের অংশ। প্রধান অঙ্গ তিনটি হচ্ছে, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও শাসন বিভাগ।
প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সাধারণভাবে এই পৃথকীকরণের প্রক্রিয়াটিতে বেশি কার্যকর থাকে, ওয়েস্টমিনিস্টারিয়াল ফর্মের চেয়ে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাহী বিভাগের প্রধান, ক্যাবিনেটেও থাকে তার একক কর্তৃত্ব। আইন বিভাগ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাকে বিভিন্নভাবে জবাবদিহিতার আওতায় আনে এবং তারা ভিন্ন একটি অংশ হিসেবে কাজ করে। ফেডারেল সুপ্রিম কোর্টের বিচারকের নিয়োগ আইন বিভাগের মাধ্যমে হলেও, এটিও রাষ্ট্রকাঠামোর সম্পূর্ণ পৃথক একটি বিভাগ।
অন্যদিকে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী একদিকে যেমন আইন বিভাগের প্রধান, পাশাপাশি তিনি নির্বাহী বিভাগেরও প্রধান। আবার, ক্যাবিনেটের সদস্যরা আইনসভারও সদস্য। ফলে, শাসন বিভাগের কাছে প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য মন্ত্রীদের যে জবাবদিহিতা করার কথা, সেটি আইন বিভাগ ‘স্বার্থের দ্বন্দ্বের’ জন্য করতে পারে না।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকের অংশগ্রহণ
যেকোনো রাজনৈতিক কাঠামোতে রাষ্ট্রের আচরণ নির্ভর করে বিভিন্ন ইস্যুতে নাগরিকদের প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে। ফলে, নাগরিকরা রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে কতটুকু অংশগ্রহণ করছে, নিজেদের মতামত প্রকাশের সুযোগ তৈরি করে নিচ্ছে, সিভিল সোসাইটি হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারছে- এসব প্রভাবকের উপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিক কাঠামোর কার্যকারিতা।
রাজতন্ত্রে বা অভিজাততন্ত্রে এ ধরনের অক্টিভিজমে সুযোগ অত্যন্ত সীমিত এবং সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গী করে এক্টিভিজম পরিচালনা করা যায়। গণতান্ত্রিক কাঠামো সাধারণত স্বাধীনভাবে অক্টিভিজমের নিশ্চয়তা দেয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে, বিশ্বাসের বৈচিত্র্যকে নিরাপত্তা দেয় এবং নাগরিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করে।
পৃথিবীতে যেসব দেশে তুলনামূলকভাবে কার্যকর গণতন্ত্র আছে, সেগুলো গণতন্ত্রের কার্যকারিতা কেবলমাত্র আইনগত ভিত্তির উপর নির্ভরশীল না। বরং, সরকারের বিভিন্ন নীতিতে জনগণের কীভাবে তার প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, সেটিই নির্ধারণ করে গণতন্ত্রের চরিত্র। একটিমাত্র আন্দোলন বা প্রতিবাদের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। বরং, কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়, প্রতিনিয়ত প্রতিবাদ করতে হয়, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে হয়। প্রভাবিত করতে হয় দলীয় রাজনীতির নীতি, বদলে দিতে হয় সরকারের নীতি।
অর্থনৈতিক সাম্য
রাজতন্ত্রের বিকৃত রূপ স্বৈরতন্ত্রে রাষ্ট্রের সম্পদের সিংহভাগ পুঞ্জীভূত হতো রাজার কোষাগারে, রাজার বিলাসব্যয়েই চলে যেত নাগরিকদের সিংহভাগ আয়। একই অবস্থা বিরাজ করে অভিজাততন্ত্রের বিকৃত রূপ কতিপয়তন্ত্রেও। রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র একটি অংশের হাতে চলে যায় সিংহভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। এই দুই তন্ত্রেই বিরাজ করে সামন্তবাদ, যেখানে কৃষকরা থাকে ভূমিহীন, তারা কাজ করে ভূমিদাস হিসেবে, সম্পদের মালিকানা থাকে সামন্তের নিয়ন্ত্রণে।
গণতান্ত্রিক কাঠামোতে মুক্তবাজার অর্থনীতিকে উৎসাহিত করা হয়। এর পেছনে কারণ দুইটি। প্রথমত, এর মাধ্যমে মানুষের মতো উদ্যোক্তা হবার বাসনাকে লালন করা যায়, যা অর্থনীতির আকারকে বড় করতে সাহায্য করে। আবার, রাষ্ট্রীয় নীতির মাধ্যমে সমাজের অতিধনী অংশের উপর করারোপ করে অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাজন কমানো যায়।
দ্বিতীয়ত, একটি রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী হবে, নাকি নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ দেবে, তা নির্ভর করে রাষ্ট্রের হাতে কী পরিমাণ তথ্য আছে নাগরিকদের ব্যাপারে, তার উপর। অর্থনীতির উপর রাষ্ট্রের অধিক নিয়ন্ত্রণ থাকার অর্থ হলো, নাগরিকদের তথ্য অধিকহারে রাষ্ট্রের কাছে চলে যাওয়া। এই অধিক তথ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রকে কর্তৃত্ববাদী হতে উৎসাহিত করে।
স্বাধীন বিচার বিভাগ ও সামাজিক ন্যায়বিচার
রাজাকে বিচারের উর্ধ্বে রাখার যে প্রথা রাজতন্ত্র লালন করেছে শাসনতান্ত্রিক বিকাশের শুরু থেকেই, গণতান্ত্রিক কাঠামো সেই প্রক্রিয়া থেকে বের হয়ে আসার মূল্যবোধ তৈরি করেছে। পাশাপাশি তৈরি করেছে আইনের দৃষ্টিতে সবাইকে সমান হিসেবে দেখার মূল্যবোধ। ফলে, যেকোনো নাগরিক, বর্ণ, জাতি, ধর্মীয় পরিচয় বা অন্য কোনো পরিচয়ের উর্ধ্বে তার নাগরিক অধিকারে আঘাত আসলে রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাইতে পারে। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, আইনসভার সদস্য, সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ অফিসার, কেউই আইনের উর্ধ্বে নন।
ন্যায়বিচার নিশ্চিতের এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে স্বাধীন বিচার বিভাগ। কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোতে বিচারকরা স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পান, অন্যান্য বিভাগের প্রভাবমুক্ত থেকে ন্যায়বিচার নিশ্চিতের সুযোগ পান। তবে, সাম্প্রতিক সময়ে কর্তৃত্ববাদী গণতান্ত্রিক কাঠামোতে অধিক হারে বিচার বিভাগের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটছে বিশ্বজুড়ে।
বহুদলীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি
কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সবসময়ই একের অধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি থাকে, নির্বাচনে থাকে বিজয়ী-বিজিত পক্ষ। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য সরকারি দলের ভূমিকা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদলের উপস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ। একটি রাজনৈতিক কাঠামোতে অনেকগুলো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থাকলে, জনগণের কাছে যথেষ্ট পরিমাণে ‘এক্সিট পয়েন্ট’ থাকে, সরকারি দল কর্তৃত্ববাদী আচরণ করতে চাইলে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। একদলীয় কাঠামো যেকোনো দেশকেই কর্তৃত্ববাদের দিকে নিয়ে যায়।